রাজা ব্রহ্মদত্তর বড় শিকারের শখ। একদিন হরিণ শিকারের টানে সঙ্গী সাথীদের থেকে দলছুট হয়ে তিনি বনের অনেক গভীরে চলে গেছিলেন। হরিণ মেরে কাঁধে নিয়ে আসতে আসতে পরিশ্রান্ত রাজা এক বট গাছের ছায়ায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভেঙে দেখেন সামনে এক যক্ষ। যক্ষর হাত থেকে নিস্তারের উপায় বের করলেন রাজা, কিন্তু সে উপায় কিছুদিন পরই অচল। অতএব?
গবেষকরা গুণে-গেঁথে বলছেন, বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া ৫৪৭টি জাতক গল্পের মধ্যে ৩৭২টি ঘটছে বারাণসী রাজ্যে। কাহিনির শুরুতে বলা হচ্ছে, ‘অতীতে বারাণসিয়াম্ ব্রহ্মদত্তে রাজ্জং কারেন্তে’। এই গল্পটিও তেমন।
রাজা ব্রহ্মদত্তর বড় শিকারের শখ। একদিন হরিণ শিকারের টানে সঙ্গী সাথীদের থেকে দলছুট হয়ে তিনি বনের অনেক গভীরে চলে গেছিলেন। হরিণ মেরে কাঁধে নিয়ে আসতে আসতে পরিশ্রান্ত রাজা এক বট গাছের ছায়ায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভেঙে দেখেন সামনে এক যক্ষ।
সে বলল, প্রস্তুত হও, তুমি আমার খাদ্য।
–মানে?
–এই বৃক্ষের ছায়াবৃত জমিতে যে আশ্রয় নেবে, সে-ই আমার খাদ্য।
–কোন অধিকারে?
–বৈশ্রবণের বরে।
নব জাতক পর্ব ১০: নিকটজনের অন্যায্য আবদারে রাজধর্মে বিচ্যুত হওয়া যায় না
মনে করিয়ে দিই, ভারতীয় পুরাণে বিশ্রবার পুত্র কুবের-এর আর এক নাম এই ‘বৈশ্রবণ’। মহাদেবের অনুগ্রহে তিনি ধনরত্নের অধিপতি, যক্ষ-কিন্নর-রাক্ষসদের প্রভু।
ব্রহ্মদত্তর সে-কথা জানা ছিল কি না, কে জানে! কিন্তু তিনি তর্ক না বাড়িয়ে অন্য কৌশল নিলেন। বললেন, শুধু আজ ক্ষুন্নিবৃত্তি করলেই চলবে, না কি বরাবরের জন্য খাদ্যের সংস্থান চাইছ?
–তেমন সুযোগ আর পাচ্ছি কই?
–তবে আজ এই হরিণের মাংস খাও, আর আমায় ছেড়ে দাও। কাল থেকে আমি প্রতিদিন তোমার আহারের জন্য অন্ন-ব্যঞ্জন-সহ একজন করে মানুষ পাঠাব।
–তুমি কে হে?
–আমি বারাণসীরাজ ব্রহ্মদত্ত।
রাজা আপন প্রাণ বাঁচাতে কথা তো দিয়ে এলেন, কিন্তু এখন উপায়? বিচক্ষণ অমাত্যরা বললেন, কতদিনের জন্য এমন দায়িত্ব নিলেন সেটি উল্লেখ করে এলে ভালো করতেন, মহারাজ। তাছাড়া এমনিতে সে রোজ নিশ্চয়ই এইভাবে খাবার পায় না, প্রতিদিন খাবারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার লোভ বাড়িয়ে দেওয়াও সমীচীন হল না। যাই হোক, আপাতত গুরুতর পাপী যেসব কয়েদি কারাগারে রয়েছে তাদের দিয়ে শুরু করা যাক।
তা-ই হল। এক একদিন এক একজন কয়েদিকে খাদ্যসহ পাঠানো হত যক্ষের কাছে। তারা আর ফিরত না। পরের দিন আবার আর এক ঘৃণ্য অপরাধীর পালা আসত।
ক্রমে কারাগার শূন্য হয়ে গেল। লোকমুখে গোপন অভিপ্রায় জানাজানি হয়ে যাওয়ায় এই কাজে মানুষ পাওয়াও মুশকিল হয়ে গেল। তখন রাজার তরফে ঘোষণা করা হল, যক্ষের খাবার নিয়ে যেতে যে রাজি হবে তাকে এক সহস্র মুদ্রা পুরস্কার দেওয়া হবে। নিতান্ত হতদরিদ্র কিছু মানুষ আসতে আরম্ভ করল। কিন্তু তাই দিয়ে আর কতদিন টানা যাবে? রাজার দুশ্চিন্তা বেড়েই চলল।
এমন সময় এক সুপুরুষ যুবক এসে বলল, ‘আমি যাব।’ তার নাম সুতনু। নেহাত গরিব। নিজের বলতে বিধবা মা।
রাজা বললেন, এই নাও সহস্র মুদ্রা পারিতোষিক।
–আমার আরও কিছু আবশ্যক।
–আরও কিছু?
–একজোড়া সোনার পাদুকা এবং বৃহৎ রাজছত্র।
–কী করবে?
–যক্ষের সঙ্গে আলাপন।
–মানে?
সুতনু বুঝিয়ে বলে, পাদুকা পরে থাকায় বটবৃক্ষের নীচের জমির ওপর সে দাঁড়িয়ে আছে বলা যাবে না; ছাতা মাথায় দিয়ে থাকায় বলা যাবে না গাছের ছায়া সে গ্রহণ করছে। এই অবস্থায় যক্ষের সঙ্গে কথা চালানো যাবে।
চমৎকৃত রাজা এবং অমাত্যরা বললেন, দেখো, যদি তার মন ফেরাতে পারো।
যক্ষ দেখল, আজকের লোকটি তো অন্যদিনের মতো নয়। আত্মপ্রত্যয় তার চলনে-বলনে। তার যুক্তিও মানতে হল, এই পাদুকা পায়ে আর ছাতা মাথায় সে আপাতত অবধ্য।
যক্ষ বলল, তুমি তাহলে কী জন্য এসেছ?
–তোমাকে এই সংবাদ জানাতে যে আমাকে বলপূর্বক হত্যা হয়তো তুমি করতে পারো, কিন্তু এরপর রাজা তোমাকে পাঠানোর মতো আর মানুষ পাবেন না।
–সে কথা আমিও বুঝতে পারি। কিন্তু উপায়?
–তুমি আমার সঙ্গে জনপদে চলো। অনেক সন্ত্রাস করেছ, এবার পঞ্চশীলে দীক্ষিত হও।
–পঞ্চশীল আবার কী?
–প্রাণীহত্যা, চুরি, অসংযম, মিথ্যাচার আর মদ্যপান– এই পাঁচ পাপ থেকে বিরত থাকা।
–রাজার কাছে খবর গেল, সুতনুর সঙ্গে শান্ত পায়ে যক্ষ আসছে নগরদ্বারে। রাজা তাকে পুনর্বাসন দিলেন, নিয়মিত খাবারের সংস্থান করলেন। আর সুতনুকে করলেন তাঁর সেনাপতি।
শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় কোনও সন্ত্রাসবাদীকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা সে-ই বোধহয় প্রথম।
ঋণ: সুতনু জাতক