সংসদে মোদি সরকারকে ও সংঘ-বিজেপি বাহিনীকে নানাভাবে উন্মোচিত করে শক্তিশালী ভাষণ দেওয়ার জন্য মহুয়া মৈত্র সুপরিচিত। ফলে তাঁর চরিত্র হনন ও ব্যক্তি আক্রমণই হাতিয়ার হয়ে উঠেছে কেন্দ্রীয় সরকারের। এর ফলে খুব শীঘ্রই অঞ্চলে অঞ্চলে সাধারণ মেয়েরা কী জামা পরছেন, কী খাচ্ছেন, কত ছেলে বন্ধু আছে, কখন বেরচ্ছেন– সব কিছু নিয়ে নীতিপুলিশি শুরু হবে। শুরু হবে কারণ আমরা অলিখিত চুক্তিপত্রে সই করে মৌনব্রত পালনে ব্যস্ত!
ফ্যাসিবাদ যখন দেশের ধড়াচূড়ো হয়ে ওঠে, তখনই আক্রমণ নামে ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে কাঠামোগত সামঞ্জস্য রেখে বর্তমানে সমস্ত বিকল্প রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা এবং সব সমালোচনা ও বিরোধিতাকে সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষ করার প্রক্রিয়ায় নেমেছে মোদি সরকার। যার নিদর্শন আরও স্পষ্টভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ গঠনের পর থেকেই। একের পর এক অবিজেপি রাজ্যে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোর দাপাদাপি, কোচিতে বিস্ফোরণ, বিরোধী মহিলা রাজনীতিকদের চরিত্র হনন-সহ কেন্দ্রের রক্তচক্ষু প্রদর্শন অব্যাহত। মহুয়া মৈত্র প্রসঙ্গে রাজ্যেও দিলীপ ঘোষ এবং শুভেন্দু অধিকারী যেভাবে মহিলা রাজনীতিকদের চরিত্র হনন ও ব্যক্তি আক্রমণে নেমেছেন, তাতে খুব শীঘ্রই অঞ্চলে অঞ্চলে সাধারণ মেয়েরা কী জামা পরছেন, কী খাচ্ছেন, কত ছেলে বন্ধু আছে, কখন বেরচ্ছেন– সব কিছু নিয়ে নীতিপুলিশি শুরু হবে। শুরু হবে কারণ আমরা অলিখিত চুক্তিপত্রে সই করে মৌনব্রত পালনে ব্যস্ত! মহুয়া মৈত্র রাজনৈতিক কাজ কী করেছেন বা করেননি– সে সমালোচনার থেকে বড় সমালোচনা হয়ে উঠেছে তাঁর ব্যক্তিজীবন, অর্থাৎ তিনি কেমন জামা পরেন, কত ছেলেবন্ধু আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। দিলীপ ঘোষ একধাপ এগিয়ে বলেছেন উনি নোংরা মহিলা। শুভেন্দু বলেছেন, বেশি স্বাধীনতা পেয়ে উনি উচ্ছন্নে গেছেন। এত সাহস কী করে হয় একজন মহিলার! যা খুশি করবে নাকি! টেনে নামানো হবে, নিদান শুভেন্দুর। এই ধর্ষণ সংস্কৃতি আর কতদিন!
আরও পড়ুন: মহিলা সংরক্ষণ বিল কি মহিলাদের ভোটযুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য?
