বড়ছেলে রথীন্দ্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক হয়তো একটু জটিলই। শমীন্দ্রনাথ আর রথীন্দ্রনাথ এই দুই পুত্রের মধ্যে অকাল-প্রয়াত ছোট শমী তাঁর খুবই প্রিয়। শমীর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কবিপ্রতিভার স্ফুরণ দাদা রথীন্দ্র লক্ষ করেছিলেন। শমীর অকালপ্রয়াণের ফলেই হয়তো রথীর ওপরে প্রত্যাশার চাপ বেশি। রথীন্দ্রনাথকে পিতা তাঁর নানা আদর্শের পরীক্ষাক্ষেত্র হিসেবেই যেন খানিক বিচার করছেন।
বাংলা সিনেমায় দাপুটে বাবার ভূমিকায় অভিনয় করতেন দু’জন– কমল মিত্র আর ছবি বিশ্বাস। বাপরে বাপ! ‘দেয়া-নেয়া’ গত শতকের ছ’য়ের দশকের ছবি। শিল্পপতি বাবা কমল মিত্র গায়ক ছেলে উত্তমকুমারকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইতেন, সে দেখার মতো। ‘সপ্তপদী’ তারাশঙ্করের গল্প থেকে বানানো ছবি। তাঁর গল্প-উপন্যাসে দুইকালের দ্বন্দ্ব উঠে আসে। পূর্ববর্তী প্রজন্মের সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মের তর্ক-বিতর্ক হয়। নতুন সময়ের মূল্যবোধ আগের প্রজন্মের অভিভাবকরা মেনে নিতে পারেন না। ‘সপ্তপদী’তে বাবা ছবি বিশ্বাসের নির্বন্ধে তাই উত্তম-সুচিত্রার, কৃষ্ণেন্দু-রিনা ব্রাউনের, ব্রাহ্মণ-খ্রিস্টানের বিয়ে আটকে গেল। রবীন্দ্রনাথ ছবি বিশ্বাস কিংবা কমল মিত্রের মতো দাপুটে বাবার ভূমিকায় অভিনয় করবেন, তা আমরা ভাবতেই পারি না। তাছাড়া পিতা দেবেন্দ্রনাথের চাপ তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে কখনও কখনও। জমিদারি সেরেস্তা থেকে যৌতুকের টাকা পাওয়া যাবে, সে-কথা ভেবেই মেয়েদের খুবই কম বয়সে বিবাহ দিয়েছিলেন। বলেন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর তাঁর পত্নী যাতে বিবাহ না করেন তার জন্য পিতা দেবেন্দ্রনাথের দূত রবীন্দ্রনাথ। ব্রাহ্ম সমাজের ধর্মের সঙ্গে তাঁর মনের যোগ তেমন ছিল না, তবে পিতা যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন সে-কথা তেমন খোলসা করে বলতে পারেননি। পরে দেবেন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর অনেকটাই চাপমুক্ত। রথীন্দ্রের সঙ্গে বিধবা প্রতিমার বিবাহ দিতে অসুবিধে হল না। বিদেশে ইংরেজি বক্তৃতা ‘দ্য রিলিজিওন অফ ম্যান’– ১৯২২-এর হিবার্ট লেকচার গ্রন্থাকারে প্রকাশ করল লন্ডনের প্রকাশনা সংস্থা জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন। সে বক্তৃতা নিবন্ধের গ্রন্থরূপের সপ্তম অধ্যায়ের নাম ‘দ্য ম্যান অফ মাই হার্ট।’ সেখানে রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন মনের মানুষের সন্ধান প্রাতিষ্ঠানিক পারিবারিক ধর্মের পরিসরে তিনি পাননি। বুঝতে অসুবিধে হয় না ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করতে হত পিতার জন্যই, সেখানকার আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া গান লেখা সবই করেছেন তবে মনের সম্পূর্ণ সংযোগ ছিল না, মানিয়ে নিতে হয়েছিল। সেই মানসিক টানাপড়েনের কথা এই অধ্যায়ে স্পষ্টই জানিয়েছেন। এমন যে মানুষটি, তিনি কি পুত্রের পক্ষে কমল মিত্র কিংবা ছবি বিশ্বাসের মতো দাপুটে পিতা হয়ে উঠতে চাইবেন!
