পত্র প্রেরক ও প্রাপকের অজান্তে, বিনা অনুমতিতে তার চিঠি পড়ার বা পার্সেল খুলে দেখার অধিকার পেতে চলেছে প্রতিটি পোস্ট অফিসের আধিকারিক। এই ‘অধিকার’-এর জন্য তাকে বেশি আয়োজন করতে হবে না। ‘সন্দেহ’ হওয়াটুকুই যথেষ্ট। তার ‘জোরে’ সে সেই পার্সেল খুলে দেখতে পারবে, শুল্ক দপ্তর বা পুলিশের কাছে সেই পার্সেল পাঠিয়েও দিতে পারবে। ৪ ডিসেম্বর রাজ্যসভায় পাশ হওয়া ডাক বিভাগ সংক্রান্ত আইনের সংশোধনীর নয় নম্বর ধারাটির মূল প্রতিপাদ্য নাগরিকের ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে পড়ার এই রাষ্ট্রীয় আয়োজন মনে হয় শালীনতা ভাবনাটিকেই চ্যালেঞ্জ করে বসল!
‘অপ্রকাশিত পত্র’ কথাটির মধ্যে যে মাধুর্য আছে, দুই ব্যক্তির মধ্যে হয়ে ওঠা কথায় হঠাৎ করে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে পড়ে ফেলার যে রোমাঞ্চ, তার উন্মাদনা রসিকজনের বোধগম্য। এর মধ্যে কদাপি অন্যায় নেই, বরং আছে নির্বাসিত যক্ষের মহনীয় দূত মেঘের প্রতি বলা বিরহদীর্ণ কথাগুলির সঙ্গে আত্মীয়তা। তাই শালীনতা বজায় রেখে ব্যক্তিগত পত্র যখন প্রকাশ্য মুদ্রিত চেহারায় পাঠকের হাতে পৌঁছয়, তখন আমরা নিজেদের সৌভাগ্যে শিহরিত হই। তাকে ‘সাহিত্য’ তকমা দিতে দ্বিধা করি না। তবে এগুলি হল গভীর নির্জন পথের সংবেদী মানুষের অনুধ্যান। প্রকাশের অনুমতি, সম্পাদনার শালীনতা সেই জগতের সৌন্দর্য।
রাষ্ট্র এবার সেই শালীনতাতেই কুঠারাঘাত করছে। কারণ সৌন্দর্যের সঙ্গে, মানবিকতার সঙ্গে, সর্বোপরি ব্যক্তি স্বাধীনতার ব্যঞ্জনার সঙ্গে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের দূরদূরান্তেও কোনও সম্পর্ক নেই। তাই সে এমন আইনের কথা ভাবতে পারে, যেখানে পত্র প্রেরক ও প্রাপকের অজান্তে, বিনা অনুমতিতে তার চিঠি পড়ার বা পার্সেল খুলে দেখার অধিকার পেতে চলেছে প্রতিটি পোস্ট অফিসের আধিকারিক। এই ‘অধিকার’-এর জন্য তাকে বেশি আয়োজন করতে হবে না। ‘সন্দেহ’ হওয়াটুকুই যথেষ্ট। তার ‘জোরে’ সে সেই পার্সেল খুলে দেখতে পারবে, সেই ভয়ানক সন্দেহের রাষ্ট্রপ্রদত্ত ক্ষমতায় গরীয়ান সে শুল্ক দপ্তর বা পুলিশের কাছে সেই পার্সেল পাঠিয়েও দিতে পারবে। ‘আচ্ছে দিন’-এর সওদাগর মহাজন মোদিজির সরকার নতুন ডাকঘর বা পোস্ট অফিস আইন আনছে। এমন অভূতপূর্ব নজরদারির ক্ষমতা ডাকঘরের আধিকারিকদের হাতে তুলে দিতে চাইছে তারা। ৪ ডিসেম্বর রাজ্যসভায় পাশ হওয়া ডাক বিভাগ সংক্রান্ত আইনের সংশোধনীর নয় নম্বর ধারাটির মূল প্রতিপাদ্য নাগরিকের ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে পড়ার এই রাষ্ট্রীয় আয়োজন মনে হয় শালীনতা ভাবনাটিকেই চ্যালেঞ্জ করে বসল!
