‘মণীন্দ্র গুপ্তের জগৎ’ বইটি লিখতে গিয়ে চিরন্তন সরকার মণীন্দ্রবাবুকে বিশ্লেষণ করার, তাঁর মর্মপটে প্রবেশ করার উপায় হিসেবে পেয়েছেন এই জল-মাটি-বাতাসের প্রতিনিধিদের। পেয়েছেন স্মৃতির অন্বয়, রিপুর অবসন্ন প্রান্তর। আর কোনও সাহিত্য কর্ম করা মানুষকে এভাবে খোঁজার চেষ্টা হয়েছে কি?
এরকম বলা হয়, জীবন বেঁচে থাকার ভ্রম। একটা মাছের যেমন দু’পিঠ জুড়ে মাংস থাকে, আর তাকে ভাজার পর উল্টেপাল্টে খেতে হয়, তেমনই নেতিবাচক-ইতিবাচক আখ্যানের ঘূর্ণিপাকে, জীবন একইসঙ্গে হয়ে আছে মৃত্যুর উপহারও। আমি কে, এবং কতটুকু– শরীরের ট্যানজিবল থাকা এবং মনের ইনট্যানজিবল অবস্থানের ভেতরে এক চৈতন্য খেলা করে বেড়ায়। এ আর নতুন করে বলার কিছু নয় যে, মানুষের শরীর পৃথিবীর বিভিন্ন এলিমেন্ট দিয়েই গড়া। তবু, মনের নাগাল এক প্রতীয়মান অথচ বিচ্ছিন্ন মুক্তগ্রহ, যার কোনও কক্ষপথ নেই, নির্দিষ্ট নক্ষত্রও নেই। সে কেবল আলো ধার করে বেড়ায়, আলো খায়, আবার কখনও কখনও নিজেই আলো হয়ে ওঠে।
যেহেতু মানুষ চলে যাওয়ার পরেও, তার চির-অনুপস্থিতির স্বর এত আধুনিক কালে এসেও মানবজাতিকে এখনও ধাতস্থ হতে দেয় না, যেহেতু মস্তিষ্কের ভিতর সমস্ত মৃত্যু বেঁচে-বর্তে থাকে আর হাঙ্গামা করে, তাই মৃত্যু-পরবর্তী যা কিছু সৎকার ক্রিয়া, সেখানে লেপ্টে থাকে ফিরে আসার বিবিধ কূটকল্প। যে যতই অবিশ্বাসী হোক, তার ভিতরে এক লুকোচুরির খেলা চলে। এই খেলাকে আমরা খুব ঘনিষ্ঠজনের ক্ষেত্রে স্বীকার না করে পারি না, আর খবরের পাতায় মৃত্যুকে নতুন কোনও খবর দিয়ে চাপা দিলেও মৃদু এক নাতিশীতোষ্ণ হাওয়া ঘুরঘুর করে চলে। আমরা তা বিভিন্নভাবে অস্বীকার করার চেষ্টা করি, ফ্যানের হাওয়া বাড়িয়ে দিই। কখনও বা রোদের কাছে ছুড়ে দিই নিজেদের। আর আমাদের তাই ভয়ও করে চলে যাওয়ার, পিছুটান, মায়ায় আমরা ঘর গরম করে রাখি।
কিন্তু মণীন্দ্রবাবু এরকম কোনও অস্বীকারের খেলায় থাকেননি। পৃথিবীতে প্রতি বছর নাকি ১০ হাজার প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তাদের কিছু কিছুকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে কিছু মানুষের। পৃথিবীর বিভিন্ন কিছু দেখার, ভিন্ন এক সময় কাটানোর সুযোগ পায় মানুষ এবং সেই সৌভাগ্য সে লালন করে। তেমনই মণীন্দ্র গুপ্ত একটি প্রজাতির একমাত্র স্পেসিমেন, যাঁকে দেখার, যাঁর সঙ্গে কথা বলার, আত্মীয়তা তৈরির সৌভাগ্য হয়েছে কিছুজনের। এবং ২০১৮-র ৩১ জানুয়ারি, সেই সৌভাগ্য বিলুপ্ত হয়েছে চিরতরে। তিনি কোনও কবি, না কি লেখক, না কি মহৎ মনীষী– এসব তিনি ভাবার ফুরসত পাননি। মানুষকে যেমন কঠিন সময়ে মুখে রক্ত তুলে পেট চালানোর ব্যবস্থা করে, বেঁচে থাকার তীব্র সংগ্রাম চালায়, মণীন্দ্রবাবু এই পৃথিবীতে দেখতে দেখতে চোখ লাল করে ফেলেছিলেন। চোখের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় দৃশ্যর জমাট পরিশ্রম, শান্তি ও নির্লিপ্তি তিনি বহন করতেন তাঁর চেয়ে থাকায়। তাঁকে অসুস্থ যে ভেবেছে, সে বোঝেনি, স্বয়ং প্রকৃতির এক জ্যান্ত অংশ মণীন্দ্র গুপ্ত হয়ে মানুষের রূপে আমাদের সঙ্গে বাংলা ভাষায় যোগাযোগ করছে মাত্র। এবং থার্মোডাইনামিক্সের সুনির্দিষ্ট কেওস একদিন এই রূপ টুক করে কেড়ে নেবে। মণীন্দ্রবাবু এই সমস্তই জানতেন বলেই, সম্ভবত, তাঁর লেখালিখিকে কবিতা, গদ্য, উপন্যাস– এসব বলা যাবে না। তিনি কমিউনিকেট করে গিয়েছেন এই মহাজগতের প্রতিটি কণার সঙ্গে অবিরাম, কালরহিত সেই কথা চালাচালি।
তাই তিনি কোন সময়ে, কোন বয়সে কী লিখছেন– তা ধরা যায় না। ধরা যায় না বলেই, ‘মণীন্দ্র গুপ্তের জগৎ’ বইটি লিখতে গিয়ে চিরন্তন সরকার মণীন্দ্রবাবুকে বিশ্লেষণ করার, তাঁর মর্মপটে প্রবেশ করার উপায় হিসেবে পেয়েছেন এই জল-মাটি-বাতাসের প্রতিনিধিদের। পেয়েছেন স্মৃতির অন্বয়, রিপুর অবসন্ন প্রান্তর। আর কোনও সাহিত্য কর্ম করা মানুষকে এভাবে খোঁজার চেষ্টা হয়েছে কি? হয় কালের বিন্যাস, নয় রাজনীতির উপাখ্যান সেখানে উঠে এসেছে। কিন্তু, মণীন্দ্র গুপ্ত এমনই ধুরন্ধর মহাজাগতিক কূটমালায় প্রবেশ করেছিলেন যে, তাঁকে, তাঁর রাজনৈতিকতায় উঁকি দিতে, তাঁর জীবনবোধে আঙুল ঠেকাতে গিয়ে তাঁকে প্রকৃতির খামখেয়ালে আশ্রয় নিতে হয়েছে। মণীন্দ্রবাবুর বিভিন্ন লেখা থেকে বেছে চিরন্তন সরকার আনতে চেয়েছেন আলাদা করে আকাশ, বাতাস, পাহাড়, সমুদ্র, ঘর-বাহির, বয়স-বিন্দু, স্মৃতি ও অতীত। পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাওয়া একমেবাদ্বিতীয়ম্ মণীন্দ্র গুপ্তকে একত্র করার তীব্র প্রয়াস রেখেছেন তিনি এই সন্দর্ভে। মণীন্দ্র গুপ্তকে যাঁরা পড়বেন, যাঁরা মণীন্দ্র গুপ্তর আশ্রয় নেবেন, বা মণীন্দ্র গুপ্তর নাম প্রথম শুনছেন যাঁরা, এই বই হতে পারে পুজোর আগে সেই প্রস্তুতিটি, যেখানে রেকাবিতে আছে দু’টুকরো বিল্বপত্র, একমুঠো দুব্বো, চার-পাঁচটা গাঁদা, ছ’-আঙুল চন্দনবাটা, পাশে আছে এক ঘড়া গঙ্গাজল, এক অনুবন্ধ হোমযজ্ঞের জন্য একখান দেশলাই বাক্স। সম্পূর্ণ গাছ নয়, মাঠ নয়, আকাশ নয়, আগুন নয়, নয় এমনকী প্রার্থনা শোনার মতো ঈশ্বরের প্রাণ। উপকরণ মাত্র। মণীন্দ্রবাবুকে খাবলে খাবলে না পড়া অবধি পৃথিবীপাঠ অধরা। যেখানে কিচ্ছু নেই, সেখানেও মণীন্দ্রবাবু আছেন।
একথা যতটা দুঃসাহসিক, ততটাই সে নিমগ্ন প্রাকৃত হয়ে আছে মণীন্দ্রবাবুর কাছে। ‘অপ্রাণ আনন্দচক্ষু’ দিয়ে তিনি যা দেখেছেন, তা লিখেছেন। সেই চোখ, যা নাকি প্রাণহীন, অথচ তার দেখার ফিল্টারি আনন্দের ভাল্ভ দিয়ে গড়া, দুঃখ সেখানে একান্ত বাইপ্রোডাক্ট মাত্র। এমন লেখার চোখ না হোক, অন্তত জীবন অতিবাহের চোখ আর বিবর্তনপথেও ফিরে আসবে কি? প্রশ্নটিকে আমাদের ধাওয়া করা উচিত, এই বই সেই আহ্বান দেয়।
কিন্তু, এহ বাহ্য, মণীন্দ্র গুপ্তধন মণীন্দ্র-তেই সক্রিয়ভাবে গোপন হয়ে আছে। সেই আগুনে হাত রাখার আগে এই বই আঁচের রোদ মাত্র।
এ দেশে প্রসূতিসদন থেকে নবজাত শিশু ও প্রসূতিকে ছেড়ে দেওয়ার পরও স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বেশ কয়েক মাস ধরে নিয়মিত একজন চিকিৎসক বাড়িতে এসে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যান। এটা ছিল এখানকার জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ।