রাত্রির আলোছায়া ঘেরা শহরের রাজপথে প্রতিমা বিসর্জনের সেই ছবি রূপকথার আমেজ বুনে দেয়। পটজুড়ে ঘন বাদামি অন্ধকার, জনতার আবছায়া ছাড়িয়ে দূরে এক ঝলক আলোর দ্যুতিময় প্রতিমার আভাস, বিসর্জনের শোভাযাত্রা দেখতে পথচারী মানুষের পাশাপাশি রাজপথের দু’-পাশে বাড়ির অলিন্দ থেকে, ছাদ থেকে ঝুঁকে পড়েছে উৎসাহী মানুষ। গগন ঠাকুরের এই ছবি চিরসত্য হয়ে আছে বিজয়ার দিনটিকে উপলক্ষ করে।
শরতের অমল কমলখানি প্রস্ফুটিত করে দেবী যখন আসেন, তখন দিকে দিকে জেগে ওঠে উৎসব। প্রস্তুতি শুরু তার কত আগে থেকেই। তোড়জোড় চলে কুমোরটুলিতে, খড়ের কাঠামোর ওপরে মাটির প্রলেপ মেখে ধীরে ধীরে ফোটে প্রতিমার রূপ। পটুয়াপাড়ায় শুরু হয় দেবীর চালচিত্র আঁকা পটের খসড়া। ওদিকে মালাকারদের ঘরে ঘরে সলমা-চুমকি-জরি গুছিয়ে নেওয়ার কাজ, এগিয়ে চলে শোলা দিয়ে দেবীর মুকুট আর গহনার সরঞ্জাম। কুমোরপাড়ার কাজ সারা হলে তাদেরই যে ভার দেবীকে সাজিয়ে তোলার। ভাবনা শুরু হয়, কোন নতুন নকশায় এবারে রচনা হবে দেবীর অলংকার। মাথার মুকুটে ময়ূর পেখমের নকশা না পদ্মের কলিকা দিয়ে হবে এবারের মূল ডিজাইন? না কি ঝাড়বাতির আলোর মতো জ্যামিতিক নকশায় হবে দেবীর মুকুট– চারদিকে সে এক সাজো সাজো রব!
প্রকৃতিও কি তখন নতুন চেহারায় সেজে ওঠে না? বর্ষার নবধারা জলে ধুয়ে-মুছে গাছের পাতারা আরও সবুজ, আরও সজীব। ঘনসবুজ শিউলি পাতার ফাঁকে জোনাকির মতো সাদা কুঁড়ির আভাস– যেন চমকে ওঠা আলোর ফুলকি! ফুলের ভারে নুয়ে আসে ছাতিমের ডাল, স্থলপদ্মের পাপড়িতে জাগে দুধে-আলতা রঙের আভা। আর আকাশের নীলকান্তমণি মেখলার সঙ্গে মিলিয়ে রুপোলি কাশের গুচ্ছ বুঝি জড়ির পাড় বসিয়ে দিতে চায়। শুধু এইটুকু? চঞ্চল কিশোরীর মতো জেগে ওঠে নবীন ধানের মঞ্জরী। দিগন্ত বিস্তৃত মখমলি কোমল সবুজ গালিচার ফাঁকে ফাঁকে সে যেন পান্নারঙে মিনে করা কারুকাজ। শরতের এই মোহনরূপের ছটা কবির কলমে কবিতা হয়ে ওঠে, সুরের ধারায় ভেসে যায় গান। এই অপূর্ব রঙের প্যালেট কি চিত্রীদের ডাক দিয়ে যায় না? বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবে প্রকৃতির বর্ণসমারোহ শিল্পীর চিত্তপটকে গভীর ভাবে স্পর্শ করে বইকি। তার চিত্রপটেও পড়ে রঙের নতুন আঁচড়।
শারদলক্ষ্মীর রূপমুগ্ধ শিল্পীদের পটে রঙের ছড়াছড়ি, পাশাপাশি দেবীর প্রত্যক্ষ প্রতিমাকে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন এমন চিত্রীর সংখ্যাও কম নয়। সেই আমলের গগন ঠাকুর থেকে সাম্প্রতিক কালের বিকাশ ভট্টাচার্য পর্যন্ত শিল্পীর ছবিতে দেবীর অনায়াস আনাগোনা। তবে কাজের ধরনে, বিষয়ের প্রেক্ষিত নির্বাচনে ফারাক আছে বইকি। কেউ পুরাণপুঁথি অবলম্বনে রচনা করেছেন দেবীর চিত্ররূপ, দেবীর ক্লাসিক রূপটি সেখানে প্রকাশিত। কারও ছবিতে বাংলা লোকগানের ঘরোয়া আখ্যান থেকে উঠেছে ছবির কল্পনা। আবার কোনও কোনও শিল্পী