তিনি নজরুল মঞ্চে আমার প্রথম গান গাওয়ার সন্ধেয় হাজির ছিলেন অত্যন্ত পরিচিত সাংবাদিক শৌনক লাহিড়ীর সঙ্গে। কী নাম ভুলে গেছি, উনি কোথায় জানি না। কিন্তু উনি কী বলেছিলেন মনে আছে। আমার সঙ্গে শৌনকদার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন কেউ একটা। কেমন লাগল জিজ্ঞাসা করায় শৌনকদা সেই মেয়েটিকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন ‘আমি খুব একটা গান বুঝি না, এরা আজকালের মেয়ে, এরা বলতে পারবে। তাঁর দিকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম জানার জন্যে কেমন লাগল তাঁর আমার গান।
১১.
গোকুল বড় ডেঞ্জারাস ব্যাপার, যারা যারা গোকুলের কেস খেয়েছে, তারা নিশ্চয়ই জানে। যারা যারা খায়নি, তারাও গোকুলের গল্প শুনে মোটামুটি জানে ব্যাপারটা ‘বিপজ্জনক’। তারা যদি কংস টাইপের হয়, তাহলে তাদের কপালে যতটা বাঁচা ছিল দাপটের সঙ্গে, ততটা জীবন তাদের হয়ে ওঠে না। গোকুল ছিল বলেই কংসের জন্য একটা কৃষ্ণ থাকে সবসময়।
গোকুল একটা জায়গার নাম, কিন্তু মানুষের নামও হয়। ‘গোকুল’ বলে আমাদের পাড়ায় একটা মানুষ ছিল, আমার থেকে বয়সে একটু বড় হলেও আমরা তাকে গোকুল বলেই ডাকতাম। তার মুখটা মনে পড়ছে, আমার জ্ঞান হওয়া ইস্তক তাকে দেখেছি– একটা চোখ সম্পূর্ণ নষ্ট এবং মাথার ওপরের বেশিরভাগ অংশেই চুল ছিল না। বোমবার্স্ট, হ্যাঁ, বোমবার্স্ট, মানে পেটো– মানে লাল, সাদা পটাশকে নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে তার সঙ্গে পাথর, পেরেক, লোহার টুকরো– ইংরেজিতে যাকে বলে স্প্লিন্টার্স– তার মিশেলকে পেট্রোলে ভেজানো সুতলি দিয়ে টাইট করে বাঁধতে বাঁধতে উলের বলের মতো সুন্দর দেখতে বস্তুটি হল পেটো। ফাটলে শুধু আওয়াজ হয় না খোকা– পাথর, পেরেক বা লোহার টুকরোগুলো ছিটকে আহত বা নিহত করতে পারে যে কোনও জানোয়ারকে, মানুষকেও। সেও তো জানোয়ারই বটে। গোকুলের মুখের কাছে নাকি বোম ফেটেছিল। একটা চোখ হয়ে গেছিল পাথরের। মাথার একটা অংশে চুল গজায়নি আর। কামানো মাথায় সেলাইয়ের দাগ– সে এক অদ্ভুত মুখশ্রী, একটু বড় হতে গোকুল সানগ্লাস পরত, মনে পড়ছে।
কিন্তু বোমবার্স্ট করার ঘটনাটা পশ্চিমবঙ্গে খুব একটা বিরল নয়। ভারতের মানচিত্রে যেমন নানা রকমের ফসল বা খনিজ সম্পদের সম্ভার অনুযায়ী, জলবায়ু অনুযায়ী আলাদা আলাদা অংশ চিহ্নিত ম্যাপ দেখি, সেরকম বোমের ম্যাপ হলে পশ্চিমবঙ্গটা গাঢ় হয়ে থাকবে, গাঢ় লালও হতে পারে। ইতিহাস বলে, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে আমরা বাঙালিরা বোম বাঁধতে, ছুড়তে নাকি ভীষণ পারদর্শী। একটা সময় এ বঙ্গে বোধহয় সব বাড়িতেই একজন না একজন জানত কী সমীকরণে লাল, সাদা মেশালে পেটো তৈরি করা যায়। আজকে হয়তো তা নয়, আমার ছেলে হয়তো জানে না কীভাবে বোম বাঁধা যায়। যেমন আমিও জানি না তুবড়ি তৈরির অঙ্ক, কিন্তু ছোটবেলায় দেখেছি পাড়ার অনেকেই জানত, স্বপনকাকু তো ফাটিয়ে তুবড়ি তৈরি করত। যা আগেই তিনতলা বাড়ির উচ্চতা পর্যন্ত ছিটকে উঠে কয়েক মুহূর্ত ভরিয়ে দিত আমাদের পাড়াকে অদ্ভুত আলোর কারসাজিতে। ভাবতাম, আজও ভাবি– কী অদ্ভুতভাবে একটা মশলার সঙ্গে আর একটা মশলা বারুদে মিশলে তাতে আগুন দিলে আলোর