কোথাও না গিয়েই, বাড়ি বসেই, কাগজ মুড়েই, পাশের কাকুর নাকের ডগা দিয়েই যখন আপনি একটা জিনিস কিনতে পারছেন, তখন আর বেকার পরিশ্রম করে বাঁকাচোখের ভাগীদার হবেনই বা কেন, তাই না? কয়েকদিন আগে একটি খাবার ড্যালিভারি অ্যাপ, যারা বর্তমানে জ্যান্ত অক্টোপাসও ডেলিভারি করে, নিজেদের বিক্রিবাট্টার হিসেব জানিয়েছে। জানা গেছে যে, এ বছর তারা সবচেয়ে বেশি বিক্রি করেছে কন্ডোম।
কয়েকদিন আগে একটি খাবার ড্যালিভারি অ্যাপ, যারা বর্তমানে জ্যান্ত অক্টোপাসও ডেলিভারি করে, নিজেদের বিক্রিবাট্টার হিসেব জানিয়েছে। জানা গেছে যে, এ বছর তারা সবচেয়ে বেশি বিক্রি করেছে কন্ডোম। এ খবরে স্বভাবতই চর্তুদিকে পড়ে গেছে নানাবিধ হুল্লোড়। মজা। স্থূল মজা। সাট্ল মজা। হেব্বি মজা ইত্যাদি। এবার এইসব দেখে তো আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়ার কথা! কারণ প্রথমত কিছু মানুষ অসুরক্ষিত যৌনতাকে বাইক চালানোর সময় মাথায় হেলমেট না পারার মতোই বীরত্ব বলে মনে করেন। আজ্ঞে হ্যাঁ, হেলমেট পরাই হয় যাতে পুলিশ ফাইন না করে। ‘সিগনালটা পেরিয়ে যাই তারপর আর হেলমেট পরার দরকার নেই!’ নিজের সুরক্ষা, অ্যাকসিডেন্টের ভয়? ‘ও কিসু হবে না!’ বেশিরভাগ লোকজন কন্ডোমও পরতে চায় না ওই একই কারণে। বীরত্ব। বাজারে কথা চালু আছে, ‘আ কমান্ডার শুড নো হোয়েন টু রিট্রিট!’ কিন্তু যৌনরোগ? ‘ও কিসু হবে না!’ ফলে সচেতনতার এমন উদযাপন দেখে তো আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ার কথা। দ্বিতীয়ত, এটাও তুমুল স্বস্তি ও মস্তির বিষয় যে যৌনতা নিয়ে এমন খোলাখুলি কথা হচ্ছে। এমনকী, সেই খাবার ডেলিভারি কোম্পানি এবং আরেক কন্ডোম নির্মাণকারী কোম্পানি একে-অপরের সঙ্গে মেতে উঠেছে অনবদ্য মজার সমস্ত স্টেটাস দ্বৈরথে। সভ্য, শিক্ষিত, সীমা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা, লিবারল সমাজের আদর্শ প্রতিচ্ছবি। ইন্টারনেটে। বাস্তবটা খানিক আলাদা হে বেণীমাধব।
…………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: ‘সোলো জার্নি’ তাও নাকি গণপরিবহণে!
……………………………………………………………………………………………………………………………………
বাস্তবে যৌনতা ও তদসংক্রান্ত সবকিছুর প্রতিই আমরা কেমন যেন একটু ইয়ে, অদ্ভুত, বেখাপ্পা। একদিকে ‘যৌনতা’ শব্দটি মাঠে নামলেই স্থান, কাল, পাত্র, মিত্র, বৃত্ত, বিত্ত, বয়স, সম্পর্ক নির্বিশেষে সকলেই একটা অসোয়াস্তিতে পড়ে। অন্যদিকে এসব ক’টা শ্রেণিই আবার এক জায়গায় হয়ে, হইহই করে ফুলশয্যার খাট সাজায়। মাসিমা, পিসেমশাই প্রত্যেকে নিজেদের সেরা চুটকিগুলো জমিয়ে রাখেন। সে এক নিদারুণ ফুর্তির সময়। তা কী হয় ফুলশয্যায়? দু’জন মানুষ যৌনতা করে বা করবে বলে ধরে নেওয়া হয়। এতে কেন আড়াল নেই? কারণ এই প্রক্রিয়া সমাজ কর্তৃক অ্যাটেস্টেড করে সই করে দেওয়া হয়েছে। যাও। এবার করো! অর্থাৎ সমস্যাটা যৌনতায় নয় সমস্যাটা ভ্যালিডেশনে। আর এই ভেলিডেশনের ক্ষেত্রেই কন্ডোম বিষয়টা বিপ্লব এনে ফেলেছে! কন্ডোম তো আর শুধু সমাজ নয়, সরকারপক্ষ থেকেও ভ্যালিডেটেড। কন্ডোম নিয়ে রীতিমতো সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় যে, কন্ডোম ব্যবহার করুন যাতে আপনাকে এইডসের মতো প্রাণঘাতী রোগ বা আরও নানাবিধ যৌন রোগের খপ্পরে না পড়তে হয়। সর্বোপরি এতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু এই সবকিছুর পরেও, যে কোনও ওষুধের দোকানে, এই বর্তমানে সময়ে দাঁড়িয়েও, প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস না থাকলে কন্ডোম কিনতে যাওয়াটা একটা ব্যাপার কিন্তু যাই বলুন!