মহিলা রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে আক্রমণের অভিমুখে থাকে পিতৃতান্ত্রিক অতীতগামীতায়। ফলস্বরূপ, মহুয়া মৈত্রের মতো ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী এবং বিজেপির বিরুদ্ধে সরব সাংসদের ওপর নেমে আসে রুচিহীন এবং কু-ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য। মহুয়া বা দুবের এই বাকযুদ্ধ বহুদিন ধরেই চলছে, এটি কর্পোরেট প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলশ্রুতি বা কতিপয় ব্যক্তির নিজস্ব প্রতিশোধস্পৃহা থেকে করছেন– এইসব মন্তব্য করে চেষ্টা চলছে ঘটনার অনুকম্পন লঘু করার। আবার, শুধুমাত্র কিছু বিরোধী কণ্ঠকে দমিয়ে দিতে বা সংসদে বিতর্ক থামিয়ে দিতেই যে এটা করা হচ্ছে, তা ভাবাটা একদমই ভুল। কিছুদিন আগেই প্রকাশ পাওয়া হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ রিপোর্টে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শেয়ারে কারচুপি, অর্থ পাচার ও করদাতাদের অর্থ চুরির মতো গুরুতর অভিযোগ ও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এবং মহুয়ার পিছনে এই সুচিন্তিত এবং সমবেত আক্রমণের অন্যতম কারণ হল– আম্বানি-আদানির এই পর্বতপ্রমাণ কর্পোরেট কেলেঙ্কারি বা মোদি-আদানি আঁতাত সম্পর্কে প্রশ্ন তোলাকে কর্পোরেট প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রসূত ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক পদ্ধতি হিসেবে দেগে দিয়ে বেআইনি বলে প্রতিপন্ন করা।
২০১৯ সালে লোকসভার সাংসদ হয়েছেন মহুয়া মৈত্র। সংসদে মোদি সরকারকে ও সংঘ-বিজেপি বাহিনীকে নানাভাবে উন্মোচিত করে শক্তিশালী ভাষণ দেওয়ার জন্য মহুয়া মৈত্র সুপরিচিত। সংসদে তাঁর প্রথম বক্তব্যই দেশে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা, বিরোধী শক্তিগুলির ওপর অনৈতিক আক্রমণ, পেগাসাস বিতর্ক-সহ সাতটি প্রকট ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করে বিজেপি সরকারের প্রতি তীব্র আক্রমণ শানিয়েছিলেন মহুয়া। উল্টোদিকে ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার কুখ্যাত বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে, যিনি টিএমসি-র সাংসদ মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন, তিনি আদানির প্রতিদ্বন্দ্বী কর্পোরেট গোষ্ঠীর কাছ থেকে ঘুষ খেয়েছেন। নিশিকান্ত সংসদে বারবার অবমাননাকর ও নারীবিদ্বেষী মন্তব্য করেছেন এর আগেও। তার একেবারে বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে মহুয়া সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-এর বিরুদ্ধে ওঠা ধর্ষণের অভিযোগ এবং তার বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে লোকসভায় প্রশ্ন তুলেছেন। তখনও মহুয়ার বিরুদ্ধে চরম অবমাননাকর মন্তব্য-সহ সংবিধানের ১২১ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছিলেন দুবে। এবার যেহেতু এথিক্স কমিটি তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ করেছেন, দুবে তাঁর লিঙ্গসর্বস্বতা, ব্যক্তি আক্রমণ ও স্লাট শেমিং নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। দুবে অভিযোগটি স্পিকারের কাছে পাঠিয়েছেন এবং স্পিকার তা তৎক্ষণাৎ লোকসভার এথিক্স কমিটির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। পরিহাসের বিষয় হল, এথিক্স কমিটিতে বিএসপি-র দানিশ আলীও আছেন, যিনি নিজেই এখনও কোনও সুবিচার পাননি সংসদে তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপি এমপি রমেশ বিদুরির ঘৃণাপূর্ণ হুমকির মামলার প্রেক্ষিতে। তবে এই ক্ষেত্রে এত তড়িঘড়ি কি আদপেই দেশের সুরক্ষার স্বার্থে?
