পুজো মানেই অল্প জিরিয়ে নেওয়া। আর অল্পের হাত ধরেই আসে গল্প। জীবনের ফাঁকফোকরে কয়েক মিনিট একটু অন্য জীবনের ডেরায় ঘুরে আসা। একটু চক্কর মেরে আসা আরেকটা জীবনে। সে জীবন, নিজের জীবন থেকে খুব দূরের নয়। আসুন পড়ে নিই, রোববার.ইন-এর পাতায় দশমীর গল্প। লিখেছেন অম্লানকুসুম চক্রবর্তী।
মাসের প্রথম পনেরো দিনের সেলস তুমুল ঝাড় খাওয়ার পরে যখন বাকি পনেরো দিনের রিকভারি প্ল্যান দেখাতে হচ্ছিল আমার উপরওয়ালাকে, ঠিক তখনই আমার মা বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে যেতে গিয়ে ধপ করে পড়ে গেল। ৩০ পার্সেন্ট অ্যাচিভমেন্ট নিয়ে মাসে দেড় লক্ষ টাকার মাইনে কীভাবে জাস্টিফাই করব– এ নিয়ে প্রশ্ন উড়ে এল। আইপ্যাডের দিকে চেয়ে গম্ভীর মুখে প্রশ্নটা করলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। বলতে যাচ্ছিলাম। পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের পরের স্লাইডে কয়েকটা বুলেট পয়েন্ট তৈরি করাই ছিল। আমাদের কোম্পানির ভাষায় ওগুলোকে বলা হয় ‘বিল্ডিং ব্লকস’। কিন্তু দেখলাম মা ছটফট করছে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেটা চিৎকার না গোঙানি– ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। শব্দ পাওয়া যায় না। আমি একটু তোতলাতে শুরু করলাম। মিটিংরুমে বসা সেলস টিমের বাকি ১২ জন আমার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে রইল। মাপতে লাগল। অনেকের মুখেই তির্যক হাসি। মিনিট খানেক পরে এক মহিলা হেলতে দুলতে মোবাইলের স্ক্রিনে হাজির হল। মাকে ওঠানোর চেষ্টা করল। আমি এন্টার মেরে পরের স্লাইডে গেলাম।
এরকম রিভিউ মিটিং হলে মাকে ১৫-২০ মিনিট দেখা যায়। প্রত্যেকে যে যার নিজের পোর্টফোলিও নিয়ে বকরবকর করে। কতরকম গ্রাফের কত রকমের উত্থানপতন দেখায়। সামনে রাখা বিরাট বড় স্ক্রিনের প্রতিটা স্লাইডে চাউমিন খেলা করে। আমাদের ভাইস প্রেসিডেন্টের তুখড় চোখ। পেঁচিয়ে থাকা চাউমিনের কোন সুতোটা ওপরের দিকে যেতে যেতে এই সবে নিচে নামব-নামব করছে, চোখের পলকে ধরে ফেলেন। চোখা চোখা প্রশ্ন করেন। সবাই যে যার মতো এক্সপ্লেনেশন দেয়। মাসের ৩০ তারিখ মোবাইলে ট্রিং করে ‘স্যালারি ক্রেডিটেড’ মেসেজটা আসা জরুরি। প্রায় মুখঢাকা গামলায় ঘোলাটে জলে বন্দি জিওল মাছগুলো আবার একমগ জল পায়। যাই হোক, অন্যরা যখন প্রেজেন্টেশন দেয় তখন আমি মোবাইলে মাকে দেখি। এই মিটিংগুলোর দিনই একটু বেশি সময় দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। আমার সিসিটিভি