টিংটিঙে চেহারার পাড়ার বন্ধু, যে একাধারে গোল এবং উইকেটরক্ষক, হঠাৎ ভ্যানিশ হয়ে যায় ঘুসঘুসে জ্বর আর খুকখুকে কাশি নিয়ে। আমরা ডিটেকটিভ নিয়োগ করি, সে চারআনার ঘুগনির শর্তে খোঁজ নিয়ে আসে– টিবি হয়েছে। আমাদের বিনিদ্র রজনীর শুরু। শুধু নিজেদের স্বাস্থ্য নয়, অন্য পাড়ায় পরের ম্যাচে কে কিপার হবে, তা নিয়ে চিন্তা। মাসখানেক বাদে বন্ধুটি যখন ফিরে আসে, আর খেলতে চায় না।
১২.
সুকান্ত সমগ্র যখন হাতে আসে, তখন আমার বয়স ওঁর প্রথম কবিতা প্রকাশের বয়সের কাছাকাছি। ভবিষ্যতে, যে বয়সে ওঁর কবিতা বুঝতে শিখব, সেই বয়সে ওঁর কলম থেমে গেছে। টিনএজ থেকে একুশ– মাত্র এই কয়েক বছরে তাঁর কবিতার ভাষার উত্তরণ আমার মনে গভীর দাগ কাটে। কিন্তু যা রক্তাক্ত করে আমার চেতনা, তা হল তাঁর মৃত্যু। একটি রোগ, যার কাছে ঘেঁষার সাহস হয়নি তাঁর বেশিরভাগ কমরেড বা আত্মীয়ের। এরপর যতবারই সামনাসামনি পড়েছি যাদবপুর টি বি হাসপাতালের, মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছি লজ্জায়। ছোটবেলায়, পারিবারিক এক অনুষ্ঠানে আলাপ হয় এক দূর সম্পর্কের পিসির সঙ্গে। তিনি আমেরিকায় একটি নামকরা ইউনিভার্সিটিতে অঙ্কের প্রফেসর। ভাবি, আমারও তো অঙ্ক ভালো লাগে। বড় হয়ে ওঁর কাছে চলে যাব। সে গুড়ে বালি। ফেরার পথে বাবা-মার কথা শুনে বুঝতে পারি, ওঁর হাতে বেশি সময় নেই। বোন-টিবি ধরা পড়েছে। মার্কিন দেশের ডাক্তাররাও খুব একটা ভরসা দিচ্ছেন না। বাড়ি ফিরি, দিনের বেলা স্কুল যাই, বিকেলে খেলি ক্রিকেট, ফুটবল। টিংটিঙে চেহারার পাড়ার বন্ধু, যে একাধারে গোল এবং উইকেটরক্ষক, হঠাৎ ভ্যানিশ হয়ে যায় ঘুসঘুসে জ্বর আর খুকখুকে কাশি নিয়ে। আমরা ডিটেকটিভ নিয়োগ করি, সে চারআনার ঘুগনির শর্তে খোঁজ নিয়ে আসে– টিবি হয়েছে। আমাদের বিনিদ্র রজনীর শুরু। শুধু নিজেদের স্বাস্থ্য নয়, অন্য পাড়ায় পরের ম্যাচে কে কিপার হবে, তা নিয়ে চিন্তা। মাসখানেক বাদে বন্ধুটি যখন ফিরে আসে, আর খেলতে চায় না। আমরা আড়ালে তাকে ‘কিশোর কবি’ বলে ডাকতে থাকি। এরপর, সপ্তাহান্তের সন্ধেবেলা, সুখেন দাস টিবি-কে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন টিভি-র মাধ্যমে। ছবিতে তাঁর যখন তখন ওই রোগ ধরা পড়ে, মুখ দিয়ে রক্ত ওঠে। ওই ছবিতে দেখানো তিনি সমাজে একেবারে অচ্ছুত হয়ে যান। আমার বাড়ির লোক এবং পাড়া প্রতিবেশীরা কেঁদে ভাসিয়ে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে। এদিকে কালো-সাদা টিভিতে রংচঙে প্লাস্টিক স্ক্রিন লাগানো হয়েছে। তাতে রক্ত কখনও সবুজ, কখনও হলুদ বা নীল হয়ে যায়। লাল আর হয় না। তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হই, টিবি মানেই বদরক্ত।
