‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ পড়া আপনার নিয়মিত অভ্যেসের মধ্যে ছিল, তাই কোনও অভিনেতা খুব বিচলিত হয়ে থাকলে, কোনও ব্যাপারে অকারণ মেজাজ দেখিয়ে ফেললে, আপনি বলতেন, ‘মনে রাখবি, তোর ওপর নেই ভুবনের ভার।’ একজন ব্যস্ততম অভিনেতাকে বলতেন, ‘যখনই সময় পাবি, চোখদুটো বুজিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিবি। একজন অভিনেতার মস্তিষ্ক তত ঠান্ডা থাকবে, সে যত বিশ্রামের মধ্যে থাকবে। তার অভিনয়ের শৈলী ও কারুকাজ তাতে আরও নিপুণভাবে প্রকাশ পাবে।’
মহান বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে ২৪ বছর একাত্ম হয়ে থাকার পর নিজের মনে সাফল্যর মাপকাঠি যা-ই থাকুক না কেন, দর্শকের কাছ থেকে যখন একটা প্রশ্ন ধেয়ে আসে– আপনাকে বা তোমাকে বাংলার পরিচালকরা সঠিক বিচার করল না; মনে মনে মুচকি হেসে বলি– যাক, শেষ দু’দশকে আমার কৌতুক বা ভাঁড়ামোর ইনি একজন সাক্ষী। সবাই মুখ দিয়ে কমেডিকে খুব উচ্চাসনে জায়গা দিলেও, একজন কমেডিয়ানের পাসপোর্ট বা প্যান কার্ড তখনই সিলমোহর পায়, যখন তার উপর এক সিরিয়াস অভিনয়ের জোব্বা ওঠে। যদিও আমি বেশ কিছু সিরিয়াস চরিত্রের সুযোগ পেয়েছি। তবে আমার বুদ্ধিমত্তা বা অভিনয়শৈলী দিয়ে মানুষের মন-মুখ হাসিয়ে সারাটা জীবন যদি কাটিয়ে দিতে পারতাম, তাহলে তৃপ্তির অভাব থাকত না।
এই দেখো, ওপরের কথাগুলো মন ও কলম দিয়ে লিখলেও, এক তঞ্চকতার পাতলা চাদর আছে, তা নিজেকে অস্বীকার করি কী হিসাবে! না হলে বাংলা সিনেমার প্রাতঃস্মরণীয় রবি ঘোষের প্রায় সব কৌতুক মিশ্রিত চরিত্র দেখার পরও যেদিন ‘ঠগিনী’ দেখতে বসেছিলাম, সমাজের অভাবের তাড়নায় নিষ্পেষিত তিনটি প্রাণের চাতুর্য করে বেঁচে থাকার গল্পে যখন গণধোলাই খাওয়া রবি ঘোষের চরিত্রটিকে উৎপল দত্ত প্রশ্ন করেন– তোর খুব লেগেছে না রে? সেই দৃশ্যের রবি ঘোষের সুখের অভিব্যক্তি তাঁকে বাংলার একজন শ্রেষ্ঠ অভিনেতার গণ্ডির টপকে বিশ্ব অভিনেতার মর্যাদা দেয়। কারণ সাধারণ দর্শক হিসাবে আমিও ততদিন অবধি রবির কিরণে শুধু হাসতে চেয়েছি, তার ব্যতিরেক ঘটেনি।
কতই বা বয়স হবে আমার, যখন বাবার কথায়, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সিনেমার মধ্যে ‘অভিযান’ অন্যতম– শুনে টিভির সামনে বসেছিলাম। মেরেকেটে দশ থেকে বারো বছর হবে, সেই সিনেমার সুপুরুষ সৌম্যদর্শনধারী সৌমিত্রবাবুর ওরকম সর্দারসুলভ লুক আমার মনে ধরেনি। ওয়াহিদার প্রেমে পড়ার মতো মনও তৈরি নয়, ভাল লাগার বলতে রবি ঘোষ। হ্যাঁ, ওই গাড়িটার হেল্পার, তার সিটি, কিংবা চট করে গরুটাকে টপকে যাওয়াতেই আমার মন উঠেছিল। তারপর থেকে গাড়ির ড্রাইভারের তুলনায় বাস, ট্রাম, ম্যাটাডোরের হেল্পার আমার কাছে খুব বর্ণময় চরিত্র।
