‘রোববার’-এর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল দেবপ্রিয় দে-র বাড়ি। আমার মাস্টারমশাই। তিনিই প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ‘রোববার’-এর অন্দরমহলে যাওয়ার। আমার এক কাকুকে জিজ্ঞাসা করতাম, ‘কাকু তুমি কতদূর পর্যন্ত পড়েছ?’ কাকু উত্তর দিত ‘মলাট পাস’। রোববার সত্যিই ‘মলাট’ পাস সকলের কাছে। রোববারের ‘মলাট’ ছিল ‘বহুবচ্চন’ থেকে ‘উত্তমপুরুষ’। শুনতে অনেকটাই ব্যাকরণের বিষয়কে ব্যাঁকা করে। কিন্তু প্রতিটি সংখ্যারই নিজস্ব ব্যাকরণ আছে, যে কারণে ‘রোববার’ আকর্ষণীয়। কখনও ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে, কখনও বিষয়গত। মলাটের বিষয়গুলো ছিল সাধারণ মানুষের পরিচিত শব্দে– ট্যাক্সি, বইচোর, পকেটমার, পিকনিক, জনগণ, কফি হাউস, ছাতা, খিচুড়ি, টিউশনি, হাট, প্ল্যাস্টিক, কলোনি, নিলাম, ক্রিকেট, লাইব্রেরি, হকার, লোডশেডিং, বেডরুম, ফেসবুক, মেসবাড়ি, মিছিল, ঢাকি, আলপনা, পুলিশ, হৃদয় ইত্যাদি। পরিচিত শব্দ বলেই রোববারের পঞ্চাশ পাতা কাছের হয়েছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংখ্যাগুলির মলাটের নামকরণের মধ্যে অনেকখানি চমক থাকে। নামকরণের জন্য রোববারকে বেশি করে আপন করা যায়। যেমন– গুরু (মলাটে বড় আকারে উত্তমকুমারের ছবি), আপনজন (তপন সিনহার ছবি), অপুর সংসার (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়), বিধির বিধান (বিধান চন্দ্র রায়), আনন্দ ভৈরবী (শক্তি চট্টোপাধ্যায়), বু ব (বুদ্ধদেব বসু), নটবণিকের পালা (রমাপ্রসাদ বণিক), বাদল দিন (বাদল সরকার), কলমকুমার (কমলকুমার মজুমদার) ইত্যাদি। কোনও সংখ্যাতেই প্রায় সরাসরি নাম উচ্চারণ করা থাকে না বলেই ‘রোববার’ পাঠককে টানে। ‘রোবাবার’ পত্রিকা একটি মলাটের নাম রেখে ছিল ‘রবিবার’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে সংখ্যাটি হয়েছিল। নামকরণের টান এমনই ছিল। তাছাড়া নানান রকমের কলাম, যা বুঁদ করে রাখে। সাহিত্য ফসলের পত্রিকা ‘রোববার’। ‘ফার্স্ট পার্সন’, ‘ভালোবাসার বারান্দা’, ‘রোববার লাইব্রেরি খোলা’, ‘গোঁসাইবাগান’, ‘‘দু’ছক্কা পাঁচ’, ‘ফুডপাথ’, ‘অলিগলিকলি’, ‘মিস্টিকুটুম’, ‘কথা অমৃতসমান’, ‘খোলাখুলি বলছি’, ‘ডাউনলোড’, ‘নামচা’, ‘দেখা না-দেখায় মেশা’, ‘হককথা’, ‘নেমপ্লেট’ ইত্যাদি। প্রত্যেকটি কলামই একজন করে লিখেছেন। সাহিত্যের সঙ্গে মেশা। গোঁসাইবাগান ছিল পাঠককে সকালের চায়ের কাপে বসিয়ে কবি ও কবিতার সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার একরকমের পাঠে নিয়ে যাওয়া। কবিতার কাটাছেঁড়ার গল্প নয়, কবিতা অনুভবের গল্প– এটা জানানোই এই কলামের কাজ ছিল। কিংবা ‘ইউএফও’ ছিল কল্পবিজ্ঞানের ইতিকথার গল্প।
‘রোববার’ ২০০৭-এর ৩০ ডিসেম্বরের মলাট ছিল ‘জন্মদিন’। এই সংখ্যায় বিশিষ্টদের খোলা চিঠিতে অনেকেই পরামর্শ দিয়েছেন। কৌশিক সেন জানিয়েছিলেন, ‘এত ভালো পত্রিকা বিনামূল্যে দেওয়া উচিত নয়।’ উনি পত্রিকাটিকেই গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন, কিন্তু পত্রিকাটি এখনও বিনামূল্য দেওয়া হয়। এটা পাঠকের খুবই সুবিধা। তাই বিনা অনুমতিতেই পাঠকেরা রোববারের দরজায় ঢুকেছে। সম্পাদক ঋতুপর্ণ ঘোষ ও অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় পত্রিকাটিকে একটি টিমের মধ্য দিয়ে স্বতন্ত্রভাবে গড়ে তুলেছেন। যা আজ আঠারোয়ে পা দেবে। আঠারো মানেই প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদ রোববার অনেক আগেই করেছে কয়েকটি মলাটে। যেমন ‘দেওয়াল লিখন’ মলাটে বেশকিছু কার্টুন আঁকা হয়েছিল। যেখানে একদিকে একটি সিম্বল রয়েছে সাদা ধবধবে দেওয়ালে এবং পাশে লেখা ‘সততার প্রতীক’। আর একটি দেওয়াল অন্ধকারে অস্পষ্ট। যেখানে কাস্তে হাতুড়ি মুছে যাবে এমন একটা ছবি দেওয়া আছে। সেই সময়ের প্রতিবাদ। কিংবা ‘পরিবর্তন’ মলাটে ‘র’ এবং ‘ত’-এর রেফ-এ কাস্তে হাতুড়ির চিহ্ন আঁকা ছিল। এভাবেও আজকের আঠারোতে পা দেওয়া রোববার বহু প্রতিবাদ জানিয়েছে। মাঝেমধ্যে ‘রোববার’ গল্পের সংখ্যাও হয়েছে। দু’টি মলাটের কথা মনে আছে ‘চলে গেল কে’ আর ‘নটে গাছ’। একটি মলাটের বিষয় ছিল ‘কবিতার মুহূর্ত’। এই নামকরণ কবি শঙ্খ ঘোষের বইটির নাম অনুসারে। কিন্তু এখানে অংশগ্রহণ করেছিলেন শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অলোরঞ্জন দাশগুপ্ত, নবনীতা দেবসেন, উৎপলকুমার বসু, শ্রীজাত প্রমুখ।