আজ ১৬ দিন অতিক্রান্ত। কিন্তু, এখনও অবধি টানেলের মধ্যে থাকা ওই ৪১ জনকে নিরাপদে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে জার্মানি থেকে আনা অত্যাধুনিক আগার মেশিনটি ধাতব গ্রিডের গায়ে ধাক্কা লেগে বন্ধ হয়ে যায় হঠাৎ–ই। সে–সঙ্গে আরও একটি খবর পেলাম, আন্তর্জাতিক টানেলিং বিশেষজ্ঞ আর্নল্ড ডিক্সের মুখে শোনা গেল সংশয়ের কথা। উনি বলেন, ‘এখন থেকে এক মাস এই উদ্ধারকার্যসম্পন্ন হতে যে কোনও সময় লাগতে পারে।’ বলি, হচ্ছেটা কী!
‘মানুষ গড়েছে ঈশ্বর,
ঈশ্বর বানায়নি মানুষ কোনও’
নভেম্বর ১২, ভেঙে পড়ল একটি নির্মীয়মাণ সুড়ঙ্গপথ, টানেলের মধ্যে তখনও ৪১টি প্রাণ। ধর্মীয় আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে ভোট জেতার রাজনীতি আর কত সহস্র প্রাণ কেড়ে নেবে, তার কোনও ইয়ত্তা নেই! হয় তা আমরা, চিন্তাশীল মানুষেরা ঠেকাব, না–হয় প্রকৃতি। আর, প্রকৃতি যদি উদ্যত হয় খড়্গহাতে, তবে রাজা–প্রজা কারও ধার ধারবে না। শেষে শুধুই পড়ে থাকবে শূন্যতা আর প্রিয়জনের রক্ত। অন্যান্য দেশ হলে হয়তো আশা করা যেত, স্থগিত করা হত ক্রিকেট বিশ্বকাপ। কিন্তু না, এ–দেশে দরকার— এন্টারটেইমেন্ট, এন্টারটেইনমেন্ট এবং এন্টারটেইমেন্ট!
হিমালয়ের ইন্ডিয়ান প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেট যেখানে মিলেমিশে ঠেলাঠেলি বাঁধায় সেটা হল মেইন সেন্ট্রাল থ্রাস্ট (MCT)। উত্তরাখণ্ডের সিলকিয়ারা থেকে উত্তরকাশীর দণ্ডালগাঁও-এর মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য একটি সুড়ঙ্গ কাটা হচ্ছিল। এটি মূলত চারধাম প্রকল্পের অংশবিশেষ। সুড়ঙ্গটি নির্মিত হলে উত্তরকাশী থেকে যমুনোত্রী ধাম যাওয়ার দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার কমবে। সহজ হবে তীর্থযাত্রা। প্রকল্পের সুড়ঙ্গটির দৈর্ঘ্য চার কিলোমিটার। আর, মেইন সেন্ট্রাল থ্রাস্ট–এর দূরত্ব এখান থেকে উত্তরে সামান্য কিছু। টানেল খুঁড়তে গিয়ে সেখানে কোনওরকম ধাক্কা লাগলে কী হতে পারে, সেটা কি একবারও ভাবতে পারছেন?
আজ ১৬ দিন অতিক্রান্ত। কিন্তু, এখনও অবধি টানেলের মধ্যে থাকা ওই ৪১ জনকে নিরাপদে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে জার্মানি থেকে আনা অত্যাধুনিক আগার মেশিনটি ধাতব গ্রিডের গায়ে ধাক্কা লেগে বন্ধ হয়ে যায় হঠাৎ–ই। সে–সঙ্গে আরও একটি খবর পেলাম, আন্তর্জাতিক টানেলিং বিশেষজ্ঞ আর্নল্ড ডিক্সের মুখে শোনা গেল সংশয়ের কথা। উনি বলেন, ‘এখন থেকে এক মাস এই উদ্ধারকার্যসম্পন্ন হতে যে কোনও সময় লাগতে পারে। ওদের নিরাপদে ওখান থেকে বের করা এখন আমাদের টপ মোস্ট প্রায়োরিটি।’ সেজন্য আপাতত উদ্ধারকাজ স্থগিত রাখা হয়েছে। এরপর হাতের ভরসায় গাইতি ও শাবল দিয়ে পাথরের চাঁই গুঁড়িয়ে ভেঙে পড়া বাকিটুকু অংশ সরিয়ে বেরনোর পথ তৈরি করা হবে।
আরও পড়ুন: জাত গণনার রিপোর্ট লোকসভা ভোটে কি আদৌ তুরুপের তাস?
এসব তো বুঝলাম, কিন্তু যেটা বুঝলাম না সেটা হল এই প্রোজেক্টের স্যাংশন পাশ কারা করেছেন? জিওলজিক্যাল ও অন্যান্য এক্সপার্ট অ্যাডভাইস ও ক্লিয়ারেন্স রিপোর্ট কোথায়? হিমালয়ে এর আগেও বিভিন্ন প্রকল্প করে আমরা বিপর্যয় ডেকে এনেছি। ১৯৯৯–এর ভূ–কম্পের কথা ধরুন কিংবা হালফিলের হড়পা বানের কথা, ক্ষতি তো কম হল না। আর কত সহস্র মানুষের প্রাণ আমরা বাজি ধরব? কেন ধরব? এ–উত্তর আমার সত্যি জানা নেই।
তবে, অন্য একটি বিষয় তুলে ধরার জন্য এ–লেখাটি লিখলাম। নিয়মানুসারে, যে কোনও সুড়ঙ্গ নির্মাণ করার সময় একটি আপদকালীন এস্কেপ প্ল্যানও ব্যবস্থা রাখতে হয়। কোনও বিপদের সংকেত পেলে যাতে শ্রমিকেরা সহজে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু, এক্ষেত্রে তা রাখা হয়নি।
চারধাম হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্টের (Chardham Highway Development Project) অন্তর্গত সিলকিয়ারা সুড়ঙ্গ তৈরির সময়ই আপৎকালীন নিকাশ পথ তৈরির প্রস্তাব ছিল। গোটা প্রকল্পটির নাম ‘সিলকিয়ারা বান্দ–বারকোট টানেল’ (Silkyara Band-Barkot Tunnel)। উত্তরাখণ্ডের (Uttarakhand) দীর্ঘতম দুই লেনের সুড়ঙ্গপথ এটি। সেই প্রকল্পের বিপদকালীন রক্ষার পথ তৈরির প্রস্তাবও ছিল। কিন্তু, সুড়ঙ্গ তৈরির সময় নির্মাণকারী সংস্থা এনএইচআইডিসিএল (NHIDCL) সে–ব্যবস্থা নেয়নি। আর আমার মূলপ্রশ্নটা এখানেই। প্ল্যানের এই পরিবর্তন কোন দায়ে চিফ ইঞ্জিনিয়ার সহ্য করলেন? আর, যদি না মানা হয়ও, তবু প্রকল্পের কাজ কেন চালু রাখা হল? এর উত্তর কারা দেবে? এরপর যে ভূমিকম্প হবে, কিংবা ধেয়ে আসবে মারণ হড়পা বান, তার দায় কে নেবে? প্রকৃতির ক্ষতি করে তীর্থস্থান সহজলভ্য করা আদতে একপ্রকার মারণ বিপর্যয় ডেকে আনে।
যুগে যুগে সাধারণ মানুষ আদতে দাবার বোরে ঘুঁটি ছাড়া আর বিশেষ কিছু নয়। সেজন্য, এই একুশ শতকে এসেও ভয়ংকর উদ্বেগজনক এক পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেওয়া যায় লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ। ইতিহাসে চলা ক্রীতদাস প্রথা আদতে কোনও দিনও শেষ হয় না, যুগ বদলায় আর সে–সঙ্গে বদলায় দাসপ্রথার ফর্ম, এই–ই যা।