কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মনে হল যে কাঁধে একটা নিঃশ্বাস পড়ছে। একদম ঠান্ডা নিঃশ্বাস। কেমন যেন অস্বস্তি হতে থাকে। কান থেকে ইয়ারফোন নামিয়ে রাখলাম। সেই একই রকম নিস্তব্ধতা। ভাবলাম নীচে চলে যাই। কিন্তু ততক্ষণে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি হাঁটতে থাকি। লিখছেন আদিত্য ভট্টাচার্য
২০১৯ সাল। একটা বড় জংশনের কাছে একটা বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে তখন আমি ইলেক্ট্রনিক্স ৩য় বর্ষের ছাত্র। এপ্রিল মাসের ৭ আর ৯ তারিখ কলেজে টেকফেস্ট ছিল আর তার পরের দু’দিন ফেস্ট। টেকফেস্টের এগজিবিশনে আমার নিজের কাজ না থাকলেও আমি আমার বন্ধুদের সাহায্য করছিলাম। নিজের ভুলের জন্য একটা বিশ্রি ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলাম। সেই সময় মানসিক অবসাদ আমাকে এতটাই গ্রাস করেছিল যে, ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পরও রোজ কলেজে থেকে যেতাম অন্যদের সাহায্য করার জন্য। বাড়ি যেতেই ইচ্ছে করত না। সেদিনও সেটাই করলাম। সাধারণত রাত ৮টায় ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরতাম। কিন্তু সেদিন শেওড়াফুলি স্টেশনে একটা ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ায় হাওড়া-বর্ধমান লোকাল ট্রেন পরিষেবা বন্ধ ছিল। অগত্যা, বাড়ি ফেরা সেদিন হবে না।
বন্ধু অভিজিৎকে বললাম, ‘ভাই, ট্রেন উল্টে গেছে। তোদের মেসে থাকা যাবে?’
অভিজিৎ খুব খুশি, ‘আরে ভাই ভাই ভাই নিশ্চয়ই। তবে আমাদের কিন্তু কমোড নেই আর…’
–আর?
অভিজিৎ কাঁধ ঝাঁকিয়ে ব্যাপারটা এড়িয়ে যায়, ‘বাদ দে। হালকা একটু চলবে নাকি?’
অভিজিতের ইশারা স্পষ্ট বুঝতে পারি, বলি, ‘না।’
‘আরে ভাই আদি, জানি তোর এখন অনেক চাপ চলছে। পেটে একটু জল পড়লে সব ডিপ্রেশন কেটে যাবে।’
‘না ভাই। খেতে ইচ্ছে করছে না। আমি এমনি থাকব তোদের সঙ্গে। আমার জন্য একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক কিনিস।’
কলেজে কাজ হয়ে গেলে মেসে এসে খাওয়া-দাওয়া করে তাস নিয়ে বসা হল। অভিজিৎদের মেসে আমাকে নিয়ে ৬ জন। অভিজিৎ, আমি, আমাদের আর এক বন্ধু আকাশ, ঋতব্রত, রফিক আর রাজ। তাস খেলতে খেলতে বোতলও চলছিল। ২টো কালো সেট খেয়ে যখন আমরা ১:৩০টা নাগাদ ঘুমতে যাচ্ছি, তখন আকাশ আমতা আমতা করে বলল, ‘ইয়ে মানে, আদি… রাতে যাই হয়ে যাক ছাদে যাস না।’
কথাটা আমার ঠিক ভাল লাগল না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’
‘তেমন কিছু নয়। জাস্ট যাস না।’ আকাশ ব্রাশ করতে চলে গেল।
আরও পড়ুন: একই জায়গা ক্রস করেছিলাম পাঁচবার
সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও আমার কিছুতেই ঘুম আসছিল না। কারণ, গরম। বাড়িতে এসিতে শুয়ে অভ্যেস। তাই এপ্রিলের চরম গরমে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। তার উপর নানা খারাপ চিন্তা মাথায় আসছিল। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। চলে গেলাম ছাদে। সঙ্গে নিলাম বিড়ি, লাইটার, ফোন আর ইয়ারফোন। ছাদটা আর ৫টা সাধারণ ছাদের থেকে আলাদা কিছুই নয়। কোমর হাইটের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা খোলা ছাদ আর সেখানে কিচ্ছু নেই। না কোনও ফুলগাছের টব। না কোনও জিনিস সেখানে রাখা। এমনকী সেখানে কাপড় টাঙানোর কোনও দড়িও নেই। বুঝতে অসুবিধা হল না যে এখানে কেউ আসে না।
কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান চালিয়ে একটা বিড়ি ধরালাম। ছাদে পায়চারি করতে করতে বিড়ি ফুঁকতে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছিল যে, ছাদে আমি একা নই। মনে হল আমার পিছনে কেউ আছে। মানে কী বলব, আমার জাস্ট মনে হচ্ছিল যে পিছনে কেউ আছে। কিন্তু যেই পিছনে তাকালাম, কেউ নেই। কান থেকে ইয়ারফোন নামালাম। পুরো ছাদ নিঝুম। নিস্তব্ধ! একটা ঝিঁঝি পোকার ডাক অবধি শোনা যাচ্ছে না। তবে ভয় যে লাগছিল না, তা নয়। আমি পায়চারি করতে থাকি কানে আবার ইয়ারফোন লাগিয়ে।
আরও পড়ুন: আড়াই দশক আগের দৃশ্য, আজও আমি স্পষ্ট দেখি
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মনে হল যে কাঁধে একটা নিঃশ্বাস পড়ছে। একদম ঠান্ডা নিঃশ্বাস। কেমন যেন অস্বস্তি হতে থাকে। কান থেকে ইয়ারফোন নামিয়ে রাখলাম। সেই একই রকম নিস্তব্ধতা। ভাবলাম নীচে চলে যাই। কিন্তু ততক্ষণে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি হাঁটতে থাকি। হঠাৎ আমার কানের খুব কাছে ঠান্ডা ফ্যাসফ্যাসে গলায় কেউ একজন বলে উঠল, ‘আদি। এই আদি!’
