পুজো মানেই অল্প জিরিয়ে নেওয়া। আর অল্পের হাত ধরেই আসে গল্প। জীবনের ফাঁকফোকরে কয়েক মিনিট একটু অন্য জীবনের ডেরায় ঘুরে আসা। একটু চক্কর মেরে আসা আরেকটা জীবনে। সে জীবন, নিজের জীবন থেকে খুব দূরের নয়। আসুন পড়ে নিই, রোববার.ইন-এর পাতায় ষষ্ঠীর দ্বিতীয় গল্প। লিখেছেন সৌরেন চৌধুরী।
সীতানাথের দোতলা বাড়ি। বাড়ির পূর্বদিকে একতলার ছাদে, ছাদ-খোলা একটা বারান্দা আছে। আলো আর হাওয়া-বাতাসের জন্য এখানে ঘর করেননি। বারান্দাটা সিমেন্টের আড়াই ফুট উঁচু গাছা দিয়ে ফাঁকা ফাঁক করে ঘেরা। সকালে এই বারান্দায় সবথেকে আগে রোদ এসে পড়ে। বিকেলে সবার আগে ছায়া নামে। এই বারান্দায় শীতের সকাল আর গ্রীষ্মের বিকেল সীতানাথের বড় প্রিয়। রোজের মতো আজও বিকেলে ঘর থেকে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে নিয়ে বারান্দায় এসে বসলেন তিনি।
বাড়ির সামনে রাস্তা। রাস্তার ওপারে ঘোষবাবুদের বাড়ি। রাস্তাটার পরিসর বিশেষ নেই। অদূরে চৌমাথা থেকে বেরিয়ে এসেছে গলিটা। তার বাড়ির ডানপাশে নন্দীদের কাঠা পাঁচেক ঘন জঙ্গলে জায়গা। বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে ঘেরা। কবে বাড়ি করবেন কে জানে! কয়েক বছর হল কিনে ফেলে রেখেছেন। বর্ষাকালে, ঘাস লতাপাতা আর আগাছাগুলো এবেলা-ওবেলা বাড়ছে। সাপের আস্তানা হয়েছে একটা। নন্দীবাবুর সঙ্গে দেখা হলে বলবেন, ‘সাপে খাওয়াবেন নাকি আমাদেরকে, কবে বাড়ি করছেন?’
আজ বাতাস নেই। আকাশে মেঘ। বৃষ্টি হয়নি এখনও। ফলে ভ্যাপসা গরম। ডানপাশের তিন-চারটে বাড়ির ওপারে চৌপথিতে একটা গন্ডগোল হচ্ছিল। এখান থেকে দেখা যাচ্ছিল না। দু’জনের উত্তেজিত কথা শোনা যাচ্ছিল। তার সঙ্গে কানে আসছিল একটা মেয়ের কান্না। এই কিছুদিন আগেও যে কোনও ঘটনায় মেয়ের গন্ধ পেলেই মানুষ পাকা কাঁঠাল ভাঙা মাছির মতো ভন ভন করে জড়ো হত। এখন তাতেও ভয় পায়। মেয়েটির চিৎকার উত্তরোত্তর বাড়ছিল। শুনে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ল সীতানাথের কপালে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। দেখলেন, তাঁর মতো ঘোষবাবুও বেরিয়ে এসেছেন তাঁর ঘরের বারান্দায়। সীতানাথ বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ালেন। ঝুঁকে পড়ে ঘাড় বেঁকে দেখার চেষ্টা করলেন। কিছু দেখতে পেলেন না। ভাবলেন, জিজ্ঞাসা করবেন ঘোষবাবুকে, তাঁর দিক থেকে কিছু কি দেখতে পাচ্ছেন? ঘোষবাবু খুব সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, না, তিনিও কিছু দেখতে পাচ্ছেন না, ব’লে ঘরে ঢুকে গেলেন।
এখন এটাই হয়েছে। কোথাও গন্ডগোল দেখলেই বেশিরভাগ মানুষ ঘরের বাইরে আসেন না। রাস্তায় লোক থাকে না। বারান্দায় থাকলে উঠে ঘরের ভেতরে চলে যান। কোথায় যেন পড়েছিলেন, ‘ভোঁতা অসাড় মহানগরীর মন আজ আর মানুষের সঙ্গে ইনভলভড আছে বলে মনে হয় না।’ কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পড়েছিলেন, তাও মনে নেই। শুধু মনে হচ্ছে, কথাটা এতটা বোধহয় ঠিক নয়। মানুষ শেল্টার খুঁজছে। প্রতিবাদের পর একটু সাহসের জায়গা। তখন শুনতে পেলেন একটা নারীকণ্ঠের আর্তনাদ ‘আমার দাদাকে বাঁচান, আমার দাদাকে বাঁচান।’
–ওকে মারছে কেন ওরা?
