একটা সময় ছিল যখন শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য নিয়ে কোনওরকম ব্যবসা চলত না। কিন্তু আজকালকার শুধুই ব্যবসার যুগে এই দুটো বিষয় সমাজকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। আসলে প্রত্যেকে নিজেদের ব্র্যান্ড তৈরিতে ব্যস্ত। প্রাইভেট হাসপাতালগুলো যেমন ব্র্যান্ড বিল্ডিং-এ মেতে আছে, ঠিক তেমনই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করা চিকিৎসকরা নিজেদের ব্র্যান্ড তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। জানি না, জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন যদি চিকিৎসকদের এই আবদার মেনে নেয়, তাহলে সেটা বোধহয় সমাজে একটা অশনি সংকেত!
১৬.
একবার ভাবুন তো, একজন চিকিৎসক বুক বাজিয়ে বলছেন ‘আই অ্যাম দা গ্রেটেস্ট’। ঠিক ওই মুষ্টিযোদ্ধা ক্যাসিয়াস ক্লের মতো!
খবরে দেখলাম, চিকিৎসকরা চাইছেন, বিশেষ করে যাঁরা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন, নিজেদের বিজ্ঞাপন করার অধিকার। নিশ্চয়ই সময় পাল্টাচ্ছে, তাঁদের ভাবনাচিন্তাও পাল্টাচ্ছে। স্মৃতির পাতা উল্টে দেখবেন, একসময়ে পাড়ায় পাড়ায় অনেক চিকিৎসক ছিলেন যাঁরা নিজেদের অজান্তে এক একটি ‘ব্র্যান্ড’ হয়ে উঠেছিলেন শুধু চিকিৎসার গুণে। বিজ্ঞাপনের কোনও প্রয়োজন তাঁরা বোধ করেননি।
আরও ব্র্যান্ড বাজাও: বাঘ-ছাগলকে একঘাটে জল খাওয়াতে পারে যে চা
‘ইন্ডিয়ান মেডিকেল কমিশন’-এর কতকগুলো ‘কোড অফ কন্ডাক্ট’ চিকিৎসকদের মেনে চলতে হয়। যেমন, নিজের ঢাক নিজেরা বাজাতে পারবেন না। একজন চিকিৎসক, সে যতই পণ্ডিত হোন, নিজের পাণ্ডিত্য নিয়ে বিজ্ঞাপন করতে পারবেন না। কিংবা ডাক্তারি বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান নিয়ে কোনও মিডিয়াতে আত্মপ্রচার করা যাবে না, ইত্যাদি প্রভৃতি। এই বিধিনিষেধের মধ্যে প্রাইভেট হাসপাতালগুলোও পড়ে। তারা কখনওই ‘আমরাই সবচেয়ে ভালো’ বা ‘আমরা সব রোগ সারাতে পারি’– এই ধরনের কথা বিজ্ঞাপিত করতে পারবে না। কিন্তু খবরের কাগজে বা টেলিভিশনে প্রায়শই দেখতে পাই অনেকেই এই বিধিনিষেধ মানছেন না। ফেসবুক বা ইউটিউবে লক্ষ করা যাচ্ছে বহু ডাক্তার পরোক্ষভাবে নিজের প্রচার করে চলেছেন। আরও মজার ব্যাপার, অনেক নামী ডাক্তার সবসময় জনমানসে নিজেদের ইমেজ ধরে রাখার জন্য সমাজমাধ্যমে চিকিৎসা ছাড়াও অন্যান্য বিষয়েও আলোচনায় ব্যস্ত থাকেন। অনেক প্রাইভেট হাসপাতাল রাস্তাঘাটে, বিশাল বিশাল হোডিংয়ে, তাঁরাই যে ‘একমাত্র’ অথবা ‘শ্রেষ্ঠ’ সেই অনৈতিক প্রচার নির্লজ্জভাবে করে চলেছে। এমনকী, তাতে ডাক্তারদের ছবিও দেখানো হচ্ছে– যেটা সম্পূর্ণ নিয়মবিরুদ্ধ।
যাই হোক, প্রাইভেট চিকিৎসকরা নতুন করে আওয়াজ তুলেছেন তাঁদের বিজ্ঞাপনের অধিকার নিয়ে। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন প্রাইভেট স্কুল কীভাবে নিজেদের বিজ্ঞাপিত করছে। খবরের কাগজের পুরো পাতাজুড়ে তাদের তথাকথিত ‘উন্নত শিক্ষা’র গল্প, শুধু তাই নয়, কিছু ভাল রেজাল্ট করা ছেলেমেয়েদের প্রায় পণ্যের মতো ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন করা হচ্ছে।
আরও ব্র্যান্ড বাজাও: বিষ বিক্রি করে মিলিয়ান ডলারের মালিক!
একটা সময় ছিল যখন শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য নিয়ে কোনওরকম ব্যবসা চলত না। কিন্তু আজকালকার শুধুই ব্যবসার যুগে এই দুটো বিষয় সমাজকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। আসলে প্রত্যেকে নিজেদের ব্র্যান্ড তৈরিতে ব্যস্ত। প্রাইভেট হাসপাতালগুলো যেমন ব্র্যান্ড বিল্ডিং-এ মেতে আছে, ঠিক তেমনই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করা চিকিৎসকরা নিজেদের ব্র্যান্ড তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। জানি না, জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন যদি চিকিৎসকদের এই আবদার মেনে নেয়, তাহলে সেটা বোধহয় সমাজে একটা অশনি সংকেত! বিজ্ঞাপনের গোলকধাঁধায় চিকিৎসকরা ব্র্যান্ড বাজাতে বাজাতে পণ্য হয়ে যাবেন আর রোগীরা ক্রেতা হয়ে দর-দস্তুর করে চিকিৎসা কিনবেন।
সত্যিই কী ভয়ানক দিন আসছে!
অডিটোরিয়াম থেকে ব্যাক স্টেজে আসার যে দরজা সেটা দিয়ে উঠে আসছিল খুব রোগা মতো একটি ছেলে, গায়ের রংটা শ্যামলা, তাকে দেখে বলি, ‘একটু দেখবেন ভাই, অডিটোরিয়াম এ সামনের রো-তে রশিদ খান বলে কেউ আছেন কিনা’, সে শুধু বলল, ‘জি’, আবারও বলি, ‘প্লিজ একটু দেখবেন’, আমি তখনও তাঁকে ভাবছি ‘usher’ জাতীয় কেউ। এবার সে একটু ইতস্তত করে নম্রভঙ্গীতে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলে, ‘জি, ম্যায় হুঁ’।