ক্যামেরার মা। বনানীদি, মানে মায়ের জন্য রাখা আয়াটাকেও দেখি। ও নিজের মাইনে, মানে মাসের শেষে কড়কড়ে ১৫ হাজার টাকার কতটা জাস্টিফাই করছে, বোঝার চেষ্টা করি। ক্যামেরাটা যেহেতু ঘরের কোণায় লাগানো, তাই মা আর বনানীদিকে এক ফ্রেমে দেখতে পাওয়াটা জরুরি। আমার মোবাইলে আবার দুটো অ্যাপ পাশাপাশি খোলা যায়। একটায় সিসিটিভি খোলা থাকে। অন্যটায় ফেসবুক। বন্ধুদের পোস্টগুলো মিস করা আমি একেবারে অ্যাফর্ড করতে পারি না। মডেলটা লেটেস্ট। তাই আটষট্টির অথর্ব মা আর ‘ফিলিং অসাম অ্যাট বুর্জ খলিফা’ একসঙ্গেই থাকে।
আমি আর সুনন্দা– দু’জনেই প্রবল ব্যস্ত। আমার এফএমসিজি। সুনন্দার আইটি। কোড লেখার ফাঁকে মুখ তোলার সময় হলে সুনন্দা আমায় হোয়াটসঅ্যাপ করে জিজ্ঞেস করে, ‘মাকে দেখলে?’ বেশিরভাগ সময়েই আমি বলি, ‘সময় হয়নি গো। তুমি একটু দেখে নিও প্লিজ। জাস্ট দু’মিনিট। আমাকে জানিও। একটা স্ক্রিনশট পাঠিও।’ মাইক্রোসফট এক্সেলে ৫০-৬০ হাজার রো আর ৩০-৩৫টা কলাম নিয়ে সেলস প্রোজেকশন বানানোর ফাঁকে মুখ তোলার সময় হলে আমি সুনন্দাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে জিজ্ঞেস করি, ‘মাকে দেখলে?’ দশ বারের মধ্যে আটবারই ও অবশ্য বলে, ‘সময় হয়নি গো।’ ও বলে, ‘তুমি একটু দেখে নিও প্লিজ। জাস্ট ওয়ান মিনিট।’ আমি জিজ্ঞেস করি, ‘স্ক্রিনশট পাঠাব?’ ও বলে, ‘নট রিকোয়ার্ড। তুমি মোবাইলে সেভ করে রেখে দিও। আমি পরে বাড়ি গিয়ে দেখে নেব।’
আমার যখন ক্লাস থ্রি, বাবা তখন একটা ফ্ল্যাট কিনেছিল মধ্যমগ্রামে। একটা পাঁচতলা বাড়ির দোতলায় ছিল আমাদের দু’-কামরার ফ্ল্যাট। সামনে বিরাট বড় পুকুর ছিল। মনে আছে, সেই পুকুরের ধারে পুজোর আগে দোল খেত কাশফুল। নিচু গ্রেডের সরকারি কর্মচারী ছিল আমার বাবা। রিটায়ারমেন্টের ঠিক তিন বছরের মাথায় যখন ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যারেস্টটা হয়, নিজে কিছু বুঝতে পেরেছিল কি না, জানি না। কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্সে কাঁপা হাতে আমার হাতটা ধরে বলেছিল, ‘মাকে দেখিস। সুনন্দা কতটা দেখবে আমি জানি না। তুই দেখিস।’ বাবার কপালে হাত রেখেছিলাম আমি। আশ্বস্ত করেছিলাম। বলেছিলাম, ‘‘বড্ড দূরের কথা ভেবে ফেলেছ বাবা। কিচ্ছু হয়নি তোমার। মাত্র দু’-তিনদিনের তো একটা ব্যাপার। বাড়ি নিয়ে যাব তোমায়।” চার দিন পরে নিয়ে গিয়েছিলাম। বাড়ি। গাড়িতে অনেক ফুল ছিল।