মায়াবি কিন্তু জ্যামিতিক নকশা তৈরি হয়। কে আবিষ্কার করেছিল তুবড়ি, তার নাম আছে ইতিহাসে? জানি না, চেষ্টাও করিনি জানার, সে কাজ ঐতিহাসিকদের। শুধুমাত্র দেশ চালানোর রাজনীতির তথ্য আর তত্ত্বই তো ইতিহাস নয়, ইতিহাস সবারই আছে। সব কিছুরই আছে। অর্থনীতিতে নোবেল আছে, বাজির ক্ষেত্রে নেই। যদিও বাঙালি অর্থনীতিতে নোবেল পেয়ে বাংলার অর্থনীতির কী উন্নতি বা প্রসার হয়েছে, বুঝতে পারিনি এখনও অবধি, শুধু তো কয়েক ছটাক জমির লড়াইয়ের খবর পাই। কতটুকু অর্থ এক ছটাক জমির ক্যালিফোর্নিয়াতে, জানা নেই। রবীন্দ্রনাথ যেদিন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির খবর পেয়েছিলেন– তিনি নাকি টেলিগ্রামটা পড়ে বলেছিলেন– যাক, বিশ্ববিদ্যালয়টা তৈরিতে আর কোনও বাধা নেই। সেই রবীন্দ্রনাথের তৈরি শান্তিনিকেতনে এখন কাঠার দাম প্রায় নাকি পার্ক স্ট্রিটের মতো হয়ে গেছে। নোবেলজয়ী কয়েকশো বা হাজার মানুষ আছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বোধহয় একটাই। বোম থেকে রবীন্দ্রনাথে এসে কি বোম ফাটিয়ে ফেললাম? জানি না, জানতেও চাই না। আর ফাটালেও বেশ করেছি। কারও ফাটলে ফাটবে। আমার তো ফাটছে না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পড়ুন শিলালিপি-র আগের পর্ব: আমি গুন্ডা হলেও জনপ্রিয় গুন্ডাই হতাম
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বোমের কোনও দিন কোনও সম্পর্ক ছিল কি না জানি না, তবে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই বোম ব্যাপারটা জানতেন, তার জমিদারিতে নিশ্চয়ই কোনও না কোনও দিন বোম ফেটেছে। বোম নিয়ে কিছু কোনও দিন উনি লিখেছেন কি না জানি না। বোম ফাটিয়েছেন কি না, জানি না। কিন্তু বোমটা উনিও জানতেন। ১৯০৭ বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, হেমচন্দ্র কানুনগোকে প্যারিস পাঠান নিকোলাস আফ্রান্সকি নামে এক রুশ বিপ্লবীর কাছ থেকে বোম বাঁধা শিখতে। উনি নাকি কিংসফোর্ডকে মারার জন্য গুপ্তচরের সহায়তায় একটি ‘বই বোমা’ তৈরি করে তার বাড়ির বুকসেলফ পর্যন্ত পৌঁছে ফেলেছিলেন। কিন্তু কিংসফোর্ড আচমকা বদলি হয়ে যাওয়ায় তার সমস্ত আসবাবপত্র সরিয়ে ফেলা হয়। কিংসফোর্ডের সেই ‘বই বোমা’টি খুলে দেখা হয়নি, তাই তিনি বেঁচে গেছিলেন। কিন্তু সেই বই-বোমটি পরবর্তীকালে কোথায় পৌঁছেছিল, তা গুগ্ল থেকেও জানা যায় না। কিন্তু যেটা জানা যায়, ক্ষুদিরাম যখন শহিদ হলেন, তখন রবি ঠাকুরের বয়স ৪৭-এর মতো। গান্ধীজির নাকি দুঃখিত হয়েছিলেন দুই ইংরেজের প্রাণ যাওয়ায়। তিনি ক্ষুদিরামকে বাঁচানোর চেষ্টা করেননি, বরঞ্চ এই ধরনের চেষ্টাকে ‘হঠকারিতা’ বলেছিলেন। বাল গঙ্গাধর তিলক ফাঁসির বিরুদ্ধে লেখায় জেল হয়েছিল। এসব কথা চলে এল এই জন্য যে, বোম শেখা হয়েছিল ব্রিটিশদের তাক করতে। আজও এখনও সেই বোমের ব্যবহার হয় বুথ দখল করতে। সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আমারও সেরকম কিছু স্মৃতি দিন কাটায়, যাপন করে আমার সঙ্গে, থেকে গেছে। কিছু কিছু স্মৃতি আমি রেখে দিই ইচ্ছে করেই, আমাকে মোটিভেট করে সেসব আপাত যন্ত্রণার স্মৃতি। জীবনের কিছু ঘটনা আমার মনে দগদগে হয়ে আছে। আমার কিছু করার নেই, অপমানে কষ্ট