অন্নদাশঙ্কর রায় পাঠকদের ভাবতে শেখাতে, তর্ক করতে শেখাতে চেয়েছিলেন। তাই কথায় বা লেখায় তাঁকে স্বরগ্রাম উঁচু করতে হত না; বিপরীত পথকে বুঝতে চাইতেন, বোঝাতে চাইতেন প্রসারিত স্থৈর্য নিয়ে; লাবণ্যময় দৃঢ়তায় ভরপুর থাকত তাঁর আলাপন। সত্যান্বেষণ তাঁর অন্বিষ্ট। পৌঁছতে চান সত্যে, যে সত্যে পৌঁছলে তার্কিকদের মধ্যে কোনও এক পক্ষ জিতে যায় তা নয়, জিতে যায় শুধু সত্য, সত্যের বোধ। পাঠকের কাছে তিনি পৌঁছে দিতে চেয়েছেন তাঁর ‘আমি’কে নয়, অনুভূত এক সামগ্রিক সত্যকে।
২৮ অক্টোবর, ২০০২ শতায়ু স্পর্শের অল্প কিছু সময় আগেই অন্নদাশঙ্কর রায় চলে গেলেন হেমন্তের বিষণ্ণ অপরাহ্নে…
তখন বিনু সূর্যাস্তের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। শরীর অপটু, মন অবসন্ন। বিনু রোমন্থন করে, ‘মুক্তা নেই, আছে গুটিকতক নানারঙের ঝিনুক। সাগরতীরে বসে বসে বালুর ঘর গড়েছে আর এইসব কুড়িয়েছে বিনু। সেই বালুর ঘরেও ভাঙন ধরেছে। আর সেই সব ঝিনুকও ক্রমে ফুরিয়ে আসছে। তা হলে বিনু, তুমি করলে কী!’
বিনুর এই নানা রঙের ঝিনুক আগামীর জন্য রয়ে গেল। এই ঝিনুকের ভেতর ভরা থাকল একটি মনের প্রেম, একটি মনের ধ্যান, একটি জীবনের স্বপ্ন।
অন্নদাশঙ্কর রায় নিজেই বলেছেন ‘আমার মধ্যে অনেকগুলি ব্যক্তি একসঙ্গে বাস করছে’। বিনুর সাধনা রসমোক্ষণের, তাই তার অন্তিম সোপান রসমোক্ষ। কবে সেখানে পৌঁছবে, আদৌ পৌঁছবে কি না কেমন করে জানবে! কিন্তু সেই তার পথ, নান্যঃ পন্থাঃ। পরবর্তী বয়সে আবার সে সংশয়ে পড়েছে, আলো হারিয়েছে, আলেয়ার দিকে চলেছে, কিন্তু মার্গভ্রষ্ট হয়নি, ঘুরে ফিরে মার্গস্থ হয়েছে।
বিনু খুঁজছিল জীবনযাপনের বিভিন্ন ধারা। জীবন তার সামনে পথ খুলে দিয়েছিল। পরাধীন ভারতবর্ষে আয়োজিত প্রথম ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সফল পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়। যাঁর মনে প্রবল স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা, তিনিই কিনা রাজার আমলা হবেন! প্রবল দোটানার মধ্যে সিদ্ধান্ত নিলেন বিচারবিভাগে কাজ নেবেন। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নিজেই বলেছেন তাঁর মধ্যে ‘একজন আছে যে ন্যায় অন্যায় তৌল করে কোনটা রাইট কোনটা রং। সে বিবেকজর্জর। আরও একজন আছে যে ম্যান অব অ্যাকশন। সরকারি চাকরিতে সে ধাঁ দৌড় করেছে, অল্প সময়ের মধ্যে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সব সিদ্ধান্তই যে ঠিক তা নয়, তবে কাউকে গুলি করে মারতে বা ফাঁসিতে ঝোলাতে হুকুম দেয় নি।’ তারপর একদিন দেশ স্বাধীন হল, স্বপ্নভঙ্গের গভীরতর এক বেদনাবোধে অপরিমেয় সুখ, ঐশ্বর্য, ক্ষমতার অলিন্দ ছেড়ে অন্নদাশঙ্কর রায় স্বাধীন ভারতের আমলাতন্ত্র থেকে স্বেচ্ছাঅবসর নিলেন। মানুষের জীবনের সর্বপ্রধান ঘটনা আপনাকে পাওয়া। আত্মপ্রত্যয় ও ক্ষমতাবোধ নিয়ে বিনুর যাত্রা শুরু সাহিত্যপথে।