–আমাকে বাজে কথা বলেছিল। দাদা ওদেরকে ধমক দিয়েছিল তাই।
–চার-পাঁচজন মিলে মারছে। এখন দাদার কী হবে?
–দাদার যাই হোক, তুমি পালাও। লোকটা যেতে যেতে বলে গেল মেয়েটাকে।
সীতানাথ কথাগুলো শুনতে পেলেন কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। তারপর কিছুক্ষণ খুব মারামারির শব্দ। কে কাকে মারছে, তা-ও দেখতে পাচ্ছেন না। ছটফট করছেন সীতানাথ। কানে এল ছোটাছুটি করার পায়ের শব্দ। শব্দটা চৌপথি থেকে তাঁদের বাড়ির দিকেই আসছে। হঠাৎ শুনলেন, জঙ্গলের মধ্যে ধপ করে একটা কিছু পড়ল। ঘন জঙ্গল। চোখ বুলিয়ে প্রথমে কিছু দেখতে পেলেন না। পরে দেখলেন একজন সুঠাম যুবক একটা হেলে-পড়া গাছের ডালের নিচে লুকিয়ে আছে। সীতানাথ চমকে উঠলেন। এই অবেলায় ছেলেটা এই জঙ্গলের মধ্যে কেন ঢুকেছে? ডাক দিলেন, ‘এই, তুমি ওখানে বসে আছ কেন? সাপে খাবে তো!’ হঠাৎ সাপের ভয় আর আবেগে ভুলে গেছিলেন কুটিল সাপের চেয়েও ভয়ংকর আরও একটা কিছু ওকে খাবার জন্য খুঁজছে। ছেলেটাই মনে করিয়ে দিল একথা, মুখে তর্জনী ঠেকিয়ে তাঁকে ইশারায় চুপ করতে বলল।
সীতানাথ দেখলেন, ছেলেটার কনুই বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। বলতে চাইলেন, এত রক্ত কীসের? এমন সময় ‘কোথায় গেল? কোথায় গেল?’ করে ছুটে এসে বাউন্ডারি ওয়ালের গ্রিলের দরজা ধরে দাঁড়াল চার-পাঁচজন উত্তেজিত যুবক। জোর ধাওয়া করে আসার জন্য নাক দিয়ে হাঁপরের মতো বাতাস পড়ছিল ভোঁস ভোঁস করে। না কি ওটা রাগ দেখাচ্ছিল ছেলেটাকে? হাতে হাতে ঝক্ ঝক্ করছিল উদ্যত ভোজালি। ছেলেটাকে পেলে পাঁচজন মিলে খুঁচিয়ে মারবে। বিরাট বীর। ওদের মধ্যে থেকে একজন লাফ দিয়ে উঠে পড়ল পাঁচিলের ওপর। ওঠেই পকেট থেকে রিভলভার বের করল। সেটার মুখ আকাশের দিকে তুলে হাঁক ছাড়ল, ‘কেউ কাউকে ফোন করবেন না! পুলিশ এলে সব বাড়ি জ্বালিয়ে দেব।’
নীচ থেকে একটা ছেলে চিৎকার করে বলল, ‘দে শালার খুলিটা উড়িয়ে দে! আমাদের ছেলের গায়ে হাত।’
পাঁচিলের ওপরে হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটা বলল, ‘ভেতরে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না তো!’