যেদিন এই ঘটনাটা ঘটল, তার ঠিক এক সপ্তাহ পরে ছিল আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। সুনন্দা বলেছিল, ‘আমাদের থাকার একটা নতুন ঠিকানা দাও। আমি টালিগঞ্জের মেয়ে। এই ধ্যাড়ধ্যাড়ে মফস্সল ভালো লাগে না আর।’ কফি খেতে খেতে ফোনের মধ্যে ডাউনলোড করে নিয়েছিলাম কয়েকটা প্রপার্টি দেখার অ্যাপ। সব জায়গায় লিখেছিলাম, ‘রিকোয়েস্টিং এ কলব্যাক।’ সুনন্দা আমায় প্রকাশ্যে চুমু খেয়েছিল। ওকে এত সাহসী দেখিনি এর আগে।
আমি দুম করে বলে ফেলেছিলাম, ‘মায়ের কী হবে?’ সুনন্দার মুখ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল মুহূর্তে। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির অ্যাডভান্টেজ নিয়ে অনেক জ্ঞান দিয়েছিল। দু’জনে মিলে আলাদা যাপন নিয়ে অনেকগুলো বুলেট পয়েন্ট ওর মাথার মধ্যে হয়তো সাজানো ছিল আগে থেকেই। আমাদের কোম্পানির ভাষায়, ‘বিল্ডিং ব্লকস’। সুনন্দা বলেছিল, ‘মানি ইজ এভরিথিং, হানি। বাঁচব যখন, রয়্যালি বাঁচব।’ জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি কনভিন্সড তো?’ ঘাড় নেড়েছিলাম আমি।
পরের দিন থেকে শ্রাবণের ধারার মতো আমার কাছে ফোন আসতে শুরু করে। অ্যাপে প্রেফার্ড এরিয়ার জায়গায় লিখেছিলাম, রাজারহাট-নিউটাউন। ফলে ওই চত্বরের ‘আপকামিং প্রোজেক্টস’-এর শ’খানেক ব্রোশিওর হাজির হয়ে যায় আমার মোবাইলের হোয়্যাটসঅ্যাপে। কোনও কোনও প্রোজেক্টের সেলস টিম বাড়ির সামনে গাড়ি পাঠিয়ে তুলে নিয়ে যেতে চায়। ‘ওয়েলকাম টু দ্য ওয়ার্ল্ড ক্লাস লিভিং’ বলে মডেল ফ্ল্যাট দেখিয়ে বলে, ‘বাকি কথাগুলো তাহলে পাশের কফিশপে বসে শেষ করে নিই স্যর?’ আমি পিছু নিই। বেঁচে থাকা মানে যে শুধু বাড়ি নয়, তার গায়ে যে বসানো যেতে পারে কত রকমের অলংকার, তা নিয়ে ওরা আমায় প্রেজেন্টেশন দেয়। সুইমিং পুল, ব্যাঙ্কোয়েট হল, মাল্টিজিম, কিডস প্লে এরিয়া, জাকুজির ছবি দেখিয়ে ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কনভিন্সড তো?’ আমি ঘাড় নাড়ি। অনেক জায়গায় কনভিন্সড হতে হতে শেষে একজায়গায় সই করে দিই। ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স যা ছিল বেশি লোন নিতে হয়নি। আট-ন’মাসের মধ্যেই এক কোকিলকণ্ঠী ফোন করে বলে, ‘পজেশনের জন্য ফ্ল্যাটটা একেবারে রেডি স্যর। ওয়েলকাম টু দ্য ওয়ার্ল্ড ক্লাস লিভিং।’ মনে আছে, খবরটা শোনার পরে সুনন্দার মুখটা জোৎস্নার মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। আর মায়ের হাতের আঙুলগুলো ঝড়ের মতো কাঁপছিল। কিছুক্ষণ পরে বেসিন ভাসিয়ে দিয়েছিল বমি করে। জানতে পারলাম, নার্ভের ওষুধগুলো খায়নি। ওষুধ মিস করলে এমনটা হয়।
