Robbar

বাংলার রেডিও স্টেশন বাংলা গানকেই পাত্তা দেয় না

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 20, 2023 4:35 pm
  • Updated:June 13, 2024 4:40 pm  

২৪ ডিসেম্বর, রবিবার, সন্ধে সাড়ে ৬টায়, জি ডি বিড়লা সভাঘরে ভিন্নধর্মী একক অনুষ্ঠান জয়তী চক্রবর্তীর। আয়োজনে ‘কৃতি’। এই অনুষ্ঠানের ডিজিটাল মিডিয়া পার্টনার ‘রোববার.ইন’। জয়তী চক্রবর্তীর গানের দেশে ঢুকে পড়া, সেই দেশের বদলে যাওয়া, আবার এক গানের দেশ তৈরি করার কথা উঠে এল এই সাক্ষাৎকারে। উঠে এল জনগণের রুচি ও রাষ্ট্রের অভিসন্ধির কথাও। ২৪ ডিসেম্বর, ‘কৃতি’র ওই অনুষ্ঠানে পাঠকরা শ্রোতার ভূমিকায় উপস্থিত হন, এই আমাদের যৌথ চাওয়া। জয়তী চক্রবর্তীর এই একান্ত সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্বিত বসু।  

সম্বিত বসু

প্রথমেই আপনার ছোটবেলার কথা জানতে চাই। গান ব‌্যাপারটার সঙ্গে পরিচিত হলেন কবে?

আমি জন্মেছিলাম হাওড়ায়। চৌধুরীবাগানে। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত সেখানেই বড় হওয়া। তারপরই বাবার চাকরি বদল, ব‌্যবসায় আসা। এসে পড়ি বেহালায়। একদম ছোটবেলার আমাদের বাড়িতে গানের যে সাংঘাতিক চল ছিল, তা নয়। তবে মা খুবই ভাল গান গাইতেন। সাংসারিক চাপে সে গান গাওয়া থমকে গিয়েছিল। গান নিয়ে সর্বক্ষণ থাকার একটা সুপ্ত বাসনাও ছিল হয়তো-বা। আমার এই গানকে পাওয়া অনেকটাই মায়ের থেকে। বাবাও গান করতেন, শখে, কিন্তু সংসার সামলে তিনিও পেরে ওঠেননি। আসলে তখন এমনই একটা সময় যে, ছেলে গান করবে, গানই প্রফেশন হবে– একথা কেউ ভাবতে পারত না! ওঁদের দু’জনের প্রবল ইচ্ছে ছিল যে, আমি ও আমার দাদা যেন গান নিয়ে থাকি। প্রফেশনালি গানবাজনা করতে হবে, এমন কোনও ভাবনা, স্বপ্ন বা লক্ষ্য ওঁরা স্থির করে দেননি একেবারেই। শুধু বলেছিলেন, গানকে যেন বন্ধুর মতো করে সারাটা জীবন পাশে রাখি। ৫ বছর বয়সে আমাকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল গানের ইশকুলে– সেই থেকে গান ও আমার অবিচ্ছদ্য বন্ধুত্বের শুরু।

কী শুনতেন তখন? কোন কোন শিল্পীর গান? কী ধরনের গান?
ছোটবেলায় যেহেতু আমার বাবা-মা সব ধরনের গানই শুনতেন, আমিও শুনতাম। তবে, রবীন্দ্রনাথের গান শোনা তুলনায় কমই হত। শোনা হত পুরাতনী বাংলা গান, নির্মলেন্দু চৌধুরীর লোকগান, আধুনিক গান তো বটেই– সন্ধ্যা-কণিকা-মান্না দে। আমার কাকা চমৎকার মান্না দে’র গান করতেন, তিনিও ওই শখের গাইয়ে।