যুক্তি ও বুদ্ধিতে ভর করে প্রজ্ঞায় উত্তীর্ণ অন্নদাশঙ্কর রায় স্বাধীনতার বছর তিনেকের মধ্যেই অনুভব করেছিলেন আগামী ভারতকে অনেকগুলো সংকটের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। যার মধ্যে প্রধানতম সংস্কৃতির সংকট আর শিক্ষার সংকট। এই দুই সংকটের মোকাবিলায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের মন্ত্র – ‘সেকুলারিজম’ আর ‘খোলা মন খোলা দরজা’।
অন্নদাশঙ্কর বিশ্বাস করতেন সেকুলার রাষ্ট্রের বুনিয়াদ হবে প্রজাশক্তির অভ্যুদয় ও সব প্রজার সমান অধিকার। ধর্ম ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার, তাঁদের ব্যক্তিজীবনের পালনীয় বিষয়; রাষ্ট্রের নয়; রাষ্ট্র প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন পৃথক ও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান।
তবে বিশ্বাস বিষয়টাও বেশ গোলমেলে। মননের জগতের বাইরে বেরিয়ে এসে মানুষ যদি তাঁর বৌদ্ধিক সম্পদ শেষ পর্যন্ত সমর্পণ করে যুক্তিমুক্ত বিশ্বাসবস্তুর কাছে, তাহলে জীবনের চলার গতি থমকে দাঁড়ায়। কারণ তাতে যুক্তির উপাদান হয়তো খারিজ হয়ে যায় না বটে, কিন্তু তার গুরুত্ব কমে যায়। যুক্তিপন্থী ভাবনার অভাবে বিশ্বাসের ছাতার তলায় বহু মিথ্যা ও অন্যায় দখল নেয়। অন্নদাশঙ্কর রায় বলেন যুক্তিপন্থা দিয়ে এই বিশ্বাসের মোকাবিলা সহজ হয় না; বিশ্বাসের লক্ষ্য থাকে ব্যাপক গ্রহণ ও দীর্ঘকাল ধরে প্রচলন। তাই যুক্তিপন্থাকে হাতিয়ার করে বিশ্বাসের অপপ্রয়োগ রোখা যাবে না। উপায়? অন্নদাশঙ্কর রায় বলেন ‘খোলা মন, খোলা দরজা’। জিজ্ঞাসা আর সন্ধানের মধ্য দিয়েই আত্মপ্রদীপ জ্বালাতে হবে। মেটিরিয়ালিস্ট দুনিয়ায় প্রেমের অভাব, সৌন্দর্যের অভাব, সত্যের অভাব অনুভূত হয়। অন্নদাশঙ্কর রায় এই অভাবের নাম দেন ‘অধ্যাত্মিক অভাব’, এই অভাব রিলিজিয়ন বা ধর্মবিশ্বাসের অভাব নয়। অন্নদাশঙ্কর রায় লিখছেন, ‘প্রত্যেক ধর্মই মানুষকে বিশ্বাস করতে বলেছে, তর্ক করতে বলছে না… আমার মতে অন্যলোকের কাছ থেকে বিশ্বাস ধার করার চেয়ে প্রকৃত সত্য কী তা জানার জন্য অনবরত প্রশ্ন করাই শ্রেয়।’ বাহুবলের সহায়তায় সংকটের মোকাবিলায় অন্নদাশঙ্করের আস্থা ছিল না; তাঁর বিশ্বাস ছিল মীমাংসায়– যুদ্ধে বা দাঙ্গায় নয়। মীমাংসা মানে দু’পক্ষের মন যাতে মানে। একতরফের মন মানলে তা মীমাংসা নয়; ‘ডিক্টেশন’। কিংবা তৃতীয় পক্ষে ‘রোয়েদাদ’, তাতে মীমাংসা হয় না।