ছবির উপকরণ গ্রহণ করেছেন সাহিত্যের আধার থেকে। হিসেব করলে দেখা যাবে, নন্দলালের পটে দেবী দুর্গার ছবি আঁকা হয়েছে বোধহয় সবচেয়ে বেশি। কখনও কেবল রেখায়, কখনও বা রঙের বিচিত্রতায়। দেবী চণ্ডিকার অসুরদলনী রূপই সেখানে প্রধান। আবার বছরখানেক আকুল অপেক্ষার শেষে ছেলেমেয়ে-সহ আদরের মেয়ে উমাকে নদীর ঘাটে নৌকো থেকে নামিয়ে নিয়ে ব্যস্ত মা মেনকার ছবিও আছে। এমন ছবির সঙ্গে মিশেছে আপামর বাঙালি মায়ের আবেগ, রঙে-রেখায় সে যেন আগমনী গানের সুর। তবে লোকায়ত ভঙ্গিমায় ‘গণেশজননী’র সংখ্যা বেশি দেখা যায় যামিনী রায়ের পটে। ঝলমলে প্রাইমারি রঙের আস্তরণে সে-সব ছবি উজ্জ্বল হয়ে আছে। শিল্পী মুকুল দের ছবিতে যেন রবীন্দ্রকবিতার বর্ণনা। ছবির দিকে তাকালেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে– ‘আনন্দময়ীর আগমনে আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে/ হেরো ওই ধনীর দুয়ারে দাঁড়াইয়া কাঙালিনী মেয়ে’। ছবিতে বর্ধিষ্ণু গৃহস্থের খোলা দরজার মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে দুর্গাপ্রতিমা, আর দ্বারের পাশে এক ভিক্ষুণীর প্রসারিত হাত, এ ছবি গাঁথা আমাদের বৈভব আর দারিদ্রর চিরকালীন বৈপরীত্যে। ছবিটি দেখতে গিয়ে চকিতে একটা সাঁওতালি গানের কথা মনে পড়ে। ধনীর আনন্দের পাশে সে দরিদ্র প্রান্তিক মানুষের বেদনার উপাখ্যান। গানের বাণীকে অনুবাদ করলে যে ছবি ফোটে, তা খানিকটা এইরকম– বাবুদের বাড়িতে ধুমধাম করে দুর্গাপুজোর আয়োজন চলেছে। সেখানে ঠাকুর দেখতে এসেছে একদল সাঁওতালি মেয়ে। প্রতিমার দিকে তাকিয়ে তাদের মনে হচ্ছে, সবাই সেখানে শাড়ি-গহনা-মুকুট আর চালচিত্রের আলোতে ঝলমল করছে। কেবল একটি কালো মানুষ যেন বড় অসহায়, মাটিতে পড়ে আছে সকলের পায়ের কাছে। সবাই মিলে তাকে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করতে উদ্যত। কিন্তু কেন এমনটা হল? ওই কালো ঈষৎ খর্বকায় অর্ধনগ্ন পুরুষটি তো তাদেরই মতো প্রান্তিক মানুষ, সাঁওতালি ভাষায় ‘মাঝি’! সে কি তবে বাবুদের বাড়িতে এসে ভুলক্রমে বাবুদের মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিল? সুন্দরের দিকে তাকানোর অপরাধে কি এই শাস্তি– সবাই মিলে ঘিরে ধরে তাকে এমন আঘাত করে চলেছে? সে গানের সেই ভাষা অনেকটা এমনই,– ‘ওরে মাঝি, কেন তুই বাবুদের আঙিনায় এসেছিলি? কেন তাকিয়েছিলি বাবুদের বিটিছিলাদের দিকে? দেখ, তোর কেমন শাস্তি হল! তোর বুকে শুধু বল্লম বিঁধিয়েই এরা ক্ষান্ত হয়নি। তোর দিকে বাঘ লেলিয়ে দিয়েছে, সাপ লেলিয়ে দিয়েছে! হায় রে মাঝি, তুই বাবুদের উঠোন থেকে বাইরে বেরিয়ে আয়’। আমাদের মহা-উৎসবের বিপরীতে এই সাঁওতালি গানের বিষাদ কেমন যেন আচ্ছন্ন করে তোলে। মনে হয়, এভাবে তো ভেবে দেখা হয়নি! আমাদের আনন্দ-বিনোদনের ওপিঠে ওদের বেদনার এই গান আমরা মন দিয়ে শুনেছি কি?
