অনেকে মনে করেন, চৈতন্যদেবের সমসাময়িক সাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মা কালীর বহুপূজিত এই মূর্তির নির্মাণ এবং পূজা শুরু করেন। মায়ের সাকার রূপে পূজা করার ইচ্ছে হওয়ায় কী মূর্তিতে, তা হবে নিয়ে চিন্তায় ছিলেন কৃষ্ণানন্দ। মায়ের আদেশ পেলেন যে, ভোররাতে যে নারী মূর্তি দেখবেন, তাঁর রূপ ও ভঙ্গি অনুযায়ী হবে মায়ের মূর্তি। পরদিন ভোরে গঙ্গাস্নানে যাওয়ার সময় তিনি এক শ্যামবর্ণা রমণীকে দেখলেন। তার কেশ কৃষ্ণবর্ণ, আলুলায়িত। বাঁহাতে গোবরের তাল নিয়ে ডানহাতে মাটির প্রলেপ দিচ্ছেন। দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে বরাভয় মূর্তির ইঙ্গিত।
সৃষ্টির অতীত যেখানে, সৃষ্টি আছে কি না, তা চিন্তা করার মতো অবস্থা আমাদের নেই, সেখানে ঈশ্বরের স্বরূপ আমাদের ধারণার অতীত। কিন্তু যখন আমরা ঈশ্বর-চিন্তা করছি, তাঁকে এক অনন্ত পুরুষ বা অনন্ত শক্তিরূপে কল্পনা করছি, তাঁকে মনের গোচর করার চেষ্টা করছি, তখন তাঁকে সৃষ্টি-বিনাশাদি বিরুদ্ধভাবের আধাররূপে দেখাই উচিত। স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন যে, আমরা যেন ভীষণকে ভীষণ জেনেই আলিঙ্গন করি, তাকে যেন কোমলতর হতে অনুরোধ না করি।
আরও পড়ুন: জন্ম-জন্মান্তরের বিষয়-আকাঙ্ক্ষা যখন হেলাফেলা করা যায়
ঈশ্বরকে আমরা ‘মা’ বলি। সেই চিন্ময়ী শক্তিই মা রূপে আরাধিতা হন। মা যখন জন্মদাত্রী পালনকর্ত্রী মা, তখন তাকে আমরা খুব সহজেই গ্রহণ করতে পারি। তাঁর ইচ্ছাতেই সব হচ্ছে বলি। কিন্তু দুঃখের সময় দুঃখকেও তাঁর দান বলে মনেপ্রাণে হাসিমুখে গ্রহণ করতে পারি না। চৈতন্যময়ী মায়ের সৃষ্টি ও পালনী শক্তিকে স্বীকার করলেও তাঁর বিনাশী রূপকে সহজে গ্রহণ করতে পারি না। কিন্তু মাতৃরূপা শক্তির সঙ্গে বিনাশের ভাবের সংযোগ যে অপরিহার্য। আর তা আমরা পাই কালী মূর্তিতে। মা কালী একদিকে যেমন ‘সুখপ্রসন্নবদনা’ ‘স্মেরাননসরোরুহাম’ অপরদিকে ‘করালবদনা’ ‘ঘোরা’। শ্রীরামকৃষ্ণ খুব সুন্দর বলছেন, ‘ব্রহ্মকে ছেড়ে শক্তিকে, শক্তিকে ছেড়ে ব্রহ্মকে ভাবা যায় না।…আদ্যাশক্তি লীলাময়ী, সৃষ্টি স্থিতি-প্রলয় করছেন। তাঁরই নাম কালী। কালীই ব্রহ্ম, রহ্মই কালী। একই বস্তু, যখন তিনি নিষ্ক্রিয় সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় কোনও কাজ করছেন না– এই কথা যখন ভাবি, তখন তাঁকে ব্রহ্ম বলে কই। যখন তিনি এই সব কার্য করেন, তখন তাঁকে কালী বলি, শক্তি বলি। একই ব্যক্তি নাম– রূপভেদ।