শখের গান ব‌্যাপারটার মধ্যেও তো আনন্দ কিছুমাত্র কম ছিল না?
বিন্দুমাত্র না। বরং একটা আগল ভাঙা আনন্দ ছিল। সময়টাই খুব অন্যরকম ছিল আসলে। রোজই পাড়ায় পাড়ায় লোডশেডিং হত। একেবারে ধরাবাঁধা নিয়ম। রাত ১০টা-সাড়ে ১০টার পর, মানে খাওয়াদাওয়ার পর, ছাদে সক্কলকে ডেকে-টেকে, পরিবারের ১৫-১৬ জন মিলে হইহই করে গানবাজনা হত। পাশের বাড়ির লোকজন, তাদের পাশের বাড়িও তখন ছাদে আড্ডা মারতে মারতে গান শুনত। ছোটবেলায় ছাদে, মাদুর পেতে, মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে, আমি, আমার খুড়তুতো ভাই ও দাদা– সক্কলে মিলে গান গাইতাম। এই ছিল পরিবেশ। ফলে বিভিন্ন রকমের গান সেই ছোট থেকেই আমার কানে ঢুকেছে। আমার বাবা খুব ধ্রুপদী গানবাজনার অনুরাগী ছিলেন। সেসবও শুনেছি ছোটবেলায়। কিন্তু যেহেতু একনিষ্ঠভাবে সংগীতের লোক নন, ফলে নিয়ম করে শোনা হয়নি তখন।

লোডশেডিংয়ের পাড়া। লোডশেডিংয়ের পড়া

চমৎকার এক সময়! এই সময়টার সঙ্গে সঙ্গে কি আমাদের যৌথ গান শোনার আবহটাও চলে যায়নি?
হ‌্যাঁ, একেবারেই। একে-বারেই! ব্যস্ততা এত বেড়ে গেছে। অন্যতম কারণ কিন্তু মোবাইল ফোন। দলবল নিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়ার যে ব‌্যাপারটা, তা আর হয় কই! আমি যে পরিবেশে বড় হলাম, সেই পরিবেশ তো আমি আমার সন্তানকেই দিতে পারছি না। আমরাই দায়ী। প্রত্যেক রবিবার ছিল স্পেশাল। প্রত্যেক রবিবার জানি গানের আসর বসবেই। ছোটকাকার বন্ধুবান্ধব আসবেই। মা নিরন্তর গেয়ে যাবেন। বাবা সঙ্গত করবেন গানে, কখনও মাউথ অরগ্যানে। এই আশ্চর্য সাধারণ মানুষগুলোর যোগফলে যে গানের পৃথিবী, তা তো চলে গিয়েছে। এখনও স্পষ্ট দেখতে পাই, ওই বাড়িতে আমার লাল-কালো টেপরেকর্ডার রাখা রয়েছে সোফার ওপর। সেখানে একটানা গান চলছে। সারা বাড়ির একমাত্র টেপ রেকর্ডার। যে যখন আসে, গান শোনে, চলে যায়। এমন করে টানা পাঁচদিনও চলত। একই গানের ক‌্যাসেট। ৭০-৮০ বার টানা হয়তো!

সারাদিন ধরে চলা, মানে লুপে গোটা বাড়ি শুনছে যে গান, সেরকম একটা গানের কথা কি মনে পড়ছে এখন?
এই কথাগুলো বলতে বলতেই মনে পড়ল। শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়ের একটা নতুন ক‌্যাসেট বেরিয়েছে তখন। পুরনো বাংলা গানের ক্যাসেট। অনেকের গান গেয়েছেন তিনি। সেখানে একটা গান বহু শুনেছিলাম– ‘রূপের ওই প্রদীপ জ্বেলে কী হবে তোমার/ কাছে কেউ না এলে এবার।/ মনের ওই মধু কেন জমেছে,/ যদি কেউ না থাকে নেবার?’

পুরনো গান না হয় হল, এখনকার কোনও গান আপনি লুপে শুনেছেন?
এখন আমার ছেলেই আমাকে লুপে গান শোনায়। ওদের জেনারেশনের ভীষণ পছন্দ অরিজিৎ সিং। আমারও অসম্ভব পছন্দের। আমার ছেলে অন্য কারও গান শোনার আগে, অরিজিৎ সিং চালায়। আমার মনে হয়, অরিজিৎ অত্যন্ত যোগ্য এই গান-পাগলামির। আমার হাজব‌্যান্ড আবার পুরনো হিন্দি গান শোনেন বেশি। ফলে পাঁচমিশালি গানই শুনতে থাকি।