তবে শালীন-অশালীন ইত্যাকার বিষয়গুলিকে এই কেন্দ্রীয় সরকার ধর্তব্যের বিষয় বলে কোনও দিন মনে করেনি। তাই এমনতর গভীর ভাবনাকে সরিয়ে রেখে বলতে হবে, ‘নজরদার রাষ্ট্র’ হিসেবে ভারতকে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন পাইয়ে দেওয়ার আরও একটি ধাপ এই আইন। মোবাইল থেকে ইন্টারনেট— সব ক্ষেত্রেই পরোক্ষে চালু রয়েছে রাষ্ট্রের নজরদারি। ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ’— এমন আতঙ্কের কথা সাত সমুদ্র পার হয়ে আমাদের কানে আগে আসত। সচেতন দেশবাসী জানে প্রায় এক দশকে ধাপে ধাপে আমরাও সেই বিগ ব্রাদারের সহোদর হয়ে উঠেছি। দেশ জুড়ে এমন একটিও জনবহুল পার্ক, রাস্তা বা প্রতিষ্ঠান নেই, নিরাপত্তার নামে নজরদারি ক্যামেরার উচ্চকিত শাসন যেখানে অনুপস্থিত। প্যান ও আধারের মেলবন্ধন নাগরিকের ‘৩৬০ ডিগ্রি প্রোফাইল’ তৈরির অন্যতম হাতিয়ার, এ তথ্য শিশুরও অজানা নয়। দশটি কেন্দ্রীয় সংস্থা এই দেশের যে কোনও ব্যক্তির কম্পিউটারের অফলাইন তথ্যে নজরদারি চালাতে পারে যেমন, পাশাপাশি কেন্দ্রের এমন পরিকল্পনাও আছে ভারতের প্রতিটি বাড়িকে ইসরো-র তৈরি ‘ভুবন’ নামের geo-spatial পোর্টালটির সঙ্গে যুক্ত করে দিতে। এর ‘নিরীহ’ উদ্দেশ্যটি কী? দেশের কোন মানুষ কোন ঠিকানায় থাকে, সেই তথ্য ভৌগোলিক মানচিত্রের সাহায্যে নিজের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বসেই জেনে নিতে পারবে রাষ্ট্র। এই কাজে নেভিগেটরের ভূমিকা পালন করবে আমার-আপনার আধার নম্বরটি। আধারের নিচেই এত আঁধার কে আর ভেবে দেখছে!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আমাদের এই উদাসীনতা বুঝতেও দিচ্ছে না নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের অপমানের ও পরিকল্পিত ভবিষ্যৎ লাঞ্ছনার নিত্য নৈমিত্তিক বয়ানের ধাপগুলোর স্তর। দেশের প্রতিটি নাগরিককে দুষ্কৃতি ভাবছে সরকার, তার সাম্প্রতিক ইশারা ডাক আইনের ধারায় প্রকাশিত, অথচ আমাদের মাথাব্যথা নেই তাতে। আমাদের আছে রোজকার ক্রিকেট, শীতের পিকনিক আর ধর্ম নিয়ে ছেলেখেলা। এই আমরাই বিস্মৃত হয়েছি National Social Registry ভাবনাটির প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল দরিদ্র মানুষের হাতে সরকারি প্রকল্পের সুফলগুলি পৌঁছে দেওয়া। মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের (অর্থাৎ দালাল) অবাঞ্ছিত ছায়া সরকার ও তার নাগরিকের মাঝখানে এসে না পড়ে, এমনটাই ছিল ওই ভাবনার নির্যাস। সেই ইতিবাচকতায় ইতি টেনে চলমান সরকার এই তথ্যভাণ্ডার থেকে ভারতে বসবাসকারী একজন মানুষ কবে জন্ম নিচ্ছে, কবে বিবাহ করছে, কাকে বিয়ে করছে, কবে সম্পত্তি ক্রয় করছে, কবে এক শহর থেকে অন্য শহরে যাচ্ছে, কবে সন্তানের জন্ম দিচ্ছে, ব্যাঙ্কে কত টাকা রেখে কবে মারা যাচ্ছে, এই যাবতীয় তথ্য মাত্র কয়েকটি ক্লিকে জেনে নিচ্ছে। উল্লিখিত ঘটনাগুলি অনতিঅতীতের। তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ১৮৯৮ সালে ব্রিটিশ আমলে তৈরি আইনের বদল ঘটাতে চলেছে ‘আধুনিক ভারত’।