ঘুরে দাঁড়াই। কিন্তু কেউ নেই। নিজের নাম শুনে মনে সাহস এল। নিশ্চয়ই কেউ মজা নিচ্ছে। পুরো ছাদ তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকলাম। পুরো ছাদ ফাঁকা। যে জায়গায় মেসটা ছিল, সেটা মেস-পাড়া নামে খ্যাত। কারণ সেখানে সবক’টা বাড়িই প্রায় আমাদের কলেজের মেস বা পিজি। আশপাশের সব মেসের ছাদ আর ঘরগুলো খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলাম। কেউ নেই। জানলা দিয়ে ঘরের ভেতরেও দেখার চেষ্টা করলাম। সব অন্ধকার। পরদিন টেকফেস্ট। কারুর জেগে থাকার কথাও নয়। ঠোঁট শুকিয়ে আসছে। শুকনো গরম থাকা সত্ত্বেও শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু আমি ছাদ থেকে পালালাম না। রোখ চেপে গেছে এর শেষ দেখে ছাড়ব।
আরও পড়ুন: মুখের জায়গায় একটা চেরা জিভ লকলক করছে
আরও একটা বিড়ি ধরিয়ে ফুঁকতে লাগলাম। শান্তিতে বিড়ি খাওয়া হয়ে গেল। কিচ্ছু হল না। কিছুক্ষণ পর আবার কানের কাছে এসে কেউ সেই একই ঠান্ডা কণ্ঠে বলল, ‘নীচে চলে যা!’ এবার আমার মাথা গরম হল। চেঁচিয়ে বলতে থাকলাম, ‘এই শালা! কে তুই? সামনে এসে কথা বল!’
কিন্তু আমার এই আওয়াজ ফাঁকা থেকে গেল, কারণ পরক্ষণেই মাথায় কেউ একজন চাটি মারল। ব্যস! সেটাই ছিল আমার ব্রেকিং পয়েন্ট। চিৎকার করে পালিয়ে নীচে অভিজিতের রুমে ঢুকে পড়লাম। হঠাৎ করে এভাবে আমায় হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে অভিজিৎ ঘুম থেকে উঠে আলো জ্বালিয়ে দিল। পুরো মেসের বাকি সবাই উঠে পড়েছে ততক্ষণে। অভিজিৎ আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমি বলেই চলেছি, ‘উপরে কেউ আছে! উপরে… উপরে…’
আকাশ চোখে-মুখে জল ছিটিয়ে দিল। অভিজিৎ বলল, ‘তোকে না করেছিলাম উপরে যেতে। কেন গেলি?’
আমি তখনও কিছু বলার জায়গায় নেই। হঠাৎ করে আকাশ আমার ডান হাতটা তুলে ধরল। সেখানে একটা দগদগে, কালো, পরিষ্কার পাঁচ আঙুলের দাগ!
সেই রাতে কেউ ঘুমলো না। পরদিন প্রথম ট্রেনেই বাড়ি চলে এলাম এবং ৩-৪ দিন বাড়ি থেকেই বেরলাম না। টেকফেস্ট সব মিস হল। প্রায় ১ সপ্তাহ পর কলেজ গেলাম এবং ফেরার পথে মেসের মালিক সবুজ কাকুর সঙ্গে দেখা করতে এলাম। তাকে সরাসরি বললাম পুরো কেস। শুরুতে অস্বীকার করলেও পরে অনেক জোড়াজুড়ি করার পর তিনি একটা ঘটনার কথা বলেন। ২০১২ সালে আমাদের কলেজের এক ছাত্র এই মেসে আত্মহত্যা করেছিল। তারপর থেকেই এই উপদ্রব।
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী
একজন বিজ্ঞানী জীবন বিপন্ন করে কর্পোরেট চালিত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। দেশের গোয়েন্দা বাহিনী তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল, তারা দেশাইকে ফেরায়নি। না ফেরানোর জন্য জবাবদিহি করেনি। এবং নানা কারণের সংযোগে আজ ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য কেন্দ্র আজ সাগর জলে।