ভিড় থেকে বেরিয়ে নাগরিক আলোকবলয়ে আসতেই পারতেন নিবারণ পণ্ডিত। ছোটবেলায় অভিভাবক হারানো বিড়িশ্রমিক কিশোর, যে একটা বিশ্বযুদ্ধ দেখে ফেলেছে, যে যুবক দেখেছে জমিদার-মহাজনদের দুর্নীতি আর কালোবাজারির চক্রান্ত, তার ভাতের কষ্ট যে কত তীব্র, তার রাগ যে কত ধারালো, তা আন্দাজ করা অতিসংস্কৃত শহুরে বাবুদের পক্ষে কঠিন। বিশ্বাস করাও কঠিন, যে চিরকাল ওই সাধারণ ভিড়ের জন্যেই গান বাঁধলেন নিবারণ, এমনকী সেই ভিড় থেকেই তৈরি করলেন তাঁর গান গাওয়ার শিল্পীর দল।
পেটের কথা কেউ তো বলে না
পাকিস্তান হিন্দুস্তান পাইয়া রে
পেটে তো বোঝ মানে না হায় রে…
পেটের কথা সবারে জানাই
পেটপাগলারা মিলে একটি সমিতি বানাই
পেটের জ্বালা বড় জ্বালা রে
শুধু কথাতে পেট ভরবে না রে…
আমরা পেটস্থান দাবি ছাড়ব না…
লিখেছিলেন নিবারণ পণ্ডিত। আমাদের শিল্পজগতের বর্ণাশ্রমপ্রথা নিশ্চয়ই এই লেখাকে সোনার পইতে পরিয়ে বরণ করবে না। এই লেখার, এই গানের দাবিও তা নয়। এই গানের একান্ত আবাস মাঠঘাটে, চায়ের দোকানে, সবজিবাজারে, গমকলে। এই গানের বিস্ময়-আঘাত তার ইতিহাসের মধ্যে।
হিন্দুস্থান-পাকিস্তান বিভেদ ঘটতে দেখলেন এক মানুষ। এক কবি, গায়ক, রাজনৈতিক কর্মী, তার চেয়েও বড় কথা, একজন মানুষের সঙ্গে মিশে থাকা মানুষ। ধর্মপরিচয়ে হিন্দু, তবু থেকে গেলেন নিজের মাটিতে, পূর্ব-পাকিস্তান তখন তার নাম। সাম্প্রদায়িক বাহিনীর হাতে বারবার ভয়ানক অত্যাচারিত হয়ে ভিটে ছেড়ে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হলেন, কিন্তু সেকুলারিজমের ভূত ঘাড় থেকে নামাতে পারল না দাঙ্গামুখোরা। মানুষ যে পেটের ধর্মেই এক, এই বিশ্বাস কিন্তু কাড়তে পারল না কেউই, কোনও পক্ষই।
আরও পড়ুন: ডেলিভারি বয়, ইলেকট্রিক অ্যাপরেন্টিস থেকে ক্রিকেট বিশ্বকাপের মঞ্চ: ডাচ রূপকথায় নতুন পালক
১৯১২ সালে ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে জন্ম নিবারণ পণ্ডিতের। ছোট্টবেলায় বাবার মৃত্যুতে লেখাপড়া ছেড়ে বিড়ি-কারখানায় কাজ নেওয়া। নিজেও বিড়ির ব্যবসা শুরু করতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু স্থানীয় মহাজনের উৎপাতে অপারগ হয়ে তা ছেড়ে দেন। দিনবদলের স্বপ্ন দেখতে শুরু করা তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে এসে, যোগ দেওয়া গণনাট্য সংঘেও। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে একাধিক গোলমাল পেরিয়ে ভারতে আসা। ভারতের মাটিতে তখন বাস্তুহারার ভিড়। সে ভিড়ের একজন হয়ে দিন কাটল তাঁর।
কই তোরা আজ দেশহিতৈষী ও দরদী ভাই ভগিনী
আজও মাঝে মাঝে চমকে উঠি রে ভাই, যেন নারায়ে তগদীর শব্দ শুনি।
মোদের মায়ায় ঘেরা ঘর ছিল রে, বুক ভরা খুব আশা
স্বাধীনতার দমকা হাওয়ায় ভাঙ্গলো সুখের বাসা রে, ভাঙ্গলো সুখের বাসা।