নীচ থেকে ধমকিয়ে উঠল সেই ছেলেটা, ‘ধ্যাৎ, কী বলছিস? তুই একটা কানা। আমি লাফ দিয়ে নামতে দেখেছি ওকে। ভাল করে দেখ। এর ভেতরেই আছে।’ রাগে অস্থির হয়ে সঙ্গীদের বলল, ‘এই ঢোক তো তোরা। হারামজাদার মুন্ডুটা ছিঁড়ে আন ওর গলা থেকে।’
গাছের গায়ে জড়ানো লতা-গুল্মরা বেশ আড়াল করে ফেলেছে ছেলেটাকে। ওদের খুব কাছেই আছে। ভাগ্যিস ছেলেটা কালো গেঞ্জি পরে বেরিয়েছিল আজ। যত দিনের আলো কমে আসছে, ততই সে মিশে যাচ্ছে জঙ্গলে। তিনি আগে থেকে দেখেছেন, তাঁর চোখের কাছে জায়গাটা পরিচিত ছিল বলে এখনও দেখতে পাচ্ছেন ওকে। তবে আর ওদিকে তাকাবেন না। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে যদি ওরা ছেলেটাকে ধরে ফেলে!
পাঁচিলের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলো রাগে ফুঁসছিল আর থেকে থেকে হুংকার দিচ্ছিল, ‘এই, কোথায় লুকিয়ে আছিস? বাপের ব্যাটা হোস তো বেরিয়ে আয়!’ ওদের দেখে অসহ্য লাগছিল সীতানাথের। প্রকাশ্য দিনের বেলায় এদের এই চেহারা। রাতের রাস্তায় একলা মেয়ে দেখলে এদের কেমন চেহারা হয়? সে চেহারা দেখেছি দিল্লি, বারাসত, কামদুনি। থাক, রাতের চেহারা আর তিনি দেখতে চান না। হাতের ওই কালো মেশিনটা দেখে দিনেই ভয় পাচ্ছেন। ভাবছেন ঘরে ঢুকে যাবেন না কি?
–যেতে পারছেন না। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছেন সীতানাথ।
–কেন?
–ওই ছেলেটার জন্য।
বুঝতে পারছেন ওর অবস্থা। ওর কী হয়, না দেখে উঠবেন কী করে! তাহলে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা এই ছেলেটাই কি সেই মেয়েটার দাদা? যার অপরাধ– বোনের হয়ে প্রতিবাদ করা? না, না, একটু প্রতিবাদ করার জন্য কারও এরকম জীবন কেড়ে নেওয়া এখন হয় না কি! এ নিশ্চয়ই অন্য কেউ। যদিও তিনি কাউকে দেখেননি। তাহলে তিনি কাকে বাঁচাতে চাইছেন? ভালোকে না মন্দকে? দোষী না নির্দোষ? তাঁর বোধহয় এত বেশি বোঝার দরকার নেই। তাঁর এখন এইটুকু বুঝলেই চলবে– একজন মানুষ একজন মরণাপণ্ণ মানুষকে বাঁচানোর বুদ্ধি খুঁজছেন।
হাতে মেশিন ধরা ছেলেটা পাঁচিলের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সীতানাথের কাছে চলে এসেছে। এদিকে বেশি না আসারই কামনা করেছিলেন তিনি। কারণ ও যদি পাঁচিল ধরে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর সমান্তরালে এসে জঙ্গলের দিকে তাকায়, তাহলে লুকিয়ে থাকা ছেলেটাকে দেখে ফেলতে পারে। না, মেশিন আর এগিয়ে এল না তাঁর বারান্দার কাছে। পাঁচিলের কোনাটায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকু, এখানে একটা ছেলেকে লুকোতে দেখেছেন?’