চাওয়ার কথা নয়, তবে গোচরে-অগোচরে কত কী ঘটে! বড়ছেলে রথীন্দ্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক হয়তো একটু জটিলই। শমীন্দ্রনাথ আর রথীন্দ্রনাথ এই দুই পুত্রের মধ্যে অকাল-প্রয়াত ছোট শমী তাঁর খুবই প্রিয়। শমীর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কবিপ্রতিভার স্ফুরণ দাদা রথীন্দ্র লক্ষ করেছিলেন। শমীর অকালপ্রয়াণের ফলেই হয়তো রথীর ওপরে প্রত্যাশার চাপ বেশি। রথীন্দ্রনাথকে পিতা তাঁর নানা আদর্শের পরীক্ষাক্ষেত্র হিসেবেই যেন খানিক বিচার করছেন। তাঁর সমস্ত জীবন একদিক থেকে রবীন্দ্রনাথের জন্যই নিবেদন করেছিলেন। ইলিনয়তে কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে যাওয়া পিতারই পরিকল্পনায়। পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে থেকে না-যাওয়া, গবেষণায় অগ্রসর না-হওয়া, দেশে ফিরে অন্য কাজে আত্মনিয়োগ না-করা সবই এক অর্থে রবীন্দ্রনাথের জন্যই। পিতার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা তাঁর মধ্যে ক্রিয়াশীল। যে প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তারই জন্যও কি রথীন্দ্রনাথও নিজেকে নিবেদন করেননি? জীবনের শেষ পর্বে সেই প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা রথীন্দ্রকে অসম্মান করেছেন, পিতার জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে পুত্র রথীন্দ্রকে আমন্ত্রণ পর্যন্ত করেনি।
এই রথীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের ওপরে পিতা রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের চাপ যে পড়েছিল, তা কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই। আর সেই চাপের জন্য রবীন্দ্রনাথ খানিকটা দায়ী, সন্দেহ নেই। আপাতত একটা পরোক্ষ অথচ প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেশ করা যাক। রথীন্দ্রনাথের একটি কবিতা সংশোধন করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। সেই সংশোধন চিহ্ন অনেক কথা বলে। নিচে রথীন্দ্রের কবিতা-পঙ্ক্তির পাশে প্রথম বন্ধনীর মধ্যবর্তী অংশে রবীন্দ্রনাথের সংশোধিত পঙ্ক্তিগুলি রাখা হল। প্রেমের একটি কবিতা। যৌবনে রমণীয় স্মৃতি, মল্লিকা নামক রমণীর আগমনের সূত্রে ফিরে আসছে।
ছিল একসময়
মেয়েদের আঁচলের হাওয়ায় দুলিয়ে দিত মন ( মেয়েদের উড়ে পড়া আঁচলের প্রান্ত দুলিয়ে দিত মন)
তাদের ছোঁয়া গায়ে দিত কাঁটা (তাদের এলোচুলের একটুখানি ছোঁয়া গায়ে দিত কাঁটা)
দেখতে কেমন, বয়স কাঁচা না পাকা ছিল না খেয়াল (দেখতে কেমন বয়স কচি না কাঁচা ছিল না খেয়াল)
কিন্তু লাগত ভালো, এই পর্যন্ত। (কিন্তু লাগত ভালো )
কখন একদিন দেখতে লাগলুম স্বপ্ন; (কখন এই সব আবছায়া জমে উঠল একটি মূর্ত্তিতে)
কত জনের মাধুরী চুনে গড়লুম কল্পনার এক মূর্ত্তি, (মাধুরীর ছায়াপথে ফুটে উঠল কল্পনার একটি তারা)
সব কাজের ফাঁকে উঠতে লাগল মনে (কাজের ফাঁকে ফাঁকে দেখা দেয় আর ঢাকা পড়ে)
সেই একটি মোহন ছবি।
তারই ধ্যানে রইলুম ডুবে, (ডুবিয়ে দেয় ধ্যানের অতলে)
নিদ্রাহীন রাতে কেঁদে উঠে ধরতে যাই সেই মায়াবীকে, (মায়ামৃগী ভুলিয়ে নিয়ে যায় স্বপ্নের গহ্বরে)
যৌবনের উচ্ছ্বাস ভরে করলুম এক মানসসুন্দরীকে নিত্য সহচর, (মানসসুন্দরী ক্ষণে ক্ষণে চমক লাগিয়ে দেয় প্রহরগুলিতে)
ভালোবাসলুম তাকে পাগলের মতো। (ফেনিয়ে তোলে ভালোবাসার পাগলামি)
মল্লিকা যখন এল ঘরে,
ভাবলুম প্রিয়ার ছদ্মবেশে আমার সেই যৌবনের স্বপ্ন
বুঝি এসে দাঁড়ালো পাশে।
কত যে তার ছলনা, আমি বুঝেও বুঝি না,
তাতে সে ভারি খুশি।
ছেলের লেখায় যা ছিল মেয়েদের আঁচলের হাওয়া, বাবার লেখায় তা হয়ে উঠল উড়ে পড়া আঁচলের প্রান্ত। ছেলের লেখায় ছিল তাদের ছোঁয়া বাবার সংশোধনে হল এলোচুলের একটুখানি ছোঁয়া। এসব কি নিতান্তই সংশোধন? অনুভূতির উদ্দীপনের বস্তুগত কারণ যে বদলে যাচ্ছে। আর যখন ভালোবাসলুম তাকে পাগলের মতো বাবার সংশোধনে ‘ফেনিয়ে তোলে ভালোবাসার পাগলামি’ হয় তখন বিরক্তিই লাগে। ‘ফেনিয়ে তোলে’ এই ক্রিয়াপদ নেতিবাচক। এই নেতিবাচকতা রথীন্দ্রের লেখায় ছিল না। রথীন্দ্র কবিতা লিখতেন না, এই কাটাকুটি আর সংশোধনের চাপে কবিতা লেখার ইচ্ছে হয়তো মরেই গিয়েছিল। বুঝতে পেরেছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথের ছেলে হয়ে কবিতা লেখা যায় না! তবে রথীন্দ্রনাথের বাংলা গদ্যের চালটি বেশ আর ইংরেজি লেখার হাতটি কিন্তু চমৎকার। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের ইংরেজি নিয়ে নানা সময়ে নানা কুণ্ঠা প্রকাশ করতেন। ইংরেজি যে তাঁর স্বাভাবিক ভাবের ভাষা নয় বোঝা যায়। সে ইংরেজির মধ্যে সাবেকিয়ানার ছোঁয়া। রথীন্দ্রের ইংরেজি গদ্য কিন্তু সহজ, সচল। পড়তে ভালো। রথীন্দ্রের ইংরেজি স্মৃতিগ্রন্থ On the Edges of Time সেই সাক্ষ্য বহন করছে। পিতা সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘Intensely human as he was, Father’s was yet a most complex character.’ নিজের কথা নিচুগলায় কখনও কখনও ঈষৎ তির্যকতায় নানা কথা বলতে পেরেছেন সে লেখায়।
আরেকটা কথা। পিতা রবীন্দ্রনাথও কি কখনও ভাবেননি এসব? লিখেছিলেন, ‘আমি ভাবি আমি বুঝি পথের প্রহরী,/ পথ দেখাইতে গিয়ে পথ রোধ করি।’ ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে পুত্রের জন্য লেখা এই ‘আশীর্বাদ’ কবিতায় ‘পথ রোধ করি’ স্বীকারোক্তিটিও যেন ভুলে না যাই।