হয়ে বাস্তুহারা কপালপুড়া রে ভাই, করি দেশে দেশে আজ আনিগুনি।।
ভিড় থেকে বেরিয়ে নাগরিক আলোকবলয়ে আসতেই পারতেন তিনি, কিন্তু বাকি জীবনটা কাটান কোচবিহারের পাহাড়ি অঞ্চলে, কৃষক-শ্রমিক মানুষের ভিড়ের মধ্যেই। ছোটবেলায় অভিভাবক হারানো বিড়িশ্রমিক কিশোর, যে একটা বিশ্বযুদ্ধ দেখে ফেলেছে, যে যুবক দেখেছে জমিদার-মহাজনদের দুর্নীতি আর কালোবাজারির চক্রান্ত, তার ভাতের কষ্ট যে কত তীব্র, তার রাগ যে কত ধারালো, তা আন্দাজ করা অতিসংস্কৃত শহুরে বাবুদের পক্ষে কঠিন। বিশ্বাস করাও কঠিন, যে চিরকাল ওই সাধারণ ভিড়ের জন্যেই গান বাঁধলেন নিবারণ, এমনকী সেই ভিড় থেকেই তৈরি করলেন তাঁর গান গাওয়ার শিল্পীর দল।
তিনশোর বেশি গান লিখেছিলেন নিবারণ পণ্ডিত। সব গান কি কালোত্তীর্ণ? যদি না হয়, তাহলেই কি সেসব গানের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব লঘু হয়? কালোত্তীর্ণতাই কি শিল্পের সর্বোচ্চ মাপকাঠি? যেসব গান-কবিতার বৈশিষ্ট্যই হল কালনির্দিষ্টতা, তাদের কালকে অতিক্রম করে যাওয়ার প্রয়োজনই বা কী? এসব গানে ধরে রাখা আছে এক-একটি কালখণ্ডের এক-একটি ছোট ফুলকি। নিবারণের বিখ্যাত ‘মুখ্যু গীদাল হামরাগুলো’ গান বলছে– “ভাবিনু নাহয় ছাপি দিনি মুই গান দু চারখানা/ সেন্সরে কাটিয়া গানের ভাবে রাখিল না/ মনের আগুন চোখের জলে নিভানো কথাখানা/ সেন্সরে কয় আগুন শব্দ বলা রে চলিবে না”। কোন সময়ের কথা এগুলো? ১৯৭৫ সালে যখন জরুরি অবস্থায় ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো’ গানকেও বন্ধ করা হয়েছে, কেবল ওই ‘আগুন’ শব্দের জন্য। নিবারণের গানে রয়েছে এক আখ্যানধর্ম– স্থানীয় সংবাদদাতার ভূমিকা। ‘মোদের দুখের কথা কাহারে জানাই’ গানে ধরে রাখা আছে ১৯৪৪-’৪৫ সালে হাজং বিদ্রোহের একটি টুকরো ঘটনা। কেমন করে কৃষকবিরোধী আদিবাসীবিরোধী টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে মণি সিংয়ের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়েছিল স্থানীয় হাজং চাষিরা, তার ধারাবিবরণী এই দীর্ঘ গান। শুনতে শুনতে মনে পড়ে যায়, নিবারণ ময়মনসিংহের মানুষ, যে ময়মনসিংহ প্রাগাধুনিক বাংলার গীতিকাভাণ্ডারের জনক, বাহক; মানুষের গান আর মানুষের গল্প বলাই তার কাজ ছিল। টসার কবিতার মতো লঘু চালের গান ঠাট্টা করে বর-বউ-শাশুড়ি-শ্বশুরের বোঝাপড়াহীন পরিবারের গল্প বলতে বলতে আচমকা বলে ফেলে কংগ্রেসি সরকারের ছন্নছাড়া দেউলে অবস্থার কথা।
খুব ছোটবেলা থেকেই কবিয়ালদের সঙ্গ করছিলেন নিবারণ। তাৎক্ষণিক গীতরচনার সহজাত ক্ষমতা ছিল বলে আসরে বসে কবিয়ালদের গানও বেঁধে দিতেন তিনি। তাঁর নিজের গানের উপস্থাপনভঙ্গির মধ্যে সে অভ্যেসেরই ছাপ থেকে গেছে। কবিয়াল বা পালাগায়কদের কথা বলার, বারবার শ্রোতাকে সম্বোধন করার, উচ্চকণ্ঠে বক্তব্য প্রতিপাদনের ঢং খুব স্পষ্ট সেখানে।