শুধুই কি মহুয়া? এই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে খুবই সুস্পষ্ট কৌশলে। অভিযোগ, দুবাই-কেন্দ্রীক হিরানন্দানি গোষ্ঠির সিইও দর্শন হিরানন্দানির সই করা একটা সন্দেহজনক ‘এফিডেভিট’-এ স্বীকার করা হয়েছে যে, তিনি টিএমসি সাংসদ মহুয়াকে ওইসব সুযোগ সুবিধা দিয়েছেন। এবং তার বিনিময়ে মহুয়া তাঁকে লোকসভা লগ ইন আইডির নাগাল দিয়েছেন কিছু প্রশ্ন ও তথ্য জমা করার জন্য। এটাই মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে চালানো অভিযানে এখনও পর্যন্ত নিশিকান্ত দুবের পেশ করা সবচেয়ে বড় ‘অস্ত্র’। হিরানন্দানি গোষ্ঠী দুবের অভিযোগটি প্রাথমিকভাবে অস্বীকার করার পর এই এফিডেভিট-টি আসে। এফিডেভিট-টিতে প্রখ্যাত আইনজীবী শার্দূল ও পল্লবী শ্রফ এবং বিশিষ্ট বাণিজ্য-বিষয়ক তথ্যানুসন্ধানী সাংবাদিক সুচেতা দালালের বিরুদ্ধেও মহুয়াকে তাঁর রাজনৈতিক লাইনে (যেমন আদানি গোষ্ঠী সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা) অগ্রসর হতে সাহায্য করার অভিযোগ তোলা হয়েছে। দুই সাংবাদিক ও আইনজীবী এই অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেছেন। অর্থাৎ, যে কোনও বিরোধী সাংসদ আদানি গোষ্ঠীর দুর্নীতি ও মোদি-আদানি আঁতাত প্রশ্নে সোচ্চার হলেই তাঁকে নিশানা বানানোর প্যাটার্ন।
আরও পড়ুন: ‘হিজড়ে’ বলেই আক্রমণ দক্ষিণপন্থী দলের, যাদবপুরে আমার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা
রাহুল গান্ধীর সংসদ পদ খারিজ, সঞ্জয় সিংহের গ্রেপ্তারি এবং এখন মহুয়া মৈত্রকে নিশানা বানিয়ে চরিত্রহনন অভিযান এবং তাঁর সাংসদ পদ কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র– ভীষণ পরিষ্কার হয়ে যায় মোদি সরকারের উদ্দেশ্য। পেগাসাস কেলেঙ্কারির ক্ষত এখনও মোছেনি দেশবাসীর মন থেকেও। তখনও মোদি সরকার দেশের সাংবাদিক, বিরোধী রাজনীতিবিদদের ফোন হ্যাক করার চেষ্টা করেছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। এর মধ্যেই আবারও সেই অভিযোগ করলেন শশী থারুর, মহুয়া মৈত্র, পবন খেরা-সহ একাধিক বিরোধী নেতৃত্ব। তাঁরা প্রমাণ-সহ তুলে ধরেছেন একটি বার্তা, যেখানে অ্যাপলের তরফ থেকে অ্যালার্ট পাঠানো হয়েছে– ‘অ্যাপেল বিশ্বাস করে যে আপনার ফোন হ্যাক করার চেষ্টা করছে সরকারের মদতপ্রাপ্ত হ্যাকাররা। আপনি যে কাজ করেন, তার জন্যেই এই হ্যাকাররা ব্যক্তিগত ভাবে আপনার ফোন হ্যাক করতে চাইছে। যদি সরকারি মদতপ্রাপ্ত এই হ্যাকাররা আপনার ফোনে ঢুকতে সক্ষম হয়, তাহলে আপনার ফোনে থাকা গোপন তথ্য তারা অনায়াসে হাতিয়ে নিতে পারবে। এমনকী, তারা আপনার ফোনের ক্যামেরা ও মাইক ব্যবহার করতে পারবে। হতে পারে যে এই অ্যালার্মটা সঠিক নয়, তবে তাও এটাকে গুরুত্ব সহকারে নিন।’ একদিকে তথ্য চুরির চেষ্টা, অন্যদিকে মহুয়ার বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে তথ্য বিক্রির অভিযোগ হেনে চরিত্রহনন ও সংসদপদ বাতিলের চেষ্টা– হিসেব যে সত্যিই মিলে যাচ্ছে!
