অনাথ বন্যপ্রাণীর সংখ্যা সারা বিশ্বে নেহাত কম নয়, ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ফলে যা বাড়বে বই কমবে না। দলে দলে মানুষ নাম লেখাবে বন্যপ্রাণ উদ্ধার কাজে, তাদের কুর্নিশ। হেরে যাওয়া এমন এক যুদ্ধে সৈনিকদলে নাম লেখানোর নেপথ্যে থাকে অদম্য সাহস, আশাবাদী হৃদয়। বিনিময়ে সাময়িক সাফল্য আর শেষপাতে গভীর অবসাদ ছাড়া কিছু ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
হাঙ্গাল-গুন্ডলুপেটের গ্রাম সংলগ্ন এলাকায় রাতে হাতি বেরল। চাষজমিতে হাতি তাড়ানোর সবরকম সরঞ্জাম নিয়ে গ্রামবাসী প্রস্তুত। গ্রামের চারপাশে কর্ণাটকের বান্দিপুর অভয়ারণ্য। বনের এক প্রান্ত থেকে উল্টোদিকে যাওয়ার পথে গ্রাম পড়বেই, হাতি নিরুপায়, মানুষেরই বা কী গতি? রাতভর মানুষে হাতিতে রেষারেষির ফলে বড় হাতি শুঁড়ে প্রাণ নিয়ে পালাল, পড়ে রইল হাতির ছানা। এমন পরিস্থিতিতে সে আগে কখনও পড়েনি, আতশবাজি আর কাড়ানাকাড়ার ডামাডোল থেকে পালানোর কৌশল সে এখনও শেখেনি! হয়তো পরের রাতে মা-হাতি ফিরে আসত ছানা ফেরত নিতে, কিন্তু তার অপেক্ষায় আরও একবার হাতির পায়ে জমি নষ্ট হওয়ার অবকাশ না রেখে ছোট হাতিকে নিয়ে আসা হল বনদপ্তরের হাতিশালে। সেখানে ছানার আলাদা ঘর। লরি করে ল্যাক্টোজেন আসছে। দু’জন কর্মী দিনভর দুধ গুলছে, হাতির শুঁড়ের সামনে ধরছে, এদিকে বাচ্চা হাতির শুঁড় ঊর্ধ্বগামী। সে খুঁজছে মায়ের দু’পায়ের ফাঁকে দুধের আধার। শুঁড় নিচু করে খাওয়ার অভ্যেস তার নেই, জিন-এ লেখা আছে জিন্মের পর থেকেই শুঁড় তুলে খাবার খোঁজার কোড। ঘরের চার দেওয়াল বরাবর শুঁড় উঁচু করে ছানা-হাতি ঘুরে বেড়ায়। দেওয়ালের ঘষায় মনে হয় মায়ের শরীর। দিন যায়। দপ্তরের মানুষ ওকে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়, ট্যুরিস্ট মানুষ ছানা-হাতির সঙ্গে ছানা-মানুষের ছবি তুলে বাড়ি যায়। নিরুপায় বিজ্ঞানী রোজ হাতিশালে ঢুঁ মারে। ছোট হাতি দুর্বল হতে হতে একদিন প্রাণ হারায়।
জলদাপাড়ার ডিভিশনে তোর্সায় বানের জলে ভেসে এসেছিল উত্তরবঙ্গের হাতিশাবক। তাকেও উদ্ধার করে বনদপ্তর। গ্যালন-কে-গ্যালন দুধ গোলা হয় অ্যালুমনিয়ামের বালতিতে। এর বয়স বান্দিপুরের ছানার চেয়ে খানিক বেশি, শুঁড় নিচু করে খাওয়ার শিক্ষা ততদিনে রপ্ত। কিন্তু কিছুতেই মনমতো হচ্ছে না গোলা দুধ। দু’দিকে মাথা নেড়ে ফোঁসফোঁস আপত্তি জানালে হতবুদ্ধি মানুষ একহাতা দুধগুঁড়ো বেশি দিয়ে মিশ্রণ ঘন করছে, তাতে আবার এক বালতি জল ঢেলে পাতলা করছে। তবু কিছুতেই হাতির দুধের ঘনত্ব মাপা যাচ্ছে না।
