বিদুর রাজাকে যা ব্যাখ্যা করলেন তা মারাত্মক, একালেও হজম করা শক্ত: শীলবান, শাস্ত্রাভিজ্ঞ, জিতেন্দ্রিয় ব্রাহ্মণ দুর্লভ। যে তার বংশপরিচয় ভাঙিয়ে ব্যবসা করে– তা ওষুধের হোক, বা ফল-ফুলের, বা এমনকী, পৌরোহিত্যের– সে নয় প্রকৃত ব্রাহ্মণ। যে মানুষ নাছোড় ভিক্ষালোভী হয়ে রাজা বা ধনীর কাছে হাজির হয়, তাকেই বা ব্রাহ্মণ বলি কী করে? যারা নিজের পুত্রের বিবাহের সময় নিজেদের বংশপরিচয় মূলধন করে মহিলাদের কেনাবেচা করে তারা কি ব্রাহ্মণ নামের যোগ্য?
১৮.
কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধের ফলাফল ‘মহাভারত’-এ যা-ই লেখা থাকুক, জাতকের এই গল্পে ইন্দ্রপ্রস্থ নগরকে কুরুরাজ্যের রাজধানী বলা হচ্ছে। সেখানে রাজত্ব করছেন কৌরব্য নামে এক রাজা। তাঁর প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন বিদুর নামে এক শাস্ত্রজ্ঞ। তাঁর সমনামী যে ‘মহামতি’র কথা আমরা জানি, ইনিও তাঁর মতোই সুবিবেচক এবং ধীমান।
একদিন রাজা কিছুটা বিভ্রান্ত স্বরে বিদুরকে শুধোলেন, আমি নিয়মিত এত দান করি, তবু তৃপ্তি লাভ করতে পারছি না কেন?
সত্যি, সমগ্র জম্বুদ্বীপে তখন কৌরব্যকে ‘মহা দানবীর’ বলা হত।
বিদুর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘বলতে কুণ্ঠাবোধ করছি মহারাজ। তবু আপনি যখন জিজ্ঞেস করলেন তখন বলি, আপনি ক্রমাগত অপাত্রে দান করে চলেছেন।’
–সে কী কথা, কত শত ব্রাহ্মণকে আমি নিয়মিত দান করি তা তো, পণ্ডিতপ্রবর, আপনার অজানা নয়।
–তারা অধিকাংশই ব্রাহ্মণ্যহীন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
নব জাতক। পর্ব ১৭: এত ছোট চারাই যদি এমন হয়, বড় বৃক্ষ হলে না জানি কেমন বিষাক্ত হবে
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
–আপনি কি বলছেন ভ্রান্ত বংশপরিচয় দিয়ে তারা সমাজে বাস করছে?
বিদুর মৃদু হেসে বললেন, ‘ব্রাহ্মণের সন্তান হলেই ব্রাহ্মণ হওয়া যায় না মহারাজ।’
কুরুরাজ তো বটেই, আমরাও আড়াই হাজার বছরের বেশি পুরনো এই সংলাপের অভিঘাতে চমকে উঠি! হিন্দুর অবশ্য-পালনীয় কর্তব্যগুলি গ্রথিত করে যে ‘মনুসংহিতা’, সেটি রচনা করেছিলেন আদি মনু, স্বয়ম্ভুব। ইনি স্বয়ং ব্রহ্মা ও গায়ত্রী হতে সমদ্ভূত। সেই মনুসংহিতা-য় বলা হয়েছে, অগ্নি যেমন প্রণীত বা অপ্রণীত যা-ই হোক তা মহাদেবতা, তেমন ব্রাহ্মণ বংশজাত মানুষ বিদ্যা বা অবিদ্যা যে পথেই চলুন, তিনি নরশ্রেষ্ঠ। এই ধারণাকে প্রশ্ন করার সাহস জুগিয়েছিলেন রাজবংশজাত, তথাকথিত ‘অব্রাহ্মণ’ গৌতম বুদ্ধ।