চরিত্রহননের মোক্ষম অস্ত্র হল শেমিং। সেটাই করা হচ্ছে মহুয়ার ক্ষেত্রে, যিনি মোটামুটি সফল একজন মহিলা। এমনিতেই যাঁদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কুটকাচালি করতেই অভ্যস্ত আমরা। কাজেই মহুয়া কী পোশাক পরেছেন, কার সঙ্গে মদ খেয়েছেন, কত ধূমপান করেছেন, ক’জন ছেলেবন্ধু আছে ইত্যাদি অত্যন্ত ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে চলছে একের পর আক্রমণ ও শেমিং। আর স্বামীর যৌন চাহিদা মেটানোর মেশিন বা বংশের উত্তরাধিকার উৎপাদন যন্ত্র– এর বাইরে মেয়েরা যখনই সফলভাবে জীবনযাপন করে, ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী হয় বা নেহাত নিজের মতো বাঁচতে চায়, তখনই সে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে থ্রেট হয়ে দাঁড়ায়। তাই মহুয়ার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিকভাবে সে কত কাজ করেছে, সেই সমালোচনার থেকেও বারংবার এই শেমিংই অস্ত্র হয়ে উঠছে।
আরও পড়ুন: হিংসার অভিমুখ শেষমেশ নারী নির্যাতনের দিকে
দেশের সাধারণ মহিলাদের ক্ষেত্রেও একইরকম আক্রমণ ও প্রবঞ্চনা ছাড়া কিছুই দেয়নি এই সরকার। মহিলাবিরোধী এই সংস্কৃতি সেদিনই আরও কঠোরভাবে মান্যতা পেয়েছিল, যেদিন নতুন ভারতে রাজদণ্ড স্থাপন আর ধর্মীয় আচারের মাধ্যমে দেশের সংবিধানকে উড়িয়ে দিয়ে সংসদ ভবন উদ্বোধন হল, যেখানে ঠাঁই হয়নি দেশের আদিবাসী মহিলা রাষ্ট্রপতির। আর অন্যদিকে নতুন ভারতের নতুন সংসদের বাইরে, যৌন নির্যাতনের বিচার ও নির্যাতনকারী বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ সিং-কে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবিতে কুস্তিগীরদের ডাকা ‘মহিলা পঞ্চায়েত’ শুরু হওয়ার আগে তাঁদের ওপর তাণ্ডব চালায় সশস্ত্র বাহিনী। সম্প্রতি মহিলা সংরক্ষণ বিল পাস হয়েছে কিন্তু নানান জটিল ও জনবিরোধী শর্ত আরোপ করা হয়েছে। বিলে বলা হয়েছে যে, পরবর্তী জনগণনা ও নতুন নির্বাচনী ক্ষেত্র সীমানা নির্ধারিত হওয়ার পরেই এই বিল লাগু করা হবে। এটা আসলে দীর্ঘদিন ধরে মহিলাদের ঘাম রক্ত ঝরানো অধিকারের লড়াইয়ের প্রতি সরাসরি আক্রমণ। প্রসঙ্গত, এই মোদি সরকারই ২০২১ সালের জনগণনা হতে দেয়নি এবং পরবর্তী জনগণনাও কবে হবে, তা নিয়ে টালবাহানা করছে এবং এই সীমানা নির্ধারণের পদ্ধতিও অত্যন্ত জটিল এবং সময় সাপেক্ষ বলে জানা যাচ্ছে। ধর্ম নির্বিশেষে সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মহিলাদের জন্য ‘সংরক্ষণের মধ্যে সংরক্ষণ’-এর দাবিতে মেয়েরা লড়ছে বহুদিন ধরে! তবুও সংসদের আকস্মিক বিশেষ অধিবেশন ডেকে মোদি সরকারের এই পদক্ষেপ মেয়েদের এই সমস্ত দাবি ও অধিকারের লড়াইকে কার্যত নস্যাৎ করছে।
কাজেই নামটা যে বিরোধী সংসদেরই হোক, যে দলের সঙ্গেই তার সাজুজ্য থাকুক লড়াইটা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এবং একত্রে। নারীবিদ্বেষ, চরিত্রহনন ও মনুবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে।