অঘ্রাণ মাসে কি এমন বৈশিষ্ট্য যে, নবান্নটা তখনই করতে হয়? মাসের নামটা খেয়াল করেছেন? অগ্রহায়ন। ‘অগ্র’ মানে আগে, আর ‘হায়ন’ মানে বছর। তবে কি কোনও এক সময় এই মাস থেকেই বছর শুরু হত? কবে এমন হত? কবে থেকে বদলে গেল? সেসব কথার উত্তর মেলে না। এই মাসের আরেকটি নামও আছে, ‘মার্গশীর্ষ’। যদিও অনেকেই বলেন মৃগশিরা নক্ষত্রের বিশেষ উজ্জ্বলতা এই মাসে দৃশ্য হয়, আর তার থেকেই মার্গশীর্ষ নামের উৎপত্তি। কিন্তু কেমন যেন মনে হয় এই বিশেষ উজ্জ্বলতা নদীতে ভেসে থাকে বাণিজ্য তরীগুলিকে পথ নির্দেশিকা পেতে সাহায্য করত বলেই মার্গ অর্থাৎ পথ খুঁজে পাওয়ার মাস বলেই অঘ্রাণ চিহ্নিত ছিল।
না কোনও দেবতা বা দেবীর মূর্তি নেই, নেই কোনও মন্ডপ বা ঢাক-ঢোলের ঢক্কানিনাদ, তবু এক অনন্য উৎসব, অতি পুণ্যের নবান্ন। নতুন ধান এসেছে, সেই ধান কুটে চাল, আর সেই চালের পায়েস রেঁধে গৃহ বা গ্রাম দেবতাকে নিবেদন করে প্রসাদ নেওয়া। কোথাও বা পায়েস নয়, কাঁচা দুধে মটরশুঁটি, কচি বাঁধাকপির পাতা এমন সব শীতকালীন সবজি কুচি করে কেটে তার সঙ্গে নতুন ধানের চাল, সদ্য পাওয়া খেজুর গুড় মিশিয়ে এক ভোজ্য। আসলে অন্নই তো প্রাণ, অন্নই যে মা ধরিত্রীর আশীর্বাদ, তাই তাকে বরণ করে ঘুরে তুলতে হবে বইকি। আর সে উৎসব তো বিশ্বজুড়েই চলে আসছে সেই কবে থেকে। মানুষ যবে থেকে ফসল ফলানোর বিদ্যা অর্জন করেছিল, তবে থেকেই নাকি সভ্যতার শুরু, তার আগে তো কুড়িয়ে-বাড়িয়ে উদরপূর্তি। সভ্যতা, সংস্কৃতি সবই জন্ম নিল ক্রমে ক্রমে সেই বিদ্যার প্রসার হলে। সেই দিক থেকেও ফসলের উৎসবখানি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সেই অনুষঙ্গেই কি নবান্নের অনুষ্ঠানের সঙ্গে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে অন্ন নিবেদনের রীতি প্রচলিত? পূর্ববর্ণিত ভোজ্যটি প্রস্তুত করে সরায় করে খোলা জায়গায় রেখে দিতে হয়, কাকের উদ্দেশ্যে। হিন্দু পুরাণ মতে, কাক বা বায়স হল মৃত্যুর দেবতা, যমের বাহন। লোকান্তরিত পূর্বপুরুষ যমলোকে যাতে তৃপ্ত হতে পারেন। তাই হিন্দুদের আদ্যশ্রাদ্ধের সময় কাককে দেওয়া হয় পিণ্ডের কিয়দাংশ। কাক তৃপ্ত হলে পূর্বপুরুষও অন্ন লাভ করবেন।
নবীন শস্যকে বরণ করে ঘরে তোলার রীতি যে অতি প্রাচীন, সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বের নানা দেশে মূল খাদ্য শস্যের ফসল ওঠে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, সে দেশের জলবায়ু আর ফসলের নিজস্ব চরিত্র অনুযায়ী। কিন্তু যখনই আসুক, সে যে মা ধরিত্রীর দান। আরও লক্ষ্য করার বিষয়– পৃথিবীর সর্বত্রই অন্ন, তা সে ধান, গম, জোয়ার, বাজরা যাই হোক না কেন, তাকে ‘মাতৃরূপ’-এই গ্রহণ করার রীতি। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে ফসলের উৎসব পালিত হয় হিন্দুরীতি মেনে। উৎসবের মাসখানেক আগে থেকে খেতে গিয়ে পরিবারের লোকজন গিয়ে মাঠের যাবতীয় অশুভ আত্মাগুলিকে বিতাড়ন করতে থাকেন। তারপর খানিক পরিমাণ ধান কেটে ফসলের দেবীকে উৎসর্গ করে তবেই বাকি ধান কাটার পালা। এই অনুষ্ঠান সাধারণভাবে মে-জুন মাস নাগাদ পালন করা হয়ে থাকে। চিন, তাইওয়ান কিংবা ভিয়েতনামে ফসল কাটার উৎসব পালিত হয় সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। সে উৎসবের সঙ্গে চাঁদ, বিশেষ করে পূর্ণিমার এক নিবিড় সম্পর্ক আছে। বস্তুত উৎসবে ‘মুনকেক’ নামের এক অতি সুস্বাদু খাবার তৈরি করেন সেখানকার মহিলারা। চাঁদের অনুষঙ্গ বা চান্দ্র মাস অনুযায়ী বর্ষপঞ্জি মেনেই ক্ষেত্র উৎসবের আয়োজন হয় অনেক দেশে।
‘The Myth of Mexico and Peru’ বইয়ের লেখক Lewis Spance দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলিতে ফসলের দেবী সম্পর্কে লিখেছেন, ‘The Mamas: Spirits which were supposed to be instrumental in forcing the growth of maize and other plants were the mamas. We find a similar conception among many Brazilian tribes to day so that the idea appears to have been a widely accepted one in South American countries. The Peruvian countries called such agencies ‘mothers’ adding to the generic name that of the plant or herb with which they are specially associated’. জারামাম্মা বা সারামাম্মা যেমন মেইজ শস্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। ভুট্টার গাছের গুচ্ছ সাজিয়ে, ঠিক যেমন ধানের ছড়া বেঁধে লক্ষ্মীর প্রতিমা অর্থাৎ শস্যদেবীর প্রতীক ব্যবহৃত হয় আর কি, পূজিত হন মেক্সিকোতে। এই বাংলায় সারা বছর ধরেই ধান পূজিত হয় লক্ষ্মীর প্রতীকী বিগ্রহরূপে। খেয়াল করা যেতেই পারে ‘মাম্মা’ শব্দটি সেক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন জাগতে পারে, বাংলায় ধান ওঠে তো দু’-দু’বার, তবে নবান্ন শুধু একবার কেন? অঘ্রাণ মাসে কি এমন বৈশিষ্ট্য যে, নবান্নটা তখনই করতে হয়? মাসের নামটা খেয়াল করেছেন? অগ্রহায়ন। ‘অগ্র’ মানে আগে, আর ‘হায়ন’ মানে বছর। তবে কি কোনও এক সময় এই মাস থেকেই বছর শুরু হত? কবে এমন হত? কবে থেকে বদলে গেল? সেসব কথার উত্তর মেলে না। এই মাসের আরেকটি নামও আছে, ‘মার্গশীর্ষ’। যদিও অনেকেই বলেন মৃগশিরা নক্ষত্রের বিশেষ উজ্জ্বলতা এই মাসে দৃশ্য হয়, আর তার থেকেই মার্গশীর্ষ নামের উৎপত্তি। কিন্তু কেমন যেন মনে হয় এই বিশেষ উজ্জ্বলতা নদীতে ভেসে থাকে বাণিজ্য তরীগুলিকে পথ নির্দেশিকা পেতে সাহায্য করত বলেই মার্গ অর্থাৎ পথ খুঁজে পাওয়ার মাস বলেই অঘ্রাণ চিহ্নিত ছিল। বাণিজ্য তরীর কথা না হয় মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু এই সময় বাণিজ্যের বৃদ্ধি হত কি? নয়ই বা কেন? সোনার ধানে মাঠ ভরে আছে, সম্বৎসরের খাওয়ার মতো শস্য আছে ঘরে, প্রকৃতি অনেক শান্ত, ঝড় তুফানের বিশেষ ভয়ডর নেই, এই তো প্রকৃষ্ট সময় নদী বেয়ে দূরদূরান্তে পসরা নিয়ে যাওয়ার। শরতের উৎসব সুসম্পন্ন, হিমের শীতলতা এখনও জাঁকিয়ে বসেনি, ফলে সব মিলিয়ে দেশান্তরে পসরা নিয়ে যাওয়ার এই তো সময়।