আরও পড়ুন: মা বাইরের দালানে ছিলেন, এবার হৃদয়াসনে, বিসর্জন প্রসঙ্গে বলেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ
কালীর এই যে রূপ, তা নিছক কল্পনা নয়। তন্ত্র-সাধনকালে একবার শ্রীরামকৃষ্ণদেব ধ্যাননেত্রে এক রূপ প্রত্যক্ষ করলেন। দেখলেন এক সুন্দরী স্ত্রীমূর্তি গঙ্গা থেকে উঠে ধীর পদক্ষেপে পঞ্চবটীতে এলেন। ক্রমে দেখলেন তিনি পূর্ণগর্ভা, সন্তানের জন্ম দিয়ে তাঁকে স্তনদান করছেন। তারপর করাল বদনে এই শিশুকে গ্রাস করে গঙ্গায় মিলিয়ে গেলেন। মা কালীর মূর্তি কল্পনায় এই সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশ– এই তিন ভাবেরই সমাবেশ রয়েছে। বিরুদ্ধ ভাবের অপূর্ব সন্নিবেশ রয়েছে মা কালীর মধ্যে। তাঁর মধ্যে কোমল-কঠোর ভাবের সমাবেশ আমাদের মোহিত করে। মা কালীর যে মূর্তি আমাদের সামনে প্রতিভাত হয় এবং তাঁর ধ্যানমন্ত্র– দুই-ই তাঁর স্বরূপের দিকে ইঙ্গিত করে। দশমহাবিদ্যার অন্যতম রূপ এই কালী রূপ। অনেকে মনে করেন, চৈতন্যদেবের সমসাময়িক সাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মা কালীর বহুপূজিত এই মূর্তির নির্মাণ এবং পূজা শুরু করেন। মায়ের সাকার রূপে পূজা করার ইচ্ছে হওয়ায় কী মূর্তিতে, তা হবে নিয়ে চিন্তায় ছিলেন কৃষ্ণানন্দ। মায়ের আদেশ পেলেন যে, ভোররাতে যে নারী মূর্তি দেখবেন, তাঁর রূপ ও ভঙ্গি অনুযায়ী হবে মায়ের মূর্তি। পরদিন ভোরে গঙ্গাস্নানে যাওয়ার সময় তিনি এক শ্যামবর্ণা রমণীকে দেখলেন। তার কেশ কৃষ্ণবর্ণ, আলুলায়িত। বাঁহাতে গোবরের তাল নিয়ে ডানহাতে মাটির প্রলেপ দিচ্ছেন। দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে বরাভয় মূর্তির ইঙ্গিত। কোমরে সামান্য বস্ত্রখণ্ড। সাধক কৃষ্ণানন্দকে দেখে সে লজ্জায় জিভ কাটল। তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হল। হৃদয়ে মায়ের মূর্তির আভাস পেলেন।
জীবনে যদি সত্য লাভ করতে চাই, তাহলে জীবনের মতো মৃত্যুকে, সুখের মতো দুঃখকেও বরণ করে নিতে পারলে সত্যের পথে দ্রুত অগ্রসর হওয়া যায়। দুঃখের সময়, যখন মনে হয় জীবনের সব স্বপ্ন বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম, তখন প্রশান্ত থাকতে পারলেই বোঝা যায় সত্যের পথে এগোচ্ছি। এই সত্য দুঃখজয়ী, মৃত্যুঞ্জয়ী চিরআনন্দময় সত্য। ভীষণের উপাসনা এই সত্যকেই আমাদের জীবনে নিয়ে আসে। ‘সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়, মৃত্যরে যে বাঁধে বাহু পাশে, কালনৃত্য করে উপভোগ, মাতৃরূপা তারি কাছে আসে।’ মাতৃরূপা কালী উপাসনার সার্থকতা এখানেই।