বাবা চলে যাওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যে যখন মায়ের পার্কিনসন্স ধরা পড়ে, সুনন্দা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ফ্ল্যাটের পজেশনটা কবে খবর নিয়েছ?’ হাতের আঙুলগুলো কাঁপা দিয়ে মায়ের যে রোগের শুরু, তার অবণতি হতে থাকে দ্রুত। কেমন যেন কুঁজো হয়ে যেতে থাকে, হাঁটাচলার স্পিড কমে যায়। গলার আওয়াজও নিস্তেজ হয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। পা টলমল করে। একদিন ভোরবেলা আমাদের বেডরুমে টোকা দেয়। বউ আমাকে জাপ্টে ছিল তখন। অবিন্যস্ত সুনন্দা দরজা খোলার পরে দেখে, বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে মা। হাতে চা-পাতার কৌটো। বলল, ‘লজ্জা করছে বউমা। পনেরো মিনিট চেষ্টা করেও খুলতে পারলাম না। আঙুলের এই কাঁপাটা বেশ বেড়েছে গো।’ সুনন্দা তড়িঘড়ি কৌটোর মুখটা খুলে দিয়ে, দরজা বন্ধ করে বলেছিল, ‘বাঁচতে চাও তো পালাও এক্ষুনি। লক্ষণ ভালো ঠেকছে না। আরেকবার খোঁজ নিয়ে দেখো না গো পজেশনটা কবে?’ আমি জেনেছিলাম। বলেছিল, ‘অন ট্র্যাক, স্যর।’ পালাতে চেয়েছিলাম।
মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘নতুন বাড়িতে আমাদের সঙ্গে যাবে তো মা?’ মা বলেছিল, ‘তোরা সুখে থাক।’ আমি আর বেশি সাধিনি। সুনন্দা গুগল দেখে জেনেছিল, পারকিনসন্সে নাকি শেষ জীবনটা একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে যেতে হয়। মানে টয়লেট-পটি সবই বিছানায়। সুনন্দা বলেছিল, ‘মা গো! কী ঘেন্নার একটা রোগ। চলো, পালাই।’ মাকে বললাম, ‘তোমার তো শরীর ঠিক নেই মা। একা পারবে তো?’ মা চেয়েছিল কিছুক্ষণ আমার দিকে। তারপরে বলল, ‘সামলে নেব। সারাদিন তো একাই থাকি।’ চোখ মুছছিল আমার মা। বলল, ‘‘কয়েকটা কথা ছিল বাবু। আমি যে ক’টা দিন আছি ততদিন একটু এ বাড়িতে থেকে গেলে হত না? ওই বাড়ি তো তোদেরই রইল।” মায়ের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা সুনন্দার চোখের ভাষা পড়ে নিতে অসুবিধা হয়নি আমার। বললাম, ‘তা আর হয় না মা। নিউটাউন থেকে আমাদের অফিস অনেক কাছে হবে। কাজে আরও মন দিতে পারব। আর্থিকভাবে আমরা আরও সুখী হই, এটা তো তুমিও চাও। চাও না বলো?’ মা চুপ করে থাকে।
মা বলেছিল, ‘লতি পাতুড়ি খেতে কি ভালোবাসতিস তুই! কচুর শাক। পাতলা করে মুগের ডাল। সরপুঁটি মাছ সর্ষে দিয়ে করলে আরেকটা চাইতিস। মন ভরে যেত বাবু। বউমা তো এগুলো কিছুই শিখল না।’
সুনন্দা ঝাঁঝিয়ে বলে উঠেছিল, ‘মা, আপনার বয়স হয়েছে তো। তাই জানেন না। যে খাবারগুলোর কথা বললেন, অ্যাপ দিয়ে বুক করলে দশ মিনিটে আমাদের বাড়ির সামনে চলে আসে।’
