আর্মেনীয়রা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে আর সেই সুবাদে বাংলায় পৌঁছে যায়, কলকাতা পত্তনের ষাট বছর আগে বর্তমানের কলকাতা শহরের বুকে আর্মেনীয় সুকিয়াসের বউ রেজা বিবির কবর তার প্রমাণ। আর্মেনীয়রা তাদের প্রিয় খাবার দোলমার অভাব প্রতিনিয়ত অনুভব করত কিন্তু এই দেশে আঙুর পাতা পেত না বলে তাদের দোলমা বানিয়ে খাওয়ার ইচ্ছে অপূর্ণই থাকত। ‘দোলমা’ আদপে তুর্কি শব্দ, খাবারের পুরকে তারা এই নাম দিয়েছিল।
ইংরেজরা তাদের দুশো বছরের রাজত্বকালে নিজেদের দেশে কী কী নিয়ে গিয়েছে, সেটা নিয়ে অনেক হইচই হল কিছুদিন আগে– একটা ফিরিস্তিও দেখলাম, কিন্তু কোথাও কোনও খাবারের উল্লেখ দেখলাম না। আমাদের দেশ থেকে ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়া খাবারের গল্প পরের জন্যে তুলে রেখে বরং যাদের দৌলতে আমাদের হেঁশেলে নতুন পদের সৃষ্টি হয়েছে, তাদের কথা বলি।
বাঙালির হেঁশেলের ‘দোলমা’ আদপে কিন্তু বাংলার খাবার নয়, এখানে এসেছিল আর্মেনীয়দের সঙ্গে। আর্মেনীয়দের সঙ্গে এই দেশের সম্পর্ক ব্রিটিশদের ভারতবর্ষে আসার বেশ আগে থেকে। অটোম্যানের আমলে আর্মেনিয়া দখল হয়ে গেলে আর্মেনীয়রা যখন দেশছাড়া হয়, আকবর বাদশা শান্তিপ্রিয় নির্বিরোধী অথচ বুদ্ধিমান এই আর্মেনীয়দের এই দেশে আশ্রয় দেন আর ব্যবসা করার অনুমতি দেন। আর্মেনীয়রা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে আর সেই সুবাদে বাংলায় পৌঁছে যায়, কলকাতা পত্তনের ৬০ বছর আগে বর্তমানের কলকাতা শহরের বুকে আর্মেনীয় সুকিয়াসের বউ রেজা বিবির কবর তার প্রমাণ। আর্মেনীয়রা তাদের প্রিয় খাবার দোলমার অভাব প্রতিনিয়ত অনুভব করত কিন্তু এই দেশে আঙুর পাতা পেত না বলে তাদের দোলমা বানিয়ে খাওয়ার ইচ্ছে অপূর্ণই থাকত। ‘দোলমা’ আদপে তুর্কি শব্দ, খাবারের পুরকে তারা এই নাম দিয়েছিল। হাজার হাজার বছর ধরে এই দোলমা মধ্যপ্রাচ্য রাজত্ব করে এসেছে, বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নাম তার, কিন্তু আদপে সেটা দোলমা। আঙুর পাতার মধ্যে ফল, সবজি, মাংস– বিভিন্ন জিনিসের পুর দিয়ে সেই দোলমা বানানো হত। তার আগে প্রাচীন গ্রিক রন্ধনপ্রণালীতেও দোলমাকে পাওয়া যায়, ডুমুর পাতার মধ্যে চিজের পুর দেওয়া সেই জনপ্রিয় পদকে যদিও তখন ‘থ্রিওন’ বলা হত। আবার আর্মেনীয়দের কথায় ফেরা যাক। যখন আর্মেনীয়রা মোটামুটি নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছে, পর্তুগিজরা বাংলার দিকে নজর দিল। আর্মেনীয়দের উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসা আর পর্তুগিজদের উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্য বিস্তার, তাই স্বাভাবিকভাবেই দু’জনের উদ্দেশ্যে সংঘাত হল না। বরং আর্মেনীয়রা লাভবান হল পর্তুগিজদের থেকে, কারণ পর্তুগিজরা ততদিনে বাঁধাকপি নিয়ে চলে এসেছে এই দেশে। এই বাঁধাকপির পাতা আর্মেনীয়দের দীর্ঘদিনের দোলমা বানানোর সমস্যা মেটাল। আর এই দোলমা বানানোর কসরত প্রথমে শিখল খানসামারা আর সেখান থেকে বাংলার হেঁশেলে। নিরামিষ আর আমিষ– দুই রকমের দোলমা হয় বলে বাংলার নিরামিষভোজীদের একটা বড় সমস্যার সমাধান হল। মিষ্টির দোকানে যে পটলের মধ্যে ক্ষির আর মিছরির পুর দেওয়া যে দোলমা পাওয়া যায়– ইরাকের ইহুদিরা এক্কেবারে একই রকম মিষ্টি খেয়ে আসছে বহু বছর ধরে। সেই দোলমার কথা না জেনেই আমরাও একই রকম একটা দোলমা বানিয়ে ফেলেছি দোলমার প্রতি ভালোবাসায়।
দেবীপক্ষ শুরু হয়ে গিয়েছে, আরও একটু মিষ্টির গপ্প হোক। সন্দেশ বাঙালির কাছে নতুন খাবার নয়, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যেও বারবার উল্লেখ আছে সন্দেশের। তবে সেই সন্দেশ ছিল খোয়া আর নারকেল দিয়ে তৈরি। দুধকে লেবুর রস দিয়ে কেটে তা দিয়ে সন্দেশ? সর্বনাশ, এ তো নষ্ট হয়ে যাওয়া খাবার! মিষ্টি বানানো দূরের কথা, ছানা বানানোরই কোনও অভিপ্রায় ছিল না সেকালের বঙ্গবাসীর। কিন্তু পর্তুগিজরা বাংলার মুলুকে এসে চিজ খুঁজতে লাগল, আর তা না পেয়ে হট্টগোল লাগিয়ে দিল। ব্রেড আর চিজ ইউরোপীয়দের দুই প্রিয় খাবার– এই দুটো ওদের খাবার টেবিলে থাকবেই। স্থানীয় মানুষ বিপদে পড়ল এই দাবিতে কারণ চিজের সঙ্গে কোনও পরিচয়ই নেই এদেশের। শেষে যেভাবে রুটির সমস্যার চেয়ে অনেক সহজেই পর্তুগিজরা চিজের সমস্যা সমাধান করল ছানা দিয়ে। দুধ কেটে ছানার জল সরিয়ে ছানাকে গরম করে চিজ বানিয়ে নিজেদের কলোনি ব্যান্ডেলের নামে ‘ব্যান্ডেল চিজ’ নাম দিল। শুধু চিজ না, এই দুধ কেটে তারা মিষ্টিও বানাতে শুরু করল নিজেদের মতো করে, ইউরোপে এর ছানাতে মিষ্টি মিশিয়ে দেজার্ট বানানো পুরনো রেওয়াজ, ফ্রান্সে পাঁচশো বছর ধরে লোকে শেষ পাতে জাঙ্কেত খাচ্ছে। স্থানীয় মানুষ দূর থেকে এই গোটা প্রক্রিয়াটা দেখে বিজাতীয় খাবার খাওয়া ঠিক হবে না ভুল হবে এই দ্বন্দ্বের মধ্যে কিছুদিন থেকে একদিন সাহস করে খেয়ে বুঝল স্বাদটা নেহাত মন্দ নয়, শুদু স্বাদটা নোনতা। ব্যান্ডেল চিজ থেকে নুনের পরিমাণ বাদ দিয়ে চিনি আর গুড় দিয়ে বিভিন্ন হেঁশেল-গবেষণা করার ফল হচ্ছে আজকের সন্দেশ।