‘বাঘিনী’ সিনেমায় আমাদের বাঘাদার কামুক চোখের দৃষ্টি বাঘারূপী রবি ঘোষকে ভুলতে সময় নিয়েছিল। যাঁকে আমি ‘নির্জন সৈকত’-এর মোটা গলার গায়ক ওড়িয়া বাওনের চরিত্রে দেখেছি। ‘পলাতক’ সিনেমায় একটা ছোট চরিত্রে সদা ঢুলে পড়া মানুষটাকে বুকে টেনে নিয়েছি, তার এ কী রূপ! অভিনেতা হিসাবে অনুভূতির রসদ কতটা তৈরি করলে, তবে অনায়াসে একপ্রান্ত থেকে আর একপ্রান্তে বিশ্বাস নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। সেই ‘বাঘিনী’র চরিত্র তাঁর গ্রামের পোশাকের জংলা গন্ধ ছেড়ে দিয়ে হয়ে ওঠেন ‘জনঅরণ্য’-এর সুটেড-বুটেড নটবর মিত্তির, যাঁর প্রতিটা পদক্ষেপে একটা বুদ্ধি রয়েছে। শহর জীবনের বিত্ত-বৈভব তৈরির যোগাযোগ, কলর্গাল থেকে কোম্পানির মালিকদের মন জোগানোর শহুরে আদব-কায়দা।
এই দেখো, আমার মতো ফচ্কে কমেডিয়ান আবার সমাজের ব্যাপারে মাথা ঘামাতে শুরু করে দিল। না না, তার কারণ আর কিছু নয়, তার কারণ, স্বয়ং রবি ঘোষ। নিজেকে রবি ঘোষ প্রমাণ করার বা হয়ে ওঠার মতো ততটা মাথা খারাপ হয়নি, শুধু ভাবতে ভাবতেই মাথাটা কীরকম করে ওঠে! ‘তিন ভুবনের পার’-এর বাইসাইকেল ডান্স থেকে ‘বসন্ত বিলাপ’-এর সেই বাঙালি বেকার প্রেমিকের রিকশায় প্রেম নামানোর দৃশ্য থেকে ‘কাপুরুষ মহাপুরুষ’-এর শেষ দৃশ্যে বকধার্মিকের চাচা আপন প্রাণ বাঁচার দৌড়!
মৌচাক-এর রত্না ঘোষালের সঙ্গে সিনখানা বহু মানুষের পথপ্রদর্শক সিন। কারণ, ফাঁকা বাড়িতে বান্ধবীর সঙ্গে বাংলা হিসাব বোঝার যে দৃশ্য তো অনেক বাঙালিই নকল করেছে পরবর্তী কালে। সারা পৃথিবীর যত অভিনেতা আছে, তাঁদের প্রত্যেকেরই একবার ইচ্ছা করে, ‘গল্প হলেও সত্যি’র জুতোতে পা গলাতে। আমি যে সে পথেরই একজন পথিক, তা বললে ভুল হবে না। তবে দর্শকের আঁতে ঘা দিতে ভয় নয়, একেবারে মৃত্যুভয় হয়। কিন্তু, একটি ছবির চরিত্র আমাকে খুব ভাবায়– ‘আশিতে আসিও না’। সেই যে একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী তার লোভের মাশুল তাকেই দিতে হল, সেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব মিশ্রিত চরিত্রধারণ, আমার খুবই ইচ্ছা করে পর্দায় তুলে ধরতে।
ভুল বললাম, তুলে ধরব কী, আপনি আপনার কীর্তি দিয়ে আমার মতো ক্ষুদ্র অভিনেতার ইচ্ছাকে তুলে ধরে রেখেছেন। ভাবো ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো কথাখানা ঋত্বিকবাবু বললেও, আপনি বিশ্বাস করেছেন, তাই আপনার ভাবনার প্রতিটা চরিত্রই রক্তমাংসের। ‘আগন্তুক’-এর অভিনয় দেখে মনে হয় আপনি নিজের বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে আছেন। আপনার ড্রয়িংরুমের সোফাখানা চাক্ষুষ করেছি, তাই একটু বেশি করে মনে হল।
‘আপন মনে’ বইটিতে আপনার বাবার একখানি উক্তি আপনিই তুলে দিয়েছে। আপনার মাকে বলতেন আপনার বাবা– ‘ও আবার কী অভিনয় করবে, ওই তো চাকরবাকরের মতো চেহারা। আমি দ্যাখসি দুগ্গা বাঁড়ুজ্যেকে।’ এক কথায় দেখলে শ্লেষ মনে হবে, আর বৃহৎ অর্থে– একজন সঠিক চাকর।
