‘দূত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কত না মর্মান্তিক খবর বহন করে আনে। সে-সব শুনে মাথায় রক্ত চড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। তবু দূতকে প্রাণে মারার নিয়ম নেই। দূত অবধ্য। কার্টুনিস্টও কি অবধ্য হতে পারেন না? আগেই বলেছি, পলিটিক্যাল কার্টুনে আমি কাউকে ছাড়িনি।’ ‘অমল আলোয়’ বই থেকে অমল চক্রবর্তীর ‘ডোডো কিংবা ফিনিক্স’ লেখাটির একটা অংশ এখানে তুলে দেওয়া হল।
নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এখন খবরের কাগজের প্রথম পাতাটার যে চেহারা দেখতে পায়, আমাদের সময়ের সঙ্গে সেটা মেলে না। আমাদের আমলে প্রথম পাতায় ‘লিড নিউজ’-এর সঙ্গে নিয়মিত একটা-না-একটা কার্টুন থাকতই। আবারও বলি, ফটোগ্রাফ নয়, কার্টুন। সামাজিক-রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ের ওপর। তির্যক দৃষ্টি, ব্যঙ্গের চাবুক, প্রথম পাতার সেই হাস্যরস গোটা কাগজের চরিত্র ও মনোভঙ্গি ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করত। এখন, ইংরেজি-হিন্দি-বাংলা প্রায় কোনও কাগজেই প্রথম পাতায় নিয়মিত কার্টুন বেরোয় না। কারণটা জানি না। তবে যে কারণেই হোক, পরিণতিটা আমার কাছে ভীষণ দুঃখবহ। অ্যাপলিটিক্যাল বলে তো সত্যিই কিছু হয় না। সব কাগজই, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ একটা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ অনুসরণ করে। তা হলে আলাদা করে কার্টুনিস্ট-কে অভিযুক্ত করার কারণ কী? কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল, বা রাজনৈতিক নেতাকে অবলম্বন করে কার্টুনিস্টের আঁকা ব্যঙ্গচিত্র যে-বার্তা পৌঁছে দিতে চায়, একটি বলিষ্ঠ, সপাট রিপোর্টিং বা নিখুঁত তথ্য-তত্ত্ব সংবলিত উত্তর-সম্পাদকীয় কি সেই একই বার্তা পৌঁছে দিতে চায় না? সেক্ষেত্রে ওই রিপোর্টার বা পোস্ট-এডিট লেখকের ওপরই নিষেধাজ্ঞার খড়্গ নেমে আসা উচিত, তাই কিনা? কিন্তু সেটা হয় না। হাড়িকাঠে মাথা যায় প্রধানত কার্টুনিস্টের। কেন তিনি অমন করে অমুকের ছবি এঁকেছেন, তমুক ঘটনাটাকে অমন রসালো করে ফেঁদেছেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা সুবিচার না প্রহসন আপনারাই বিচার করুন।
নানা জায়গায় নানা সময় শুনেছি যে, খবরের কাগজের কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে খামোকা অসদ্ভাব চান না বলেই ধীরে-ধীরে খবরের কাগজের প্রথম পাতায় কার্টুনের গুরুত্ব (ব্যতিক্রম ‘সংবাদ প্রতিদিন’) কমে গেল। যুক্তিটা যদি অবান্তর হয়, আমার তরফে কিছু বলার নেই। আর যদি এ-কথার মধ্যে চার আনা হলেও ‘সত্যি’ থাকে, তবে আমি বলব– কার্টুনের শক্তি ও সামর্থ্যের এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর হয় না। একটা পাঁচশো শব্দের রিপোর্টিং কিংবা বিশ্লেষণী সম্পাদকীয় হয়তো সেই বিস্ফোরণ ঘটাতে পারছে না, যা কার্টুনের কয়েকটা বিধ্বংসী রেখচিত্রে স্পষ্ট ও প্রতীয়মান। নইলে, ভেবে দেখুন, কর্তৃপক্ষের মনে হার্ড-রিপোর্টিং ও পোস্ট-এডিট নিয়েও গেল-গেল রব উঠত। বলা হত, অসদ্ভাব তৈরি হচ্ছে। শালীনতার সীমা লঙ্ঘিত হচ্ছে। যদিও সেরকম কোনও কিছু বলা হচ্ছে না। রাজনৈতিক অসদ্ভাব বা শালীনতার প্রশ্নটা উঠছে শুধুমাত্র কার্টুনিস্টদের ক্ষেত্রে। তা হলে কার জোর বেশি?