অন্নদাশঙ্কর রায়ের কাছে উন্নত দেশ হল সেই দেশ, যে দেশের অর্থনীতি শিক্ষার ব্যয় বহন করতে সক্ষম। স্কুলের শিক্ষা হবে সর্বজনীন ও বিনামূল্যে লভ্য। কলেজের শিক্ষা হবে অধিকাংশের অধিগম্য কিন্তু বিনামূল্যে নয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা হবে অপেক্ষাকৃত কম ছাত্রের জন্য, তাদের বেশিরভাগই স্কলারশিপ পাবে। স্কুলের শিক্ষা অপরিপক্ব রয়ে গেলে ছাত্রদের অসুবিধার মুখোমুখি হতে হবে। ‘গায়ের জোরে ডিগ্রিলাভ করতে পারে, কিন্তু ডিগ্রিলাভ আর শিক্ষালাভ তো একই জিনিস নয়। ডিগ্রিলাভ করে তারা যে চাকরিবাকরির যোগ্য হবে এটা তাদেরই মনের মরীচিকা।’ অন্নদাশঙ্কর রায়ের দেখার দৃষ্টিতে ধরা দিয়েছিল এই উপলব্ধি– ‘আজ আমরা ছাত্রবিদ্রোহ দেখছি, কাল আমরা গণবিদ্রোহ দেখব।’
অন্নদাশঙ্কর রায় পাঠকদের ভাবতে শেখাতে, তর্ক করতে শেখাতে চেয়েছিলেন। তাই কথায় বা লেখায় তাঁকে স্বরগ্রাম উঁচু করতে হত না; বিপরীত পথকে বুঝতে চাইতেন, বোঝাতে চাইতেন প্রসারিত স্থৈর্য নিয়ে; লাবণ্যময় দৃঢ়তায় ভরপুর থাকত তাঁর আলাপন। সত্যান্বেষণ তাঁর অন্বিষ্ট। পৌঁছতে চান সত্যে, যে সত্যে পৌঁছলে তার্কিকদের মধ্যে কোনও এক পক্ষ জিতে যায় তা নয়, জিতে যায় শুধু সত্য, সত্যের বোধ। পাঠকের কাছে তিনি পৌঁছে দিতে চেয়েছেন তাঁর ‘আমি’কে নয়, অনুভূত এক সামগ্রিক সত্যকে। অনুভূতির এই সামগ্রিক রূপকে তিনি চিনেছিলেন রবীন্দ্র-দর্শনের মধ্য দিয়ে। শিল্প দিয়ে, জীবন দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন এক দেখার দৃষ্টি। ভেতরটাকে আমরা হারিয়ে ফেলি বলেই মানুষকে মানুষ বলে দেখতে পাই না, প্রকৃতিকে পাই না স্বচ্ছ প্রাকৃতিকতায়। অন্নদাশঙ্কর রায় দেশকালের মধ্যে থেকেও সবকিছুকে দেশকালের বাইরে থেকে দেখতে পান বলেই লিখতে পারেন ‘জাতপাত, সম্প্রদায়, ধর্ম তুচ্ছ। যদি মানবিক হই, মানবতাই প্রথম’… ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়, হোক তা হিন্দু মুসলিম, মানুষই হত্যা নয়, বিদ্বেষ নয়, মনুষ্যত্ব, মানবিকবোধও হত্যা।’
মানুষের স্বয়ংসংশোধিকা শক্তিতে বিনুর মতো বিনুর স্রষ্টারও অটল বিশ্বাস। একটা প্রজন্মের ভুল আর একটা প্রজন্ম সংশোধন করবে। বিনু তাই সদা জাগ্রত অতন্দ্র প্রহরী। আমাদের আজকের প্রজন্মকে এই অতন্দ্র প্রহরীর অবিরত ইশারাগুলোকে পড়তে হবে, বুঝতে হবে। জীবনকে দেখা মানে তার নির্ভার সুন্দরতাটুকুকে দেখা নয়; রূঢ়তাকে, সর্বনাশকেও চিনতে শিখতে হবে। তবেই নানা বৈচিত্রের ইশারাভরা বহুস্বরের সমগ্রতাকে স্পর্শ করা যাবে। শূন্য এ প্রান্তরে নির্জনে বৃদ্ধ বনস্পতির মতো দাঁড়িয়ে আছেন অন্নদাশঙ্কর রায়, আমাদের ছায়া দেবেন বলে। গাছ অপেক্ষা করে, আশ্রয় দেয়, কিন্তু জীববৈচিত্রকেই গাছের কাছে পৌঁছতে হয়…