কিন্তু একেবারে আপনার পছন্দের গান?
আমি ব্যক্তিগতভাবে হয়তো আরও ধ্রুপদী গান শোনার দিকেই ঝুঁকে থাকতে চাইব। একসময় যখন কলেজে পড়ি, সেই সময় রাত্রিবেলা রেডিও শুনতাম নিয়মিত। ১১-১২টা রেডিওতে হত আলাপচারিতা, কোনও শিল্পীর সাক্ষাৎকার, মাঝে মাঝে গান। ১২-২টো পর্যন্ত ছিল ধ্রুপদী গানের অনুষ্ঠান। এই পর্বটাই আমার সবথেকে পছন্দের। ২টোর পর ছিল ইংরেজি গানের অনুষ্ঠান। রাত জেগে যেহেতু পড়ার অভ্যেস, অঙ্ক করার অভ্যেস, সে সময় পড়াশোনার সমান্তরালে বন্ধু ছিল এই গান। এখন আমার ‘চয়েজ’-এ গান শোনাটা সত্যিই কমেছে। এই ফেসবুক, ইউটিউব– নানা সোশাল মিডিয়ার দৌলতেও আমাদের শোনা ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করি। কোভিডের পর আরও। যে পারছে, যেভাবে পারছে, গান করছে। শোনার ছাঁকনিটা হঠাৎ হারিয়ে গিয়েছে।

myRepublica - The New York Times Partner, Latest news of Nepal in English, Latest News Articles - Radio_Nepal

আচ্ছা, এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। শীতকাল বলতেই মেলা, একের পর এক উৎসব– শীতকাল কেমন লাগে আপনার?
একেবারে ভালো লাগে না। বর্ষা আমার প্রিয় ঋতু। আমি তো রবীন্দ্র-অনুরাগী। ওঁর বর্ষার গান আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ভেবে দেখেছি যে, শীত আসলে যেভাবে উদ্‌যাপন করা উচিত, আমি করতে পারি না। সারাক্ষণ মাথা ঢাকা দিয়ে থাকা, গলা বাঁচানোর চেষ্টা, কোনওভাবেই ঠান্ডা লাগতে দেওয়া যাবে না– এভাবে শীত কাটে!  মেলাতেও যেতে পারি না ধুলোর কারণে। যাওয়া মানে স্রেফ আনন্দ করার জন্য, খাচ্ছি-দাচ্ছি, ঘুরে বেড়াচ্ছি, এমনটা হয় না। তবে সেজন্য খুব যে আফসোস হয়, এমনও নয়। এটা অন্য একটা বেঁচে থাকা বলে মনে করি। গান তো আক্ষরিক অর্থে সেবা। সে সেবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হয়।

কৃতি-র তরফে আপনার একক অনুষ্ঠান হচ্ছে এই কলকাতা শহরেই, সেই অনুষ্ঠান পরিকল্পনাটা কেমন?
সাধারণভাবে যেরকম গানবাজনা আমি করে থাকি নানা অনুষ্ঠানে, এবার সেই পথে না গিয়ে একটু অন্যদিকে হেঁটে আসা। হ‌্যাঁ, আমাকে মানুষ যে গান দিয়ে ভালোবেসেছেন, সেগুলোও থাকবে, কিন্তু এর বাইরে যে-গান, যে-কথা আমি বলতে চাই, তাও থাকবে। ‘কৃতি’ আমাকে আমার মতো করে ভাবার স্বাধীনতা দিয়েছে, অবকাশ দিয়েছে। ইচ্ছে আছে কিছু পাঠও করব। যেগুলো গানকে সাজানোর জন্য, একটা গল্প বলার জন্য দরকার। এবং কিছু ভাবনা, তা ছড়িয়ে দেওয়া দর্শকের মধ্যে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা, রবীন্দ্রনাথের লেখা, এমনকী, চিঠি, আচার্য জয়ন্ত বোসের গান, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের গান, লোকগান, রবীন্দ্রনাথের গান। এমনকী, হিন্দি গানও থাকবে।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়