আসলে যে কোনও প্রথম শ্রেণির পলিটিক্যাল কার্টুন– অন্তত আমার মতে– একই সঙ্গে হার্ড মেটিরিয়াল ও পোস্ট-এডিট অ্যানালিসিস-কে ধারণ করে থাকে। এর ইমিডিয়েট এফেক্ট অনেক বেশি। এবং কোনও কার্টুনিস্ট যদি সৎভাবে এই ভূমিকা পালন করতে পারেন, আমি বলব, তাঁর সঙ্গে দূতের মতো ব্যবহার করা উচিত। দূত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কত না মর্মান্তিক খবর বহন করে আনে। সে-সব শুনে মাথায় রক্ত চড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। তবু দূতকে প্রাণে মারার নিয়ম নেই। দূত অবধ্য। কার্টুনিস্টও কি অবধ্য হতে পারেন না? আগেই বলেছি, পলিটিক্যাল কার্টুনে আমি কাউকে ছাড়িনি। অতুল্য ঘোষের কার্টুন করেছি। প্রফুল্লচন্দ্র সেনের করেছি। এমনকী ইন্দিরা গান্ধী, বিধান রায়। আরও পরে জ্যোতি বসু। মনে পড়ছে না, এঁরা কেউ ব্যক্তিগতভাবে আমাকে একহাত দেখে নেব বলে কখনও হুমকি ঝেড়েছেন। অতুল্যবাবুর এক ভাগনে আমার সহকর্মী ছিল। সে গিয়ে অতুল্য ঘোষকে রিপোর্ট করেছিল আমার নামে। বলেছিল, মামা, তুমি অমলকে কিছু বলো না কেন? ও তো তোমাকে নিয়ে যাচ্ছেতাই সব কার্টুন করে। এর উত্তরে অতুল্যবাবু বলেছিলেন, ধুৎ, কী যে বলিস, ওকে তো আমার মিষ্টি খাওয়ানো উচিত। আমার কার্টুন এঁকে-এঁকে ও আমার জনপ্রিয়তা কত বাড়িয়ে দিয়েছে জানিস।
যুগান্তর-এ কাজ করার সময় দেখেছি, বিধানচন্দ্র রায় কাফী খাঁ-র আঁকা কার্টুন চেয়ে পাঠাতেন। বিধানবাবুকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে, অথচ সেটাই মনে ধরেছে ওঁর। তবে জ্যোতিবাবুর রি-অ্যাকশন কখনও জানতে পারিনি।
প্রত্যেক মানুষের মনেই অনুভূতির আলাদা-আলাদা কিছু খোপ (কম্পার্টমেন্ট) রয়েছে। একটাতে হতাশা। একেক সময় একেকটা অনুভূতি আমাদের পেড়ে ফেলে। কার্টুনিস্টকে এই ‘পেড়ে ফেলা’-র বিরুদ্ধে বিশেষভাবে লড়তে হয়। কেন? কারণ, আপনি যে কার্টুনই আঁকুন, সেটা পলিটিক্যাল হোক বা সোশ্যাল, আপনাকে শেষ পর্যন্ত নির্মল হাস্যরসের দিকে কার্টুনটাকে নিয়ে যেতেই হবে। খুব তেতো মন নিয়ে কাজ করলে, ছবিতে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। স্বচ্ছ, সরস ভঙ্গিটা তখন নষ্ট হয়ে যাবে। অতএব, শিল্পীও ব্যর্থ। কার্টুনিস্টের লক্ষ্য হওয়া উচিত, মানুষকে আল্টিমেটলি হাসানো। এবং সেই হাসির মাধ্যমে অনুশোচনায় ডুবিয়ে দেওয়া। সৃষ্টির মধ্যে বিষাদ, হতাশা, দুঃখ-কণা চুঁইয়ে-চুঁইয়ে মিশে গেলে মুশকিল।
আমি আজও, যখন কাজ করি, সর্বক্ষণ চেষ্টা করি, এই জল-অচল বিভাজনটাকে বজায় রাখতে। আমার জীবনে দুঃখ-কষ্ট আছে। ছিল। থাকবে। কিন্তু, এই ছবি আঁকার মুহূর্তটুকু আমার কাছে অমূল্য। তখন আমি শুধুই ‘অমল’।
(সংক্ষেপিত ও পুনর্মুদ্রিত)
সূত্র: রোববার, সংবাদ প্রতিদিন, ১১ জুলাই ২০১০