আমাদের কালের এক ‘অব্রাহ্মণ’ সন্ন্যাসীর দেওয়া উগ্র হুঁশিয়ারির কথা এই প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দিই। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ‘সর্বাবয়ব বেদান্ত’ বক্তৃতায় ৪ মার্চ ১৮৯৪ বলেছিলেন, ‘…সুতরাং ব্রাহ্মণগণ! এদেশ থেকে তল্পি-তল্পা নিয়ে ভেগে পড়ো!… তোমরা আচার্যের আসনে বসতে চাও কিন্তু কার্যকালে ভণ্ডামি করবে– বাহবা।… হে বঙ্গদেশীয় ব্রাহ্মণগণ! তোমরা আর্য হও।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
নব জাতক। পর্ব ১৬: প্রকৃত চরিত্রবানের পিছনে তলোয়ারের আতঙ্ক রাখার দরকার হয় না
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
যাই হোক, বিদুর রাজাকে যা ব্যাখ্যা করলেন তা মারাত্মক, একালেও হজম করা শক্ত: শীলবান, শাস্ত্রাভিজ্ঞ, জিতেন্দ্রিয় ব্রাহ্মণ দুর্লভ। যে তার বংশপরিচয় ভাঙিয়ে ব্যবসা করে– তা ওষুধের হোক, বা ফল-ফুলের, বা এমনকী, পৌরোহিত্যের– সে নয় প্রকৃত ব্রাহ্মণ। যে মানুষ নাছোড় ভিক্ষালোভী হয়ে রাজা বা ধনীর কাছে হাজির হয়, তাকেই বা ব্রাহ্মণ বলি কী করে? যারা নিজের পুত্রের বিবাহের সময় নিজেদের বংশপরিচয় মূলধন করে মহিলাদের কেনাবেচা করে তারা কি ব্রাহ্মণ নামের যোগ্য?
বিমূঢ় কৌরব্য বললেন, ‘তবে প্রকৃত ব্রাহ্মণ কারা? কাদের দান করা আমার কর্তব্য?’
বিদুর বললেন, ‘প্রত্যেকবুদ্ধদের।’
–প্রত্যেকবুদ্ধ?
–প্রকৃতপক্ষে এঁদের ‘প্রায়বুদ্ধ’ বলা উচিত, মহারাজ। যাঁরা বুদ্ধত্ব লাভের যোগ্য, কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে যাঁরা বিশেষ যোগাযোগ রাখেন না, আবার অবতারের মতো তাঁরা সর্বজ্ঞও নন, তাঁরাই প্রত্যেকবুদ্ধ। নিজের উদ্যোগেই তাঁদের সুকৃতি অর্জন, বংশপরিচয়ের কোনও সুপারিশ নেই তাতে।
–বেশ তা-ই হবে।
মহারাজ সায় দিলেন, ‘তাঁদেরই তবে এবার দান করব। কীভাবে তাঁদের নিমন্ত্রণ জানানো হবে?’
তাজা ফুল সঙ্গে নিয়ে তাঁদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে। ভক্তিভরে পঞ্চাঙ্গ প্রণাম জানাতে হবে তাঁদের।
পঞ্চাঙ্গ? সাষ্টাঙ্গ (=স+অষ্ট+অঙ্গ) প্রণাম তো শুনেছি– কপাল, দুই হাত, বুক, দুই জানু ও দুই পা মাটিতে স্পর্শ করে যে প্রণাম।
পঞ্চাঙ্গ প্রণামে কপাল, কোমর, কনুই, হাঁটু আর পা– কিন্তু শেষের তিন অঙ্গ জোড়ায় জোড়ায় থাকায় গুনতিতে আদতে সেই আটটি অঙ্গই হচ্ছে।
যাই হোক, সুষ্ঠুভাবে সাত দিন ধরে চলল সেই দান পর্ব। মহারাজ পুণ্যাত্মাদের প্রভূত আশীর্বাদ পেলেন। আর পেলেন অভূতপূর্ব তৃপ্তি।
সবাই ধন্যি ধন্যি করতে লাগল এই পবিত্র আয়োজনের। শুধু পবিত্র নয়, বিপ্লবাত্মকও বটে। ‘জাতের নামে বজ্জাতি’-র বিরুদ্ধে সেই বুঝি প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক নিশান উড়ল।
ঋণ: দশব্রাহ্মণ জাতক