পড়ুন ‘পাল্টি’র ১১ তম পর্ব: ডোমেরা জানে, আগুনের তর সয় না
আমার কিন্তু সেরকম কিছু হয় না। বছর বিশেক আগে, সেপ্টেম্বরে পুজো সেবার। প্যাচপ্যাচে গরম। মাঝে মাঝে দু’-এক পশলা বৃষ্টি ঘামে ইন্ধন জোগাচ্ছে। শহরে আলোর রোশনাই, আর আমার চোখে সরষে ফুল। কাঁপিয়ে জ্বর, হাঁপানি। অনেক টেস্ট করা হল। শেষে সবচেয়ে শস্তার এক্স-রে পরীক্ষায় ধরা পড়ল নিউমোনিয়া। ফুসফুসের ডান প্রকোষ্ঠ প্রায় দেখা যাচ্ছে না। অতএব হাসপাতাল, হাতে চ্যানেল, ড্রিপ, ইঞ্জেকশন, নাকে-মুখে অক্সিজেনের নল। ডাক্তার বললেন, ব্যাপারটা সুখেন দাস নয়। তাই কয়েকবার বায়োপসি। এইভাবে মাসখানেক। তারপর ছাড়া পেয়ে নাচতে নাচতে অফিস। সবাই বলল, বাঃ, অনেকটা ঝরে গেছ, ফিট লাগছে। রেস্তরাঁয় সেলিব্রেশন। সাত দিন যেতে না যেতেই পুনর্মূষিক। এবার অন্য হাসপাতাল, অন্য ডাক্তার। তাঁর মতে ব্যাপারটা ঘোরালো। ক্যানসার এক্সক্লুড করতে হবে যত্ন নিয়ে। নাক দিয়ে নল ঢুকিয়ে ফুসফুস ধুয়ে মুছে জল বের করে, সেই জল ল্যাবে পাঠাতে হবে যেখানে এক মাস ধরে কড়া নজর রাখা হবে– কর্কট বাড়ি আছ? এ এক অসহ্য অপেক্ষা! আর এই সময় আত্মীয়-স্বজনেরা উদ্বেল হয়ে ওঠেন। যাঁরা বাল্যকালের পর আমাকে আর দেখেননি, আর আমিও দেখা করার কোনও চেষ্টা করিনি, তাঁরাও কুশল সংবাদ নেওয়ার জন্য ঘন ঘন ফোন করেন। এদিকে সাবধানের মার নেই বলে আমি একঘরে। ‘কোয়ারান্টাইন’-এর মতো ওজনদার শব্দ তখন ব্যবহার হত না। শরীরে জোর নেই। বই বা খবরের কাগজ পড়লেও চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। তার ওপর প্রতি সপ্তাহে মেগা ব্লাড টেস্ট। অগত্যা একটা দুটো ফোন ধরে ফেলি। যতই হোক, সবাই শুভাকাঙ্ক্ষী–
–কী করে এরকম রোগ বাধালি রে সোনা? ধরাই পড়ছে না!
–ইয়ে মানে, আমি জানি আমার কী হয়েছে।
–কী হয়েছে? (ফোনের ওপারে চরম উৎকণ্ঠা)
–টিবি…
–ছি, ছি, এ কী বলছিস! এসব বলতে নেই… তোর কেন এরকম একটা বিচ্ছিরি অসুখ হতে যাবে… তাছাড়া কাশির সঙ্গে তো কিছু… (একটা সাবঅল্টারন টুইস্ট কানে বাজে)
–শোনো, টিবি না হওয়া মানে কিন্তু ক্যানসার। তুমি কোনটা চাইছ?
–হুম… আঃ কী যে বলিস… ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্য…
–হ্যালো… হ্যালো
ফোন কেটে যায়। বুঝতে পারি, সুকান্ত বা সুখেন হতে গেলে আরও সাধনা করতে হবে।