সীতানাথ ভারী অবাক হলেন, বাঃ, ডাক-হাঁক তো বেশ ভাল। মনে হল বলে দেবেন, ‘ওই যে, ওখানে লুকিয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে।’ তা কি পারেন, বিবেক নেই না কি মানুষের! কিন্তু মেশিন ইচ্ছা করলে ওখান থেকেই তাঁকে লুটিয়ে ফেলতে পারে। সামনে রাস্তা থাকলেও পাঁচিলের ওপর থেকে সামনের দুই বাড়ির বারান্দায় আজ কেউ থাকলে তাঁদেরও লুটিয়ে ফেলতে পারে। এমনকী, পাঁচিল ধরে এগিয়ে গেলে ওই কোণ থেকে ওই পাশের বাড়ির লোককেও পেড়ে ফেলতে পারে। ভেতরে ভেতরে ঘামছিলেন। কী বলবেন, দোনোমোনো করছেন। উত্তর দিতে একটু দেরি করে ফেলছেন। ধৈর্য হারাল ছেলেটা। মেশিনের ট্রিগারে হাত দিয়ে তর্জনীর মতো ওই কালো নলটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে কর্কশ গলায় চিৎকার করে উঠল, ‘এই গাড়ল, কী বললাম তোকে!’
এত জোরে চিৎকার করল, মনে হল, গোটা পাড়া শুনল ওর কথা। সীতানাথ ভাবলেন, সুন্দরবন অঞ্চলে প্রায়ই শোনা যায়, মানুষকে বাঘ মুখে করে তুলে নিয়ে গিয়েছে। ওরা রয়েছে বাঘের মুখে। আমরা কালো ছোট্ট এই নলের মুখে। যুগপৎ ঘৃণা ও ভয় দমন করে বললেন, ‘না, কাউকে দেখিনি তো।’
–মিথ্যা বলছেন না তো?
সেই সময় তাঁর স্ত্রী ডাকলেন, ‘চা দিয়েছি। ঘরে এসো।’ সীতানাথ ঘর থেকে আর একটা প্লাস্টিকের চেয়ার বের করে আনলেন। স্ত্রীকে ডাক দিলেন, ‘আশালতা, চা দুটো বাইরে নিয়ে এসো। আজ এই বারান্দায় বসে চা খাব।’ আশালতা ঘরের মধ্যে থেকে কিছুই বুঝতে পারেননি। দু’হাতে দু’কাপ চা নিয়ে বারান্দায় আসতে ঠকঠক করে প্লেটের ওপর কেঁপে উঠল চায়ের কাপটা। ছলকে পড়ল নিজের শাড়ি, সীতানাথের সাদা পাঞ্জাবিতে। সীতানাথ নিজের কাপটা ওঁর হাত থেকে নিয়ে বললেন, ‘বসো।’ তারপর চা খেতে খেতে অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘কতদিনের ঘাম-রক্ত ঝরিয়ে গড়া সভ্য মানুষের এই খোলা বারান্দাটুকু ছেড়ে যাব? দেখো– সামনের বাড়ির ঘোষবাবু আর তাঁর স্ত্রী বারান্দায় বসে ওদের দেখছে। তার পাশের বাড়ি বাসুদার ছেলে আর ছেলের বউ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। জায়গাটার ওপাশের বাড়ির বারান্দায় চৌধুরিদা আর তাঁর বউ।’
রিভলভার হাতে ছেলেটা কালো নল আকাশের দিকে তুলে ঘুরে ঘুরে গোটা পাড়াটা দেখল কয়েকবার। তারপর কী ভাবল কে জানে, লাফ দিয়ে পাঁচিল থেকে নেমে বলল, ‘এই চল ফোট সব, কেউ নেই এখানে।’
অলংকরণ: শান্তনু দে