তৈরি ছিলাম একটি জোরদার রাজনৈতিক ছবি দেখার জন্য, যে ছবি কাউকে রেয়াত করে না, এমন এক্সপেকটেশন স্বাভাবিক, যখন পরিচালকের নাম আগ্নেসকা হল্যান্ড। আগ্নেসকা হল্যান্ড পোলিশ সিনেমা, তথা বিশ্বসিনেমার দরবারের মায়েস্ত্র। সমাজের মস্তিষ্কে কৃমির মতো বাসা বেঁধে বসে আছে কিছু হাস্যকর ভাবনা, যেমন মহিলা পরিচালকরা রোমান্টিক ছবি, ফ্যামিলি ড্রামা জঁরের ছবিতে যতটা পারঙ্গম, রাজনৈতিক, বাস্তববাদী বা হার্ড হিটিং ছবিতে ততটা নন। এটি অত্যন্ত সংক্রামক একটি অসুখ, এমন ভাবা আর সেই ভাবনাটাকে চারিয়ে দেওয়া হয়ে আসছে যে, মেয়েরা অঙ্কটা তত ভাল পারে না, মেয়েরা ডাক্তারির থেকে প্রফেসরিতে বেশি পারঙ্গম। এই ব্যধির মারাত্মক একটি ভ্যাকসিনের নাম আগ্নেসকা হল্যান্ড। প্রথম ছবি থেকেই সপাট চাবুক। ‘ইয়োরোপা ইয়োরোপা’-র মতো কাল্ট মাস্টারপিস দিয়ে তাঁর পথচলা শুরু। পোলিশ ছবি আমার ভয়ানক প্রিয়। পোলিশ পরিচালকদের সিনেমা-দর্শন আর সিনেমার ভাষা, তাদের রাজনৈতিক ইতিহাস, হোলোকস্টের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা জীবন, আর অনবদ্য রসবোধ, হিউমার– সব মিলিয়ে এককথায় পোল্যান্ড অসম্ভব শক্তিশালী চিত্রপরিচালকদের ডেরা আর আগ্নেসকা সেই ডেরার একজন টপ মাস্তান। এখন তাঁর বছর পঁচাত্তর বয়স, ছবিটির জন্য একটা মানসিক বোঝাপড়া ছিলই, কিন্তু সেই সব কিছুতে বালতি বালতি বরফ জল ঢেলে আগ্নেসকা যা করলেন তাঁর সাম্প্রতিক ছবি ‘গ্রিন বর্ডার’-এ, তাতে বিস্ময়ের শেষ থাকে না। এমন একটা তীব্র এনার্জি আছে এই ছবির, যা এক মুহূর্ত আয়েশ করে বসতে দেয় না। কী প্রচণ্ড কঠিন এ ছবির শুট। জলে, জঙ্গলে, বরফে, বৃষ্টিতে– সারাটা সময় ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে ছুটে চলা, ঠিক যেমন সিনেমার চিত্রনাট্যের ঠাঁইহীন, যুদ্ধ বিদ্ধস্ত মানুষগুলো দেশ ছেড়ে, ঘর ছেড়ে, সব ছেড়ে বেঁচে থাকার জন্য, পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য লাট খেতে থাকে কাঁটাতারের এপার থেকে ওপার। দেখতে দেখতে মনে হয়, এ ছবি সত্যি পঁচাত্তর বছর বয়সি আগ্নেসকার বানানো, নাকি কোনও পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের ফুটতে থাকা আগুনের গোলার!
বেলারুশ আর পোল্যান্ডের মধ্যবর্তী কাদামাটি-জল-জঙ্গলের বিস্তীর্ণ এলাকার পোশাকি নাম ‘গ্রিন বর্ডার’। যেখানে-সেখানে চোরা-কাদার মরনফাঁদ আর কঠিন, দুঃসাধ্য এক প্রকৃতিই দেশ দু’টির বর্ডার বা সীমানা রক্ষক। কোনও ফোর্সের দরকার প্রায় নেই বললেই চলে। ‘গ্রিন বর্ডার’ অতিক্রম করা আর মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলা প্রায় একই। সেই গ্রিন বর্ডারের দিকেই অত্যন্ত সুচারুভাবে বেলারুশ সরকার, শাসক ঠেলে দেয় পলিটিকাল অ্যাসাইলাম খুঁজে বেড়ানো যুদ্ধ বিদ্ধস্ত শত শত মধ্য প্রাচ্য আর আফ্রিকান উদ্বাস্তুদের। গ্রিন বর্ডারই যেন সবচেয়ে সহজে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মধ্যে ঢোকার রাস্তা, কেক ওয়াক, যা তাদের নিয়ে যাবে নিশ্চিত একটা জীবনের দিকে। হাড়হিম করা পলিটিকাল থ্রিলার যেন এই ছবি। এপিসোডিক স্ট্রাকচারে তৈরি ছবিটি সিরিয়ান এক পরিবারের অবৈধ মাইগ্রেশনের গল্প। যার সঙ্গে জুড়ে যায় পোলিশ বর্ডার গার্ডদের বীভৎস অমানবিক চিত্র আর পোলিশ অ্যাক্টিভিস্টদের মরিয়া লড়াই এই ভিনদেশি উদ্বাস্তু মানুষগুলোর জন্য। জুলিয়া জুটে যায় এই অ্যাক্টিভিস্টদের সঙ্গে। এক এক করে দল ভেঙে গেলেও জুলিয়া এক মরিয়া জেদে, আরও আরও জড়িয়ে যায় এই বিদ্রোহে। তারই সঙ্গে জুটে যায় আরও কিছু নতুন মানুষ, যারা চুপচাপ অলক্ষে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এই হতভাগ্য মানুষগুলোর দিকে। পোলিশ হয়েও যেভাবে হল্যান্ড পোলিশ স্টেট আর বর্ডার ফোর্সকে তুলোধুনো করেছে, তা অবিশ্বাস্য। অন্য কোনও দেশ হলে বা আমাদের নিজেদের দেশ হলেও এই ছবি হাতে প্রাণ নিয়ে বানাতে হত পরিচালককে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মানুষগুলোকে নিয়ে পিংপং বলের মতো কাঁটাতারের এপারে ওপারে ছুড়ে ফেলার যে স্তব্ধ করে দেওয়া নিদারুণ খেলা চলে দুই স্টেটের মধ্যে, তা সমস্ত আবরণের আড়ালে থাকা স্টেটের বমির মতো মুখটিকে নগ্ন করে ছাড়ে। আবার এই বর্ডার ফোর্সেই দাঁতে দাঁত চেপে একা একা লড়ে জ্যান নামের এক বর্ডার গার্ড। সবচেয়ে কষ্ট বোধহয় সেই বেঁচে থাকা, যেখানে মানুষকে করতে হয় এমন কিছু, যা সে সর্বান্তকরণে ঘেন্না করে, তার অন্তর বাহির বিদ্রোহ করে, কিন্তু সে নিরুপায়। Life of a slave of the state. জ্যান বাবা হতে চলেছে, কিছুদিনের মধ্যেই তার ছোট্ট মেয়েটি ভূমিষ্ট হবে এই গ্রিন বর্ডারের পাশে, যেখানে রোজ জীবন নিয়ে ভোজবাজি খেলে জ্যানের দেশ, তার পাশের দেশ– জগৎসংসার। জ্যান তার মতো করে লড়ে যায় মানুষ হিসেবে তার লড়াই। নীরবে সামিল হয় ‘অ্যাক্টিভিজম’-এ। এক ভয়ানক পরিস্থিতির ভেতর কুলকুল করে ফল্গুধারা বয়ে চলে মানবিকতার, তীব্র হয়, প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পুরো ছবিটি সাদা-কালোয়, ন্যাচারাল লাইটে, এমনকী, রাত্তিরের দৃশ্যেও নামমাত্র আলো। শুধুই প্র্যাকটিক্যালের ব্যবহার। এমন ম্যাড়ম্যাড়ে, ড্র্যাব দৃশ্যায়নের জন্য প্রভূত সাহস দরকার পরিচালকের। এই ট্রিটমেন্ট একজন মাস্টার পরিচালকের পক্ষেই সম্ভব। কোনওভাবেই দৃশ্যগুলি যাতে সুন্দর দেখতে না লাগে, যাতে ক্যামেরার এই মুভমেন্ট আর সাউন্ড যাতে দর্শকের সুচারু না লাগে, তার সচেতন পদক্ষেপ। ছবিতে একবারের জন্যও ব্যবহৃত হয়নি কোনও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, উল্টে প্রথম দৃশ্য থেকে একটি বাচ্চার কান্না মাথায় আঘাত করতে থাকে এক সময়ে।
হোলোকস্টের আরেক রূপ ফুটে ওঠে আজকের পোল্যান্ড-বেলারুশের বর্ডারে। হলকস্টের সাক্ষ্য বয়ে চলা আগ্নেসকা হল্যান্ডের পক্ষেই বোধহয় সম্ভব এই ছবি বানানো, তাঁর নিজের দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে শুধুমাত্র মানুষের গান গেয়ে।
শেষ দৃশ্যে পলিটিকাল অ্যাসাইলাম চাওয়া উদ্বাস্তুদের বর্ডার পার করতে সাহায্য করছে যখন স্টেট, তখন দেখি মানুষ কীভাবে পোষ্যদের বুকে আগলে নিয়ে চলছে এক দেশ থেকে এক দেশ।
এতক্ষণের দমবন্ধ করা, স্তব্ধ করা, আর সহ্য করতে না পারা এবার চোখ ভিজিয়ে দেয়! মানুষ কত সুন্দর! জীবন কত সুন্দর!
আগ্নেসকা হল্যান্ডের এই ছবি যদি দেখানো হয় পৃথিবীর পার্লামেন্টে পার্লামেন্টে, তাহলে হয়তো পালটে যাবে ভবিষ্যতের ইতিহাস।
গ্রিন বর্ডার
পরিচালক: আগ্নেসকা হল্যান্ড