না পেয়ে মনে রাখলে তার সুদে-আসলে ফেরত পাওয়া যায়। মনে পড়ে। মাঝে মাঝে খুঁজি তাদের। যেমন সেই ছোট্টখাট্টো মহিলা সাংবাদিককে। যিনি নজরুল মঞ্চে আমার প্রথম গান গাওয়ার সন্ধেয় হাজির ছিলেন অত্যন্ত পরিচিত সাংবাদিক শৌনক লাহিড়ীর সঙ্গে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কথা হচ্ছিল গোকুল নিয়ে, সেই থেকে এ মাথায় কীভাবে বোমের কথায় চলে এলাম, যাঁরা পড়লেন তাঁরা বুঝলেন। এভাবেই আসে, চিন্তারা ছিটকে চলে যায় এক স্মৃতি থেকে আরেক স্মৃতিতে। এক নাম থেকে আর এক নামে। প্রজাপতির মতো চিন্তা উড়তে থাকে। সবসময় সে চিন্তাকে বন্দি করা যায় না, পালন করা যায় না, আবার কিছু চিন্তাকে স্মৃতির লকআপ থেকে বের করা যায় না কস্মিনকালেও। সে চিন্তার জামিন পাওয়া সোজা হয় না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পড়ুন শিলালিপি-র অন্য এক পর্ব: বারবার শূন্য থেকে শুরু করতে হলেও রাজি আছি
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আমারও সেরকম কিছু স্মৃতি দিন কাটায়, যাপন করে আমার সঙ্গে, থেকে গেছে। কিছু কিছু স্মৃতি আমি রেখে দিই ইচ্ছে করেই, আমাকে মোটিভেট করে সেসব আপাত যন্ত্রণার স্মৃতি। জীবনের কিছু ঘটনা আমার মনে দগদগে হয়ে আছে। আমার কিছু করার নেই, অপমানে কষ্ট না পেয়ে মনে রাখলে তার সুদে-আসলে ফেরত পাওয়া যায়। মনে পড়ে। মাঝে মাঝে খুঁজি তাদের। যেমন সেই ছোট্টখাট্টো মহিলা সাংবাদিককে। যিনি নজরুল মঞ্চে আমার প্রথম গান গাওয়ার সন্ধেয় হাজির ছিলেন অত্যন্ত পরিচিত সাংবাদিক শৌনক লাহিড়ীর সঙ্গে। কী নাম ভুলে গেছি, উনি কোথায় জানি না। কিন্তু উনি কী বলেছিলেন, মনে আছে। আমার সঙ্গে শৌনকদার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন কেউ একটা। কেমন লাগল জিজ্ঞাসা করায় শৌনকদা সেই মেয়েটিকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন ‘আমি খুব একটা গান বুঝি না, এরা আজকালের মেয়ে, এরা বলতে পারবে। তাঁর দিকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম জানার জন্য কেমন লাগল তাঁর আমার গান। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনার কোমরের বেল্টটা খুব ভাল’। কী উত্তর দিয়েছিলাম পরের সংখ্যায় বলব। তবে বলে রাখি, বেল্টটা আমি ভুটান থেকে কিনেছিলাম, বেল্টটা স্টিলের ছিল।
….শিলালিপি-র অন্যান্য পর্ব…
শিলালিপি পর্ব ১০: আমি গুন্ডা হলেও জনপ্রিয় গুন্ডাই হতাম
শিলালিপি পর্ব ৯: বারবার শূন্য থেকে শুরু করতে হলেও রাজি আছি
শিলালিপি পর্ব ৮: শিলাজিৎ মুম্বইতে কী হারাবে পাগলা, মুম্বই হারিয়ে ফেলতে পারে শিলাজিৎকে
শিলালিপি পর্ব ৭: চাকরি ছাড়ার পরদিন দেরি করে ঘুম থেকে উঠেই চিৎকার– ‘আমি আর টাই পরব না’
শিলালিপি পর্ব ৬: পকেটমারির ভয়ে মাইনের দিন ১০ কিমি হেঁটে বাড়ি ফিরতেন বাবা
শিলালিপি পর্ব ৫: আমার জীবনে আমি চোরের জন্য বাজেট রাখি
শিলালিপি পর্ব ৪: বিদ্যাসাগরের কথা কেমন যেন ঘেঁটে গেছিল আমার সেদিন
শিলালিপি পর্ব ৩: আমি স্মার্ট চোর ছিলাম, ওয়ালেট বুঝে চুরি করতাম
শিলালিপি পর্ব ২: গুলি থেকে বাঁচিয়েছিল উত্তরের গলি, আমি ছিলাম সাক্ষী
শিলালিপি পর্ব ১: পাড়াতুতো সাহস আর পাড়াতুতো হিউমারেই আমি শিলাজিৎ