মা বলেছিল, ‘বাবুর বালিশগুলো সপ্তাহে একদিন আমি একটু রোদে দিতাম। এখনও দিই। তোমরা অফিসে বেরনোর পরে। ওর ঘাড়ে খুব ব্যথা হত ছোটবেলায় জানো। বালিশ রোদে দিলে এই ব্যথাটা কমে।’
সুনন্দা বলেছিল, ‘আপনার রোগটা ভাল নয় মা। মাথাতেও হয়তো এফেক্ট পড়ছে এর। শান্ত থাকুন। আপনার ছেলে একজন সর্বক্ষণের আয়া রেখে দেবে। আপনি আরও ভাল থাকবেন। আমরা পালাচ্ছি না, মা।’
পজেশনের দিন, অর্থাৎ যেদিন ওয়ার্ল্ড ক্লাস লিভিংয়ের দরজা খুললাম আমরা, সেদিন আমাদের মধ্যমগ্রামের বাড়ির দরজা খুলেছিল বনানীদি। স্থানীয় আয়া সেন্টারে ফোন করে বলেছিলাম, ‘বেস্ট লোককে চাই। পেশেন্টের অবস্থা খারাপ। ক্রমশ আরও খারাপ হবে। তাই কোনওরকম কমপ্রোমাইজ নয়।’ বনানীদিকে সব কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর সেদিনই ঘরের কোণে ফিট করে দিয়েছিলাম একটা সিসি ক্যামেরা। মাকে বলেছিলাম, ‘‘আগে দিনে দু’ঘণ্টা দেখতাম তোমায়। এখন দেখব সারাদিন। কোনও চিন্তা নেই, মা।’’
সিসি ক্যামেরা যে বাচ্চা ছেলেটা ইনস্টল করতে এসেছিল, সে ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছিল এর ম্যাজিক। ক্যামেরাটা লাগানোর পর আমার আর সুনন্দার মোবাইলে একটা অ্যাপ লোড করে দিল। একটা ইউজার আইডি আর পাসওয়ার্ড দেওয়ার পরেই দেখলাম, মোবাইলের স্ক্রিনে এই ঘর। ঘরের মধ্যে আমরা। ছেলেটা বলল, ‘বিজ্ঞানের এ এক আশ্চর্য আশীর্বাদ স্যর। পেমেন্ট কি ক্যাশে না কার্ডে?’
নিউটাউনে আসার পর প্রথম কয়েক দিন মাকে ফোন করতাম রোজ, অন্তত তিন বার। সকাল আটটার সময় ফোন করে বলতাম, ‘এই তো দেখতে পাচ্ছি মা তোমাকে। চা খাচ্ছ বিস্কুট দিয়ে।’ দুপুরবেলা বলতাম, ‘এই তো বনানীদি ভাত বেড়ে দিয়ে রাখল তোমার টেবিলে। পেট ভরে খেও মা।’ সন্ধেবেলা বলতাম, ‘আমি জানি তুমি সিরিয়াল দেখছ এখন। মুড়িটা এত কম দিয়েছে কেন বনানীদি?’ মা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত।
এই নিত্যদিনের ফোনের ব্যাপারটা ক্রমশ কমে আসে। সুনন্দা বলত, ‘যখন দেখতেই পারছ কী করছে, তাহলে এত কথা বলে লাভ কী? একটা বয়স্ক লোককে বারবার উত্যক্ত করার কোনও মানে হয় না।’ সুনন্দার কথার মানে আমি ধরতে পেরেছিলাম।