দুর্গাপুজোর আনন্দের আড়ালে আমাদের যে বেদনা, সে খানিকটা অন্যরকম। মাত্র ক’টা দিন কাছে পায়ে প্রাণপুত্তলীকে চালচুলোহীন জামাইয়ের কাছে না-পাঠানোর জন্য জননীর আকুল আবদার। নবমীর রাত্রিশেষে মায়ের বুকফাটা কান্না দিয়ে গাঁথা সে গানের বেদনাও বড় কম নয়। সে তো কন্যাকে একপ্রকার বিসর্জন দেওয়ার শামিল! বিজয়ার সেই বেদনাঘন ছবি চিত্রকরের তুলিতেও বার বার ধরা পড়েছে।
শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্যের ক্যানভাসে সে ছবি আমাদের বড় চেনা, দশমীর সকালে দেবীর চরণে সিঁদুর দিয়ে প্রণাম সেরে নিজেদের মধ্যে সিঁদুর খেলার অসাধারণ ছবি মনকে ছুঁয়ে যায়। পরাবাস্তবের আলোআঁধারিতে সেখানে মণ্ডপের সিঁদুর মাখা নারীই যেন সাক্ষাৎ দেবীপ্রতিমা! তবে প্রতিমা বিসর্জনের সেরা ছবি হয়তো রচিত হয়েছে গগন ঠাকুরের চিত্রপটে। রাত্রির আলোছায়া ঘেরা শহরের রাজপথে প্রতিমা বিসর্জনের সেই ছবি রূপকথার আমেজ বুনে দেয়। পটজুড়ে ঘন বাদামি অন্ধকার, জনতার আবছায়া ছাড়িয়ে দূরে এক ঝলক আলোর দ্যুতিময় প্রতিমার আভাস, বিসর্জনের শোভাযাত্রা দেখতে পথচারী মানুষের পাশাপাশি রাজপথের দু’-পাশে বাড়ির অলিন্দ থেকে, ছাদ থেকে ঝুঁকে পড়েছে উৎসাহী মানুষ। রহস্যের আবছায়া ঘেরা চিত্রপটের প্রায় কেন্দ্রভূমিতে সোনালি আলোর আভাসে ফুটেছে প্রতিমার মায়াবী অবয়ব। অনবদ্য সে ছবি! গগনের ছবি বরাবর আলো-আঁধারের রূপকথা রচনা করে। আরেকটিতে প্রতিমা বিসর্জনের পূর্ব মুহূর্ত। ঘন অন্ধকার পটে গঙ্গার বুকে নৌকায় ভাসানো হয়েছে প্রতিমা। স্নিগ্ধ ম্লান আভায় আঁকা ছবিতে আলোকের সঙ্গে মিশে আছে বেদনার অশ্রুবিন্দু। সে অশ্রু যতটা শিল্পীর অন্তরের, ঠিক ততটাই দর্শকের।