সদর্থে পরিচারকই পারে একটা সংসারকে চার তেকাঠির মধ্যে লাল সুতোর শক্ত বেষ্টনীতে আটকে রাখতে। বাবুর চা, গিন্নিমার লেবুজল, তাতানের টিফিন, মাম্পির কেলগস থেকে দুপুরের চারপদ হয়ে রাতে ঘরে ঘরে গরম দুধ, বাবুর বরফ, গ্লাস, জল– সব পৌঁছে দিয়ে সেই সংসারের এককোণের বিছানায় চোখ বোজাতে। তাই তো করে গেলেন আপনি বাংলা সিনেমার সকল পরিচালকের কথা মতো চরিত্র পরিবেশন করে। চিরনিদ্রায় সেই স্টুডিওকেই বেছে নিলেন।
‘কানাঘুষো’ বলে বাংলা অভিধানে একটা শব্দ আছে। কানাঘুষোয় মানুষের কেচ্ছার ‘খবর’ আসে। কিন্তু আমার কাছে এসেছিল আপনার বেশ কিছু আলোকময় খবর। যেরকম, নকশাল আমলের সময় আপনি প্রত্যেকদিন বারোটা-সাড়ে বারোটার মধ্যে নাটকের স্টেজে পৌঁছে যেতেন। নাটকের হল-এর যিনি দায়িত্বে থাকতেন, তিনি জিজ্ঞেস করতেন, ‘এখন এলেন?’ আপনি বলতেন, ‘পাছে গন্ডগোলের মধ্যে পৌঁছতে দেরি হয়ে যায়, তাই আগেই চলে এলাম।’ আর চুপ করে, লুঙ্গিটি পরে আপনি খানিক ঘুমিয়ে নিতেন। এ তো আপনার কাছ থেকেই শেখা যে, কাজের জায়গায় কতটা সময়ানুবর্তিতা দরকার হয় একজন বাঙালি অভিনেতার বিশ্বশ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠার জন্য।
শুধু তাই নয়, ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ পড়া আপনার নিয়মিত অভ্য়েসের মধ্যে ছিল, তাই কোনও অভিনেতা খুব বিচলিত হয়ে থাকলে, কোনও ব্যাপারে অকারণ মেজাজ দেখিয়ে ফেললে, আপনি বলতেন, ‘মনে রাখবি, তোর ওপর নেই ভুবনের ভার।’ একজন ব্যস্ততম অভিনেতাকে বলতেন, ‘যখনই সময় পাবি, চোখদুটো বুজিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিবি। একজন অভিনেতার মস্তিষ্ক তত ঠান্ডা থাকবে, সে যত বিশ্রামের মধ্যে থাকবে। তার অভিনয়ের শৈলী ও কারুকাজ তাতে আরও নিপুণভাবে প্রকাশ পাবে।’ এমনটাই বলেছিলেন আমাকে, আমাদের শুভাশিস মুখোপাধ্যায়। আপনার বলা কথাগুলো তাই বারবার মনে পড়ে, আপনি হয়তো চলে গিয়েছেন, কিন্তু কী করে যেতে পারবেন! আপনি তো আমাদের মধ্য়ে এই কানাঘুষো কথার দৌলতেও রয়েই গিয়েছেন।
আপনার নাম রবি– সোম থেকে শনি হাড়খাটুনির পর আপনি নিস্তার দর্শকের। আয়েশ করে বসে মাংস-ভাত খেয়ে, মুখে পান গুঁজে উপভোগ করার নামই রবি। আবার ফিরে আসবেন, এই বাংলায়, আরও সেবা দিয়ে যাবেন দর্শমনকে। আর হঠাৎ করে চলে যাবেন না, যেমনটি ‘গল্প হলেও সত্যি’র শেষ দৃশ্যে চলে গেলেন। বড় কষ্ট হয়, চোখে জল আগে।
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী
এই সহস্রাব্দীতে বিশ্বের যে তিনটি বড় সংঘর্ষ, ইরাক, ইউক্রেন এবং ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন, সবক’টাই কূটনৈতিক এবং শান্তিপূর্ণভাবে মিটিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু ‘নিয়ন্ত্রিত’ভাবে যুদ্ধ জিইয়ে রাখা হয়েছে। আর তার জন্য বিশ্বজুড়ে নির্মিত হয়েছে বিপুলায়তন স্যাটেলাইট-টিভি নামক এক অ্যাম্ফিথিয়েটার।