ক্যামেরাটার মধ্যে মা কী খুঁজে পেয়েছিল, জানি না। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টেছিল ক’টা? দু’তিনটে হবে বড়জোড়। অ্যাপ অন করলেই দেখতাম, একদৃষ্টে ক্যামেরার দিকে চেয়ে আছে মা। সুনন্দা একদিন আমাকে এক অদ্ভুত স্ক্রিনশট পাঠিয়েছিল। সেদিন রবিবার ছিল। আমি মার্কেট ভিজিটে। দিল্লিতে। দেখি একটা কাঁসার থালায় সরু চালের ভাত আর দুটো সরপুঁটি মাছ সাজিয়ে হাতটা সামান্য উঠিয়ে ক্যামেরার দিকে চেয়ে রয়েছে মা। স্ক্রিনশটটা নেওয়া হয়েছে দুপুর দুটোয়। আমি ফোন করেছিলাম মাকে। বলল, ‘সোমবার কথা দিয়েছিলি আজ আসবি সুনন্দাকে নিয়ে। নিজের হাতে রান্না করেছিলাম বাবু। বউমা কাঁটা অত খেতে পারে না বলে একটা ভেটকিও করেছিলাম ওর জন্য।’ আমি বললাম, ‘কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলে তুমি ওইভাবে? আমি তো একটা স্ক্রিনশট পেয়েছিলাম শুধু।’ ওদিক থেকে কোনও উত্তর আসেনি। লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম। শুক্রবার তড়িঘড়ি আমার দিল্লির টিকিটটা হয়। জানাতেই ভুলে গিয়েছিলাম।
মায়ের এই ড্যাবড্যাবিয়ে চেয়ে থাকার ব্যাপারটা খুব ইরিটেটিং। মোবাইল থেকে লাইভ সিসিটিভির অ্যাপটা ইদানীং কম খোলার এটাও একটা কারণ। কখনও ইচ্ছে হলে দেখি। ক্যামেরার দিকে তাকানো ওই স্ট্রেট দৃষ্টি দেখে চোখ নামিয়ে নিই। মায়ের চোখগুলো দেখে মনে হয় বলতে চায় অনেক কিছু। আমার কাজের ডিস্টার্ব হয়। হয়তো কোনও কিছুর মধ্যে ডুবে ছিলাম অফিসে। দশ সেকেন্ড ওই চোখ দেখলেই মনটা ডেভিয়েট হয়ে যায় খুব। সুনন্দারও হয়তো একই জিনিস হয়। একদিন বলল, ‘বাবা গো। ওই মহিলার চোখের মণিগুলোর মধ্যে যেন এক্সরে মেশিনের ক্যামেরা ঢোকানো আছে। বডির ভিতরে ঢুকে যায় ওই দৃষ্টি। বেশিক্ষণ নিতে পারা যায় না।’ একটু থেমে বলল, ‘ডিস্টার্বিং, ডিজগাস্টিং।’
বাথরুমে যাওয়ার সময় মা ধপ করে পড়ে গেল যেদিন, অফিস থেকে একটু আগে বেরিয়ে বনানীদিকে কড়কেছিলাম। বললাম, ‘মা পড়ে যাওয়ার পরে তোমার আসতে এত দেরি হল কেন?’ বললাম, ‘তোমাকে কি ঘুমনোর জন্য মাইনে দেওয়া হচ্ছে? ঘাড় ধরে বের করে দেব।’ জানতে পারলাম, সিরিয়াল টিরিয়াল দেখা সব ছেড়ে দিয়েছে মা। বনানীদি বলল, ‘মাথার মধ্যে কী ঢুকেছে জানি না। ওই ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে সারাদিন বাবু আজ আসবি, বাবু আজ কি খাবি, কতদিন দেখি না তোকে বাবু– এইসব বকে। ওর ধারণা আপনি বুঝি সারাদিন মাকে দেখছেন, শুনতে পারছেন সব।’ জানতে পারলাম, দিনের মধ্যে তিনবার আমার মা ওই লেন্সটা মোছায় বনানীদিকে দিয়ে। মায়ের ধারণা, স্পষ্ট দেখতে পেলে খুশি হব আমি।
ডাক্তার দেখালাম। শুনলাম, কন্ডিশন ভালো নয়। ডাক্তারবাবু বললেন, ‘ওষুধগুলো নিয়মিত খেলে তো এতটা অবণতি হওয়ার কথা নয়।’ মা চুপ করে থাকে। আয়ার উপর ঝাঁঝিয়ে উঠি। উত্তর পাই না।
দিনকয়েকের মধ্যেই মা পড়ে যায় আবার। এবারে আরও বাজে ভাবে, মুখ থুবড়ে। বনানীদির চিৎকারে পাশের বাড়ি থেকে লোক ছুটে আসে। প্রতিবেশীর ফোন পেয়ে আমি গাড়ি নিয়ে ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই হাজির হয়ে যাই। পাশের বাড়ির লোকটা বলল, ‘কাকে রেখেছেন ভাই আয়া হিসেবে? মাসিমা যখন পড়ে গেল, ম্যাডাম তো তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনালাপে ব্যস্ত ছিলেন।’ উত্তরে বনানীদি ঝাঁঝালো, ‘একদম মিথ্যে কথা। হাতে লাঠি নিয়ে গলাটা জিরাফের মতো উঁচু করে ওই ক্যামেরার ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন ওই বুড়ি। পাগলির মতো বলছিলেন, আরেকটু কাছে যাই। আরেকটু ক্লিয়ার দেখবে আমায়। এমনটা উনি করেন রোজ। আজ টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গিয়েছেন।’ আমি গর্জে উঠে বললাম, ‘ক্যামেরার ফুটেজ দেখলে সব পরিস্কার হয়ে যাবে বনানীদি। তোমায় পুলিশে দেব কিন্তু।’ এই বাগবিতণ্ডার মধ্যে ভাইস প্রেসিডেন্টের হোয়্যাটসঅ্যাপ আসে। স্পষ্ট লিখে দিয়েছে, এ মাসের মতো টেরিবল পারফর্মেন্স হতে থাকলে যেন অন্য রাস্তা দেখে নিই। একটা অ্যাসাইনমেন্ট সাবমিট করার কথা ছিল আজ। ওটাও মিস হয়ে গেল।
মায়ের উপরে ঝাঁঝাই এবারে। চিল্লিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘পাশের বাড়ির লোকটা কি সত্যি বলছে? এক হাতে লাঠি নিয়ে তুমি যেটা করছিলে সেটা কি সত্যি? তুমি তো মরে যেতে আজকে।’ মায়ের চোখ থেকে অশ্রুধারা নেমে আসে ফের। সুনন্দা হোয়্যাটসঅ্যাপ করল, ‘হোপ অল ওয়েল। জাস্ট টু রিমাইন্ড, আজ কিন্তু রাত সোয়া আটটার শোয়ের দুটো টিকিট কেটে রেখেছিলাম আমরা। তাড়াতাড়ি চলে এসো।’ মা বলল, ‘এসেছিস যখন কিছু খেয়ে যা বাবু।’ আমি বললাম, ‘আরেক দিন।’
বনানীদিকে বললাম, ‘মাকে নিয়ে ড্রইংরুমে যাও। আমার কিছু কাজ আছে এই ঘরে।’
দরজাটা বন্ধ করে দিই। চেয়ার নিয়ে চলে যাই ঘরের কোণায়। সিসি ক্যামেরার সঙ্গে লেগে থাকা তারটা কুট করে কেটে দিই।
দরজা খুলি। বনানীদিকে বললাম, ‘পেন ড্রাইভে করে সব ফুটেজ নিয়ে নিয়েছি। যদি ভালোভাবে কাজ না করো, মাকে অবহেলা করো, পুলিশে দেব। লাস্ট ওয়ার্নিং।’
মাকে বললাম, ‘চব্বিশ ঘণ্টা তোমার উপরে নজর রাখছি মা। একদম চিন্তা করবে না।’
গাড়িতে যাওয়ার সময় সিসি ক্যামেরার অ্যাপটা খুললাম একবার। মেসেজ উড়ে এল ঝটিতি। ‘সরি, সামথিং ওয়েন্ট রং। কান্ট কানেক্ট।’
রাত আটটা দশ।
এত ঘন হয়ে আমরা আগে কখনও বসিনি মাল্টিপ্লেক্সে।
অলংকরণ: শান্তনু দে