পরাধীন দেশের আইনে পর্যন্ত যে সুবিধা ছিল না, স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের সেই ব্যক্তিগত পরিসরের স্বাধীনতা হরণ করতে সচেষ্ট নরেন্দ্র মোদি সরকার। তাদের অজুহাত গত একশো বছরে সব কিছু আমূল বদলে গেছে। দেশের নিরাপত্তার জন্য এমন কিছু পদক্ষেপ এখন নিতে হবে, যা আপাতভাবে সাধারণ মানুষের কাছে স্পর্শকাতর। নিজের স্বার্থে মানুষকে সহযোগিতা করতেই হবে, তাই এমন একুশে আইনের বাড়াবাড়ি। এর পাশাপাশি অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার জন্য এটা নাকি অতি জরুরি। চিঠির খামে বা পার্সেলে কালো টাকা, মাদক পাচার হয়। সরকার এমন নানান ক্ষতিকর অভিজ্ঞতার সাক্ষী। তার ভিত্তিতে দেশের সুরক্ষার স্বার্থে এই পদক্ষেপ নিতে তারা বাধ্য হচ্ছে। এমন কৈফিয়তে মনে আসে একটা প্রবাদ– দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। ভারত সরকারে গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রকের প্রাক্তন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মনোরঞ্জন কুমারের স্বপ্নের প্রকল্প ছিল জাতীয় সমাজ পঞ্জি। ২০১৯-এ অবসর গ্রহণের সময় কুমার সাহেবের পর্যবেক্ষণ ছিল ঠিক এইরকম: ‘আমি দেখতে পাচ্ছি ভারত ক্রমশ একটি নজরদার ও নিয়ন্ত্রক রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে, একটি শক্তিশালী পুলিশ স্টেট। আর আমার বিশ্বাস কোনও দেশকে উন্নতি করতে হলে, তার ব্যক্তি ও সংস্থা দুটোর ওপরেই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ যথাসম্ভব কম থাকা দরকার।’ এই ধরনের নীতিকথা একটি অদৃশ্য-একনায়কতান্ত্রিক দেশের প্রধানদের অন্তরে কোনও রেখাপাত করবে, এই আশা করলে আপনি বিবেচক হিসেবে শূন্য পাবেন। বরং ভেবে দেখুন, পার্সেলে উপহার এল, সঙ্গে এল চিঠি। উপহারটি ডাককর্মীর লোভী-হাতে মর্দিত হয়ে থাকতে পারে, চিঠিটিও আপনি পড়ার আগে তার পঠিত হয়ে যেতে পারে! গোপন কথাটি রবে না গোপনের কাব্যময়তা নয়, এর অশালীনতা একধরনের মানসিক সন্ত্রাস। ডাকযোগে পত্রবোমা পেয়েও ব্রিটিশ প্রভু যে ব্যক্তি পরিসরে প্রবেশের কথা ভাবেনি, এই নজরদারি রাষ্ট্রে আপনার সঙ্গে সেই অনৈতিক কাজটি করা হবে। কারণ পত্রপ্রাপক হিসেবে আপনি আর দ্বিতীয় ব্যক্তি নন, নিতান্ত থার্ড পার্সন, ভোটবাক্সে সিঙ্গুলার নাম্বারও। তাই আপনি অবশ্যই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন।
জাতি হিসেবে বাঙালি নির্বাক ছিল না কখনও, তার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির দিকচিহ্নগুলিকে আবারও নতুন করে ফিরে দেখা সম্ভব হবে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীর তাবৎ সংস্কৃতি গবেষণার চিন্তন-ভূগোলে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সাংস্কৃতিক নতুনতর মাত্রা যোগ করবে– এ দাবি অহেতুক নয়।