হিন্দি গানের কথায় মনে পড়ল বেশ কিছুকাল হল বাংলা-হিন্দির একটা খণ্ডযুদ্ধ চলছে। একজন শিল্পী হিসেবে কীভাবে দেখেন, বিশেষত বাংলা রেডিওতেও যেভাবে হিন্দি গানের দৌরাত্ম্য?
প্রথমত, গানের এই বিভাজন আমি পছন্দ করি না। রেডিওতে বাংলা গানের পাশাপাশি হিন্দি গান চালালে এতটা সমস্যা হত না। কিন্তু রেডিও বাংলা গান না বাজিয়ে হিন্দি গানই বাজাচ্ছে। বাংলায় বসে থাকা রেডিও স্টেশন বাংলা গানকেই পাত্তা দিচ্ছে না! বাংলা গানকে ব্রাত্য করে তুলছে! আমি কিন্তু ধরেই নিচ্ছি বাংলা গানের ‘বাজার’-এর তুলনায় হিন্দি গানের ‘বাজার’ বেশি। কিন্তু ৪০-৬০ শতাংশে ভাগ করাই যেত। কিন্তু ২ শতাংশ বাংলা গান, আর ৯৮ শতাংশ হিন্দি গান– এমনটা কি শোভনীয়? এমনকী, সেই ২ শতাংশ বাংলা গানকেও কি ছেঁটে ফেলার চেষ্টা চলছে না? এ তো রাজনৈতিক অভিসন্ধি, বাজারের অভিসন্ধি, কিন্তু এর বাইরে গানের কি সত্যিই এমন শ্রেণিবিভাগ হয়? বাংলা-হিন্দি ছাড়ুন। নতুন-পুরনো এরকমও কি শ্রেণিবিভাগ হয়? জগজিৎ সিংহ বা মেহদি হাসানের গজল শোনার সময় মনে করব এ বাংলা নয় কেন? রবীন্দ্রনাথের গানকে কি ‘পুরনো’ গান বলে ডাকব? তাহলে আজকের বাংলা সিনেমায় কেন ব‌্যবহার হচ্ছে রবীন্দ্রসংগীত? কেন সংলাপে ব‌্যবহার করা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের গানের কথা। ‘কৃতি’র এই অনুষ্ঠানেই আমি একইসঙ্গে সলিল চৌধুরীও গাইব, আবার আমাদের এককালের ব্যান্ড ‘একলব্য’– তারও একটা গান গাইব। কোনটা তাহলে নতুন, কোনটা পুরনো?

রবীন্দ্রনাথের গান কি ‘পুরনো’?

এটা বুঝতে পারার মতো জনরুচি কি বদলে গিয়েছে?
বদলেছে, তবে সুস্থ রুচি সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে, আর কখনও ফিরে আসবে না– এরকম নিরাশাবাদী আমি নই। একজন শিল্পীর কাজ, শ্রোতাদের রুচি তৈরি করা। কিছু শাশ্বত ভালোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া। শ্রোতাদের ওপর আমার অসীম ভরসা। আমি বিশ্বাস করি, মনের জোর শুধু ঈশ্বর আমাকে জুগিয়েছেন, তাই নয়, শ্রোতারাও জুগিয়েছেন একইভাবে। তাঁদের কাছে নিজের দুঃসময়ের কথাও বলব ‘কৃতি’র অনুষ্ঠানে।

শেষ প্রশ্ন জয়তীদি। সাম্প্রতিক সময়ে রবীন্দ্র-নজরুল– বাংলা গানের অন্যতম দু’টি শাখাই বিতর্কে জড়িয়েছে। একটি গানের শব্দ বদল নিয়ে, অপরটি সুর বদল নিয়ে। আপনার কী মত?
স্রষ্টার অনুপস্থিতিতে, তাঁর অনুমতি ছাড়া এ ধরনের কাজকে আমি সমর্থন করি না। এ-ও বিশ্বাস করি, আমার একার প্রতিবাদে কিছুই হবে না। তবে মনকে এ বলেও প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করি যে, এতে রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের কিছু যায়-আসে না। যাঁরা এই গান দু’টিকে যেভাবে গাইতে বা শুনতে অভ্যস্ত, পরবর্তী কালেও সেই গানটা সেভাবেই গাইবেন বা শুনবেন। আমাকে যদি ওই দু’টি গান গাইতে বলেন কেউ, আমি অপরিবর্তিত গান দু’টিই গাইব।