স্বাধীন হইয়া আমরা ভাইরে ভাব্যাছিলাম সবে
মোটা ভাত কাপড় এইবারে মিলিবে
খাদ্য চাইলে কি মিলে ভাই শুন সমাচার
সাক্ষী দিবে দ্বারভাঙ্গা আর কুচবিহার।
জমিদারি উঠল না ভাই উচ্ছেদ হইলাম মোরা
জমি চাইয়া স্বাধীন দেশে হইলাম ভিটা হারা
মুছে তা দেয় কলোনী করে কত জমিদার
তেলুয়া মাথায় তেল চপাচপ, আমরা আড্ডিসার।
১৯৫২ সালে ‘পুনর্বাসন না নির্বাসন’ পুস্তিকায় ছাপা এই গান– ‘হা রে ও স্বদেশী হওরে হুঁশিয়ার’– জারি গানের সুরে গাওয়া হত। দেশভাগ আর উদ্বাস্তু সমস্যায় আচ্ছন্ন, বস্ত্র ও খাদ্যসংকটে বিধ্বস্ত, ভাঙা স্বপ্নের দেশে বসে এই কথাগুলোই বলতে চেয়েছিলেন নিবারণ, এই ভাষাতেই বলতে চেয়েছিলেন। কোনও জবরজং পোশাক বা চকচকে প্রসাধন তাতে আনার দরকার পড়েনি। তাতে তাঁর লেখা হয়তো কিছু কম কাব্যিক হয়েছে, কিন্তু যে লক্ষ্যশ্রোতার জন্য তাঁর লেখা, তাদের মগজে পুঁতে দিতে পেরেছেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন, সংশয়, প্রতিবাদের বীজ।
কোন প্রশাখার অন্তর্গত করা যায় নিবারণ পণ্ডিতের গানকে? গণসংগীত? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যায়। তেমন নিশ্চিতভাবেই যায় লোকসংগীতের ভিতরেও। আদতে গণসংগীত তার রসদ সবসময়েই সংগ্রহ করেছে লোকসংগীতের খোলা মাঠ থেকে। কোনও গানে ভাওয়াইয়া, কোনওটায় ভাটিয়ালি, কখনও সারি, কখনও পুথিপড়া, নানারকম সুর ব্যবহার করেছেন নিবারণ পণ্ডিত। আর একটু ওপর থেকে পাখিচোখে তাকালে চেনা যাবে, সামূহিক আনন্দবেদনার সুর, যৌথ দীর্ঘশ্বাসের সুর, সমবেত বিদ্রুপের সুর, সম্মিলিত উল্লাসের সুর, সমবায়িক যাপনের সুর– নিবারণ পণ্ডিতের গানে ছড়িয়ে পড়েছে। আর এই সুরগুলো ছাড়া কিছুতেই গানগুলোকে বুঝতে বা ভাবতে পারা যায় না। ‘ও দাদা রে তাড়াও বাবুইরে, খ্যাতের পাকিনা ধান খাইল রে’ গানের লিরিক পড়ে কোনওভাবেই এটা বোঝা সম্ভব নয় যে, গানের ভিতর উচ্চৈঃস্বরে পাখি তাড়ানোর একক বা সমবেত হুররর, হ্যাট্হ্যাট্ আওয়াজ গানের আবেদনকে কতটা জ্যান্ত করেছে। ‘আমার মাঞ্জুর মায়ে তো কন্ট্রোল বুঝে না’ গানের সানুনাসিক একঘেয়ে কান্নার টান ছাড়া গানের অর্থ বোঝা কঠিন। ‘মুখ্যু গীদাল হামরাগুলো’ গানের আঞ্চলিক টানে লেখা কবিতাংশ পড়লেও বোঝা সম্ভব নয় যে চটকা সুরে দোতারার ঝোঁক, বাঁশির শ্বাস কেমন করে গানের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করছে। ওই পরিবেশ, ওই যন্ত্রসঙ্গত, ওই উচ্চারণ ছাড়া গানগুলির অবয়ব অসম্পূর্ণ। গান তো নয়, এগুলো যেন এক একটি কৌমের পথ চলার সুর। নিবারণের গান লোকগানের বহু পরিচিত আঙ্গিকের মধ্যে তাঁর সময়ের ভাষ্য নিয়ে এসেছিল, যা একইসঙ্গে নতুন, আবার সাবেকি, আধুনিক, আবার পুরনো।