শূন্য থেকে শুরু আমাদের শিল্পীদের জীবনে মাঝেমধ্যেই আসে, সামনাসামনি করতে হয়, আর সেই জন্যেই বোধহয়, বেশিরভাগ শিল্পীকেই আমি দেখেছি ইনসিকিওরড হয়ে যেতে, আর সেই ইনসিকিউরিটি তাদেরকে বাধ্য করে নিজের দর কমাতে, বাধ্য করে স্বার্থপর হতে, বাধ্য করে আমেরিকায় গিয়ে কোনওরকমে সাধারণ মানুষের মতো থেকে ও গ্রান্টেড হয়ে স্ট্যাচু অফ লিবার্টির সঙ্গে কয়েকটা ফোটোগ্রাফ নিয়ে ফিরতে। আমরা শিল্পীরা ভয়ে ভাবতে পারি না গতকাল যা করেছি, আগামী পরশুও তার ফল পেতে পারি।
৯.
অনেক কথা বলতে গিয়ে অনেক কথা চলে আসে। কথায় কথা বাড়তে থাকে, কমতে থাকে, কখনও সখনও মুহূর্তের জন্য শব্দশূন্য হয়ে যাই, থমকে যায় যেন সব কিছু। খানিক বাদে সম্বিত ফেরে। কী কারণে তখন যে ছোটবেলার একটা দুষ্টুমির কথা ভাবতে ভাবতে সে ভাবনা বদলে দেয় বাইপাস বা ভিআইপি রোডে বা একটা সুন্দর স্কাল্পচারকে ঢেকে দিয়ে থাকা ফ্লেক্সে জ্যোতিষী, নার্সিংহোম বা একটা কাউন্সিলরের ফোটোশপ করা দাঁত ক্যালানো ছবি, নিজেও বুঝতে পারি না। ভাবনার সঙ্গে ভাবনার প্যাঁচ খেলায় কোন ভাবনা ভোকাট্টা হয়ে যাবে, কোন ভাবনার মাঞ্জা ভালো কে জানে! একটা পুরনো দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ে গেল রুবির মোড়, ওরফে ডিসানের মোড় অধুনা রবীন্দ্রনাথবাবুর মোড়ের মাঝখানে আইল্যান্ডটাতে বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং লাগানোর কথা। আমি তখন ভাবছিলাম আগামী সংখ্যার লেখাটা কীভাবে শুরু করব– একটা লুঙ্গি পরা মানুষ, গেঞ্জিটা ভুঁড়ির একটু ওপরে উঠে গেছে, টলটল করছে তার পেলব মধ্যপ্রদেশ, তিনি ইন্সট্রাকশন দিচ্ছেন কোথায় কোথায় আইল্যান্ডটার রেলিংয়ের ফাঁক আছে। আর সেই ফাঁকের মধ্যে ঠুসে দেওয়া হচ্ছে একটা কারও বিজ্ঞাপন। একটু পাশেই বড় বড় আলোকবর্ণ বলছে ‘আমার ভালোবাসার ১০৮…’ বাকিটা পড়তে পারার আগেই সবুজ হয়ে গেল আলো, পুরোটা পড়তে পারলাম না। দুর্দশার ভাবনা থেকে কীসব ভাবতে শুরু করলাম, বাইপাসের রেলিংয়ে লেখা হার্ট অ্যাটাক, ক্যানসার, ডাক্তার সাজা মডেলদের মিষ্টি মিষ্টি ছবি। মনে পড়ল বাপি বলত, ‘ডাক্তার হতে হবে শিলু, ডাক্তার হতে হবে।’ মনে পড়ল ছেলেকে বলতাম ওর ছোটবেলায়, পারবি মুখ্যমন্ত্রী হতে, বাবি প্লিজ বড় হয়ে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করিস। এলোমেলো হয়ে গেল, আমি কলকাতায় ফিরছি আমার শহর আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে আমার মাঝরাতে হার্ট অ্যাটাক হলে নিশ্চিন্ত থাকতে, রেলিংয়ে রেলিংয়ে ফোন নাম্বার, আমি কি নম্বরটা টুকে রাখব? আমার মতো আরও কত মানুষ গাড়িতে, বাইকে, ভ্যানে, হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে, তাদেরও ওই সমস্ত নিশ্চয়ই মনে পড়ে যাচ্ছে– তার ক্যানসার হতে পারে, তার বাড়িতে নিশ্চয়ই বৃদ্ধ বাবা-মা, কিংবা কচি ছেলে আছে, সে হয়তো একজন খেটে খাওয়া মানুষ অথবা একজন নেতা বা কবি বা শিল্পী, তারাও আমার মতো ভয় পাচ্ছে, খারাপ লাগছে, ভুলে যাচ্ছে, আবার মনে পড়ে যাচ্ছে তাদের কাজের কথা। আমারও মনে পড়ে গেল, আমিও ভয় পেলাম, ভুলেও গেলাম।
আমার মুম্বইতে শোয়ের আগের দিন থেকে শুরু হল বৃষ্টি। সে বৃষ্টি তুমুল হল মাঝরাতে। শো-এর দিন সকাল থেকে তা জারি রইল, থামল না। কখনও ঝিরিঝিরি, কখনও ঝমঝম।
সাউন্ড চেকের সময় চেম্বুরের পুজো প্রাঙ্গণে পৌঁছে দেখলাম হাঁটু জল। জল আর জল, গান শোনার কেউ নেই। সভাপতি, সম্পাদক আর বোধহয় ক্যাশিয়ার ছাড়া কাউকে দেখতে পেলাম না। সাউন্ড চেক করতে করতে কিছু মানুষ এল বটে, তবে আমরা মঞ্চে যতজন ছিলাম, তার থেকে খুব বেশি নয়। তার মধ্যেই আমাকে শো করতে হল। আমি ওঁদের বলেছিলাম, আমি পরের দিন থেকে গিয়ে শো-টা করতে পারি, আমার অসুবিধে নেই। শ্রোতা-দর্শক ছাড়া গান গাওয়া যে কী যন্ত্রণা ওঁদের বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু ওঁরা রাজি হলেন না। কারণ পরের দিন ওঁদের যে অনুষ্ঠানসূচি তৈরি করা আছে, সেটা ঘাঁটা যাবে না। অগত্যা সেদিনই গাইলাম। তখনও পর্যন্ত জীবনের সব থেকে বেশি মূল্য পাওয়া অনুষ্ঠানে দারুণ মূল্য পেলাম, কিন্তু শ্রোতা পেলাম না। সে যন্ত্রণা নিয়ে যখন হোটেলে ফিরলাম, তার থেকেও বড় দুঃসংবাদটা পেলাম তবে সে রাতে নয়, পরের দিন সকালে।
শিলালিপি-র পর্ব ৮: শিলাজিৎ মুম্বইতে কী হারাবে পাগলা, মুম্বই হারিয়ে ফেলতে পারে শিলাজিৎকে
অনর্গল বৃষ্টির কারণে বিস্তীর্ণ একটা এলাকা জুড়ে রেলপথ চলে গেছে জলের নীচে, ফেরার ট্রেন ক্যানসেল, এবং কবে টিকিট পাওয়া যাবে তার কোনও নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। আমার আর আমার দলের একজনের ফ্লাইটের টিকিট ছিল, কিন্তু বাকিদের ট্রেনে ফেরা, এবং পুজোকমিটি তাদের ট্রেনের বদলে প্লেনের টিকিট কেটে দিতে পারল না বলে আমার পাওনা অর্থ থেকেই কাটতে হল ফেরার টিকিট।
১৯৯৫ সাল থেকে ২০২৩– এই ৪৩ বছরে টমেটো, পেট্রল, চাল, মুড়ি, মদ সবেরই দাম বেড়েছে, মন্ত্রী, এমএলএ-দের মাইনেও বেড়েছে, শুধু প্লেনের ফেয়ার বোধহয় বাড়েনি। সময় অনুপাতে কমেছেই মনে হয়। আমার প্রাপ্য টাকা, যা দিয়ে ভেবেছিলাম এক বছরের সংসার চালাব, তার থেকে আমাদের ফ্লাইটের টিকিটের খরচা দেওয়ার পর হাতে পেনসিলের থেকে আর কিছু বেশি ছিল। বাকি ব্যান্ড মেম্বারদের বোম্বেতে একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে রেখে আসাটা আমার পক্ষে কোনও দিন সম্ভব হত না, সেদিনও হয়নি। কলকাতা ফিরেছিলাম, শুরু করেছিলাম আবার শূন্য থেকে প্রায়।
এরকম শূন্য থেকে শুরু আমাদের শিল্পীদের জীবনে মাঝেমধ্যেই আসে, সামনাসামনি করতে হয়, আর সেই জন্যেই বোধহয়, বেশিরভাগ শিল্পীকেই আমি দেখেছি ইনসিকিওরড হয়ে যেতে, আর সেই ইনসিকিউরিটি তাদেরকে বাধ্য করে নিজের দর কমাতে, বাধ্য করে স্বার্থপর হতে, বাধ্য করে আমেরিকায় গিয়ে কোনওরকমে সাধারণ মানুষের মতো থেকে ও গ্রান্টেড হয়ে স্ট্যাচু অফ লিবার্টির সঙ্গে কয়েকটা ফোটোগ্রাফ নিয়ে ফিরতে। আমরা শিল্পীরা ভয়ে ভাবতে পারি না গতকাল যা করেছি, আগামী পরশুও তার ফল পেতে পারি। আমাদের কাছে বিজনেস ক্লাসের টিকিট চাওয়াটা মনে হয় বাতুলতা, অনেক অর্গানাইজার প্রশ্নও করে আপনার বিজনেস ক্লাসটা কীসের জন্য দরকার? আমি তো আজ পর্যন্ত বিদেশ যেতেই পারিনি, কারণ আমার উত্তরটা বড্ড বাজে হয়, আমি বলে ফেলি বিজনেস ক্লাসটা আছে বলেই দরকার। বিজনেস ক্লাসটা আছে কাদের জন্য, শিল্পীরা তাতে যদি না যায়, যদি কবি, সাহিত্যিক, খেলোয়াড়রা ওই স্বাচ্ছন্দ্যটুকু না ভোগ করে, তাহলে কারা সেই ভোগের ভোগী হবে বাওয়া! আমরা বাংলাতে গান গাই বলে ইকোনমিতে জড়সড় হয়ে বসে ১২/১৪ ঘণ্টার ফ্লাইটে যাব লন্ডন, আমেরিকা?
শিলালিপি-র পর্ব ৭: চাকরি ছাড়ার পরদিন দেরি করে ঘুম থেকে উঠেই চিৎকার– ‘আমি আর টাই পরব না’
‘এইসব কী বলছেন শিলাজিৎ, মুখে আসে কী করে?’ বাংলাতে গান গেয়ে, দু’চারটে শো পেয়ে, বছর তিরিশেক বাংলা বাজারে টিকে আছেন বলে এত বড় বড় কতা, শুরু করো ব্যাটা তাহলে শূন্য থেকে। কোথায় একটু অ্যাডজাস্ট করলেই এতগুলো ডলার হয়ে যায়– এতগুলো ডলার পেলে তো কলার তুলে ঘুরে বেরাব ভাই। এতগুলো পাউন্ড মানে কতগুলো টাকা বলো তো, কত কত টাকা– মাল্টিপ্লাই মাল্টিপ্লাই–
দেখুন দাদা টাকার দাম বাড়াতে পারব না, সংসদীয় রাজনীতি করতে পারব না, আমার দেশের খেটে খাওয়া মানুষদের দৈনিক পারিশ্রমিক বড় বড় পার্টিরাই বাড়াতে পারল না এতদিনে, স্বাধীনতার পর এত বছর চলে যাওয়ার পরও একটা ভাঙা স্কুলের একটা ঘর ঠিক করতে পারল না আমাদের শক্তিশালী পার্টিগুলো, আমি কে হরিদাস পাল। আমি আমার দখলে, আমি আমার কবলে, সুতরাং আমি আমার খেয়ালেই চলব, আমি আমার দর বাড়াব, আমি আমার বাড়ির কাজের লোকের দর বাড়াব, যাতে তারা বুঝতে পারে তাদের বাকিরা কম দিচ্ছে। আর আমার দর বাড়াব, কারণ আমার পরবর্তী জেনারেশনের শিল্পীদের, নতুন প্রজন্মকে আমার দরের দোহাই দিয়ে, উদাহরণ দিয়ে যেন কেউ কম দর দিতে না পারে, এটুকুই। আর তাতে বারবার শূন্য থেকে শুরু করতে হলেও রাজি আছি।