আপনার বয়স যদি কুড়ির কোঠায় হয়, তাহলে গোটা দোকান আপনাকে আপনার বাবা-মায়ের কথা ভেবে জাজ করবে। সেখানে বিক্রেত-সহ উপস্থিত প্রত্যেকটা মানুষের চোখে লেখা থাকবে, ‘এত কষ্ট করে বাবা-মা বড় করল, এখন এইসব করে বেড়াচ্ছে!’ আর সেখানে যদি কেউ আপনার চেনা বেরিয়ে গেল তো ব্যস! গোটা পাড়া জেনে যাবে যে, আপনি একটা অত্যন্ত স্বাভাবিক, সুস্থ, জীবনযাপন করছেন যা কিনা ‘নোংরামো’র একশেষ। আপনার বয়স যদি তিরিশ-চল্লিশের কোঠায় হয়, তাহলে অবশ্য জাজমেন্ট খানিকটা কমে আসে, কারণ ধরেই নেওয়া হয় আপনি বিবাহিত, আপনার ফুলশয্যার খাট ভালো করে সাজানো হয়েছিল। এক যদি না দোকানে কোনও বয়স্ক লোক উপস্থিত থাকে। কারণ বয়স্ক লোকের সামনে কন্ডোম কেনা মহাপাপ। তার চোখে আপনার শিক্ষা-সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন থাকুক বা না থাকুক আপনি নিজেই কিনতে পারবেন না। কেমন একটা লাগবে। কারণ আমরা বেড়েই উঠেছি ওভাবে। এরপর আরেকটু বয়স যদি হয়ে যায়, এই ধরা যাক পঞ্চাশ-ষাটের কোঠায়, তখন গোটা দোকান আপনার দিকে যেভাবে তাকায় সেটাকে এক কথায় বলে– ‘দাদুর কিন্তু হেব্বি রস’। অবশ্য এই সবক’টাই একজন পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা। কোনও মহিলা যদি কোনও পাড়ার দোকানে কন্ডোম কিনতে চলে যায়, তাহলে যে বয়সেরই তিনি হন না কেন, সকলের সাব-কনসাশে তখন সমাবেত ভাবে ‘বেশরম’ গানটি বেজে ওঠে।
আমার এক বান্ধবীর একটা গল্প বলি, একটি দোকানে কন্ডোম কিনতে গিয়ে সে রিজেক্টেড হয়েছিল। কারণ দোকানের মালিক আমার সেই বান্ধবীকে কোট আনকোট বলেছিলেন– ‘এখানে এসব হয় না।’
…………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: লোকটা হেসেছিল বলে আত্মহত্যা স্থগিত সেইদিন
……………………………………………………………………………………………………………………………………
ফলে কোথাও না গিয়েই, বাড়ি বসেই, কাগজ মুড়েই, পাশের কাকুর নাকের ডগা দিয়েই যখন আপনি একটা জিনিস কিনতে পারছেন, তখন আর বেকার পরিশ্রম করে বাঁকাচোখের ভাগীদার হবেনই বা কেন, তাই না? তাছাড়া অমন একটি আজাইরা কথা কন্ডোমদোকানি বলতে পেরেছিলেন কারণ বাস্তবে যৌনতা ও তদসংক্রান্ত সবকিছুর প্রতিই আমরা কেমন যেন একটু ইয়ে, অদ্ভুত, বেখাপ্পা। তাই যে জিনিসটা থেকে আমোদ সংগ্রহ করি সবচেয়ে বেশি, যেটা সম্পর্কে কোনও যথাযথ শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না বলে পর্নছবি দেখে অমূলক প্রত্যাশা করি, তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে গিয়ে প্রায়শই ভুল, কখনও সখনও অপরাধ এবং হামেশাই নিজেদের হীনমন্য করে ফেলি, সেই জিনিসটা নিয়েই খোলাখুলি কথা বলি সবচে’ কম। নিজেদের মধ্যে তো নয়ই, এমনকী ডাক্তারের সঙ্গেও নয়।
তাই এই গুলুগুলু শীতের দিব্যি সত্যি করে বলুন তো, এটা কি ঠিক হচ্ছে কত্তা?