দক্ষিণাত্যের ভুট্টা খেতে চিতাবাঘ দেখা গেছিল, সে অনেক বছর আগেকার কথা। গ্রামবাসরা আতঙ্কে পিটিয়ে মারে বড় বাঘকে। কিছুক্ষণ পর দেখা যায়– দুটো মিউমিউ চিতার ছানা গর্ত থেকে বেরিয়ে মা খুঁজছে। গরিব এক গ্রামবাসী দু’টিকে কোলে তুলে রাজদরবারে নিয়ে আসে। ততদিনে রাজার রাজত্ব গেছে, রাজপাট বইছে ধমনিতে। প্রজার উপঢৌকন গ্রহণ করে চিতার বাচ্চা পালনে মন দেয় রাজকুমার। বেড়ালছানার আদরে বড় হয় ভাইবোন, চিতার গতিতে বৃদ্ধি পায় তাদের শক্তি। বনদপ্তর বাগড়া দেয়, এভাবে চিতা পোষা বেআইনি। শিখিয়ে-পড়িয়ে জঙ্গলে ছেড়ে দতে হবে। শুরু হল দেশীয় বর্ন-ফ্রি। রাজবাড়ির উঠোনে শিকারের পাঠশালা। হরিণের পিছনে সারাদিন শিকার-শিকার খেলা সেরে চিতাদ্বয় ডিনার করে মটনমুর্গি। ভাই-চিতা একদিন হরিণের শিঙের গুঁতোয় কুপোকাত। চিতাকে শিকার শেখাচ্ছে মানুষ, ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ডট্র্যাকে জঙ্গলের আবহ তৈরি করা গেছে কিন্তু বাঘের শিকার-কৌশল মনুষ্য সমাজে রাজরক্তেও বিরল। ভাইয়ের ক্ষত বহু চেষ্টা করেও সারে না। বোন একা বেড়ে ওঠ, একদিন তার ঠাঁই হয় অভয়ারণ্যে। শোনা যায়, বছর বছর ছানাপোনা নিয়ে রাজপরিবারের সঙ্গে দেখা করতে আসত মা-চিতা। কিলোদরে পোল্ট্রির মুরগি খেয়ে আবার ফিরে যেত বনে।
এমন নানা গল্প ছড়িয়ে আছে ভারতের বনে-বাদাড়ে।
আফ্রিকায় বোনোবো বা শিম্পাঞ্জিদের ভাগ্যেও কম হেনস্তা জোটে না। বেআইনি ব্যবসার শিকার বড় বনমানুষরা। কুড়িয়ে পাওয়া অনাথ বাচ্চাগুলোর ভাগ্যে স্যাংকচুয়ারি। দলে দলে ট্রেনিংপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবকরা বড় করছে বনমানুষের বাচ্চা, যাদের প্রবল শক্তির কাছে বছরখানেকের মধ্যেই হার মানে মানুষ। এক বছর বয়সের শিম্পাঞ্জির বাচ্চা খেলার ছলে মানুষের চুল ধরে টানছে আর মানুষের মনে হচ্ছে এই বুঝি খুলিসুদ্ধ ঘিলু উপড়ে আসবে– এসব গল্প স্যাংকচুয়ারির স্বেচ্ছাসেবিকার মুখে শোনা কথা।
অনাথ বন্যপ্রাণীর সংখ্যা সারা বিশ্বে নেহাত কম নয়, ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ফলে যা বাড়বে বই কমবে না। দলে দলে মানুষ নাম লেখাবে বন্যপ্রাণ উদ্ধার কাজে, তাদের কুর্নিশ। হেরে যাওয়া এমন এক যুদ্ধে সৈনিকদলে নাম লেখানোর নেপথ্যে থাকে অদম্য সাহস, আশাবাদী হৃদয়। বিনিময়ে সাময়িক সাফল্য আর শেষপাতে গভীর অবসাদ ছাড়া কিছু ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের সব গল্পই যে ট্র্যাজেডি, এমন নয়। সাফল্যের খবর শোনা যায় কান পাতলেই– মানুষের তত্ত্বাবধানে বড় হয়ে একদিন অনাথ বন্যশিশুরা ফিরে যাচ্ছে স্বাভাবিক বনজীবনে। বিজ্ঞানীরা নিয়মিত তাদের খোঁজ রাখছে, পরিজনহীন প্রাণীরা শারীরিকভাবে সুস্থ থাকছে কি না। হার্টরেট বলছে, হরমোনের লেভেল বলছে ওদের নিয়ে আর কোনও দুশ্চিন্তা নেই। অর্থাৎ মা-শিম্পাঞ্জির আর মা-মানুষের কাছে বড় হওয়ার মধ্যে কোনও পার্থক্যই নেই। বালতির দুধ খাওয়া হাতির বাচ্চা অনায়াসে একদিন দাপিয়ে বেড়াবে সাভানা ল্যান্ডস্কেপ।
সমীকরণ এত সরল হলে জৈবিক বিবর্তনের সূত্রটি এতদিনে ভুল প্রমাণিত হত। লক্ষ-কোটি বছরব্যাপী স্বতন্ত্র ইতিহাসের পথে হেঁটেছে এক একটি প্রজাতি। নির্দিষ্ট পরিবেশের প্রয়োজনে গড়ে উঠেছে তাদের শারীরিক গঠন এবং প্রক্রিয়া। একই নিয়মে গড়ে উঠেছে আলাদা আলাদা মন! জৈবিক আত্মীয়তা দূরসম্পর্কের হলে শরীর-মনের গঠনে অমিল বেশি, সম্পর্ক যত কাছের, তত বেশি মিল। সেইসব মিলের মধ্যেও বাসা বেঁধেছে সূক্ষ্ম সিগনেচার, যার ফলে অপমানের খুঁটিনাটি বোঝা সহজ নয়।
এই পুরো গল্পে মানুষ এমন একটি প্রাণী, যার মন বোনা আছে বাকি সবকিছুকে আত্মস্থ করার তাগিদে। সে কেবল নিজের প্রজাতিকে বোঝার দিকে মন না দিয়ে বুঝতে চেয়েছে বিশ্বচরার। কৌতূহলী মন নিয়ে গেছে অন্য প্রাণীর অন্দরমহলে। গাছপালা, পোকা, পাখি, বাঁদর, হাতি, বাঘ, ভল্লুক, মাছ তিমি– তারা কী খায় কোথায় থাকে কোন ভাষায় কথা বলে– সব কিছু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে মানুষ। উত্তরের আশায় যা কিছু দেখেছে, টুকে রেখেছে নোটবুকে। নোটবুকে ঘর ভরিয়ে ধারণা হয়েছে সে সর্বশ্রেষ্ঠ। সব পারে। যে মন নিয়ে সে একহাতে সৃষ্টি করে অনাথ-বন্যপ্রাণ, একই মন তার কৃতকর্মের অপরাধবোধ কমাতে বন্যপ্রাণ রক্ষা করবে, এ যেন তার বাঁ-হাতের খেলা। সংরক্ষণের প্রয়োজনে সে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির জন্য সাধ্যমতো ঘরদোরের ব্যাবস্থা শিখেছে, সুস্থ রাখার সবরকম আয়োজন শিখেছে ঠিকই, কিন্তু অপর-মনের খোঁজ করার কৌশল শেখা এখনও অনেক বাকি।
অন্য-মনের সন্দিহান পুরোপুরি করতে পারেনি বলেই সাউথ আফ্রিকার জঙ্গলে দেখা যায়, একদল অনাথ হাতি, যারা মানুষের হাতে বড় হয়েছে, দিব্যি সুস্থ শরীর নিয়ে জলে-জঙ্গলে ঘুরছে, কিন্তু বনের হাতিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার ভাষা তাদের শেখা নেই। তাদের ভোকাবুলারিতে খামতি, কারণ হাতি সমাজের অ-আ-ক-খ মানুষ তাকে শেখাতে পারেনি। এতে মানুষের দোষ নেই কোনও। মনে-প্রাণে হাতি হয়ে ওঠা মানুষের জিনে নেই, হাতি-শাবককে তার সম্পূর্ণ তালিম দেওয়া মানুষের স্বপ্নাতীত!
এই নিরুপায় অপারগতাটুকু মেনে নেওয়া মানুষের পক্ষে সহজ হয়নি। ডিনায়ালের বশবর্তী হয়ে মানুষ ভেবেছে তার জোড়ালো জটিল মনে দিয়ে আসলে সে সকলের মনের খবর রাখছে। অন্য মানুষের মনে খবর রাখতেই যে হিমশিম খায়, অন্য প্রজাতির মন বোঝা তার কাজ নয়– এই কথাটি বারবার শুনেও না শোনার ভান করে মানুষ সেবায় নিবেদিত। যে কারণে গাছের ডাল ভেঙে পড়া পাখির ছানা দেখলে সে নির্দ্বিধায় জুতোর বাক্সে তুলোর বিছানায় পাখি বড় করতে চায়। পোকাখোর পাখিকে ছাতুগোলা জল খাইয়ে ভাবে, আমি তো ওর ভালোই চেয়েছিলাম! ভালো চাওয়াটুকুতে কোনও খাদ নেই, কিন্তু কার কীসে ভালো, সেই বোঝাটুকুতে ফাঁক আছে। মানুষের মন তো! সে যে কেবল মানুষের মতো করেই ভাবতে শিখেছে, একথা মেনে নেওয়ার মনে জোর মানুষের নেই।
‘What is it like to be a bat’ নামে একটা গোটা বই লিখেছেন তমাস নেগেল। বইতে বলছেন, নিজস্ব জৈবিক-সামাজিক ইতিহাসের বাইরে গিয়ে ভাবার ক্ষমতা সকলেরই সীমিত। কিছুটা কল্পনা, বাকিটা বুদ্ধি দিয়ে খানিক এগোনো গেলেও নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি। একটি বাদুর কীভাবে ইকোলোকেশানের মাধ্যমে অন্ধকারে কোনও দেওয়ালে ধাক্কা না খেয়ে লাগাতার উড়ে বেড়াতে পারে, তার ভৌত-জীব-বিজ্ঞান মানুষের ঠোঁটস্থ, কিন্তু বাদুরের শরীর-মন নিয়ে নিয়ে উড়ে বেড়ানো, ঘুরে বেড়ানো, বাদুর-ছানা বড় করার অভিজ্ঞতা ঠিক কেমন, এসব বোঝাপড়া মানুষের নাগালের বাইরে। একইভাবে, দু’পায়ে হেঁটে-চলে বেড়ানোর অভিজ্ঞিতা থেকে বাদুর বঞ্চিত।
না-মানুষকে সম্পূর্ণ বুঝতে না পারার ব্যর্থতা মেনে নিয়ে এগোতে মানুষের কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। একমাত্র, তার ইগো কিছুটা ক্ষুণ্ণ হতে পারে। সবটা জানতে পারব না মেনে নিলে যেটুকু জানতে পারছি তার দৌলতেই অনেক ভালো কাজ করা সম্ভব। যেমন, বন্যপ্রাণ উদ্ধার করতে পারব না, তবে তার আগের পর্বে বন্যপ্রাণের ক্ষতি কীসে এবং সেই ক্ষতি এড়াতে কী কী করা উচিত, সে বিচার করতে পারব। মন দিয়ে করলে আর অন্য-মনের চিন্তা করে অসাধ্য সাধন করার প্রয়োজনই পড়বে না।
শেষ করব একটা অন্য-মনের গল্প দিয়ে। ফিনল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রপিক্যাল হাউজ। ইক্যুয়েটার বরাবর নানা দেশ থেকে গাছপালা এনে উপযুক্ত তাপমাত্রা বজায় রেখে বানানো হয়েছে বৃষ্টিবনের মতো একটা ঘর। সেখানে গৃহসজ্জার সামগ্রীর দাঁড় বসানো সাদা কাকাতুয়া। প্রতি হেমন্তে কাকাতুয়ার মনখারাপ হয়। খারাপ হতে হতে মন বিকল হলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মনোরোগীর কাছে। প্রতি বছর একই রুটিন। এদিকে কাকাতুয়ার চারদিকে চেনা গাছ, চেনা খাবার, চেনা আর্দ্রতা, চেনা আলোহাওয়া– আয়োজনে কোনও ত্রুটি রাখা হয়নি। ধরে নেওয়া হয়েছিল, এর বেশি ওর আর কী চাওয়ার আছে? তাও, বছর শেষের দিনগুলোয় স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সাব-জিরো অন্ধকারের প্রভাব পড়ছে ওর মনে। মানুষ ডাক্তার ওষুধ দিচ্ছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাউন্সেলিং করছে (!) দু’দিন ভালো থেকে ফিরে আসছে কাকাতুয়ার বিষাদ। কেন এমন হচ্ছে বারবার, কূলকিনারা পাচ্ছে না শুভানুধ্যায়ী মানুষ। ট্রপিকাল সোনার খাঁচায় আরেকটি কাকাতুয়া-মন খুঁজছে চলেছে বনের পাখিটি।