আবার অন্যদিক থেকে এই মৃগশিরা নক্ষত্রের গুণের অবধি নেই। বাংলা বছরের নানা মাসের নাম নানা নক্ষত্রের নাম থেকেই এসেছে। কিন্তু নক্ষত্র তো সাতাশটি আর মাসের সংখ্যা মাত্র বারো। অবশ্য বারো মাসের জন্য বরাদ্দ আছে পনেরোটি নক্ষত্র। প্রতি মাসের পূর্ণিমা তিথিতে যে নক্ষত্রের অধিপতি চন্দ্র, সেই নক্ষত্রের নামানুসারেই সেই মাসের নামকরণ করা হয়ে থাকে। বৈশাখে যেমন বৈশাখী, জৈষ্ঠে জ্যাষ্ঠা তেমনই আশ্বিনে অশ্বিণী, কার্তিকে কৃর্তিকা আবার আঘ্রাণে মৃগশিরা। আষাঢ়, ভাদ্র আর ফাল্গুন মাসে চন্দ্র দু’টি করে নক্ষত্রের অধিপতি, পূর্বাষাঢ়া, উত্তর ষাড়া, পূর্বভাদ্র, উত্তর ভাদ্র, পূর্ব ফাল্গুন আর উত্তর ফাল্গুন। দক্ষ প্রজাপতির সাতাশটি কন্যার সঙ্গে একত্রে বিয়ে করে বসেন চন্দ্র, একথা পুরাণে লেখা। প্রতি মাসের সাতাশ দিন একটি করে নক্ষত্রের সঙ্গে বিহার করেন পতি চন্দ্র। তাই চান্দ্র মাস সাতাশ দিনের। জ্যোতিষ মতে, মৃগশিরা নক্ষত্রের জাতক শিল্প অনুরাগী ও নানা বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু প্রকৃতির হয়ে থাকেন। ইংরেজিতে তাই এই নক্ষত্রের অপর নাম ‘সার্চিং স্টার’।
আরও পড়ুন: বিশ্ব শিশু দিবসের বক্তৃতা খেয়ে পেট ফুলে ওঠে পথশিশুদের
ঋগ্বেদের কালে শরতের অন্তে সন্ধ্যার পরে মৃগ নক্ষত্রের উদয় হলে রুদ্র যজ্ঞের আয়োজন করা হত অঘ্রাণ পূর্ণিমায়। সেই ছিল মহাপুণ্যের যজ্ঞ। রাজা ধন্য হতেন রুদ্রকে সন্তুষ্ট করে, যজ্ঞের থেকে ধূম, ধূমের থেকে পর্জ্জন্য, অর্থাৎ মেঘ, মেঘ থেকে বৃষ্টি আর বৃষ্টি থেকে শস্য, শেষে শস্য থেকে প্রাণ– এই ছিল যজ্ঞের যুক্তি। রুদ্র তুষ্ট হলে শস্য শ্যামল হবে ধরিত্রী। সেকাল অনেক দিন পার হয়ে গেছে, তবু নতুন ফসলকে বরণ করে ঘরে তোলা আর ভবিষ্যতে আরও সমৃদ্ধির জন্য প্রকৃতিকে তুষ্ট করার রীতি আজও অব্যাহত। শুধু কি ধান উঠলে? ধান পোঁতার দিন, তারপর ধানের বুকে ‘দুধ’ আসার সময়, আবার ফসল কেটে তোলার সময় আবার ধানের বরণ চলে। বাঁকুড়া জেলায় ‘ধান পাকা’ নামে এক আচার পালিত হয়। আশ্বিন মাসের সংক্রান্তি দিবসে গেরস্ত চাষির বাড়ি থেকে এক মুনিষ তিনটি শরডাল, সাত অথবা নয়টি শালের ফোড়, খানিক আতপ চাল আর একখানি নামাবলি নিয়ে মাথায় করে চাষের মাঠে যায়। সেখানে ঈশান কোণে একটি শরডাল পুঁতে শালের ফোড়গুলিকে পাশে রাখে, তারপর মাঠে আতপ চাল, সে অবশ্য সামান্য পরিমাণে খেতের চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। তখন একটি ছড়া বলতে থাকে। সে বলে, লোকের ধান হুলুম খুল, আমার ধান শুধুই ফুল।
এরপর আবার বাড়ি ফিরে একটি শরডাল গোবর গাদায় আর আরেকটি ডাল তুলসী তলায় পুঁতে রাখে। শালের ফোড়গুলিও সেখানে অল্প অল্প করে রাখা হয়। একটা পুরো দিন পার হলে, শরডালগুলি নিয়ে এসে বাড়ির বাতায় গুঁজে রাখা হয়। লোকবিশ্বাস, এতে ধানের ফলন ভালো হয়। মূল লক্ষ্য থাকে নিয়মিত ধানের পরিচর্চা, এবং সময়ে সময়ে সজাগ হয়ে চাষের তদারকি করা।
সোনালি ধানে ভরা মাঠে হেমন্তের স্নিগ্ধ প্রভাতে গৃহবধূরা গলবস্ত্র হয়ে যখন চাষের মাঠে আসেন, তাঁদের হাতের সামান্য অর্ঘ্যের ডালি যেন মিলেমিশে একাকার হয় প্রকৃতির অকৃপণ সম্ভারের সঙ্গে। মাঠের ধানে ঢেউ খেলে যায় শীতল বাতাস, চাষি ঘরে বয়ে আনে আনন্দ উচ্ছাস।