রাধিকাজীবন কর্মকার, মাত্র ১৬ বছর বয়েসে, ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় এসে, শিষ্যত্ব নিলেন ফটোগ্রাফার যতীন দাসের। দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, আসন্ন দেশভাগ, সদ্য-বিবাহিতা স্ত্রী– কিছুই গ্রাহ্য না করে, গুরুর সঙ্গে পাড়ি দিলেন বম্বে। বম্বে টকিজের কয়েকটা সিনেমায় তাঁর কাজ দেখে, মুগ্ধ হলেন সেইসময়ের কনিষ্ঠতম ডিরেক্টর-প্রোডিউসার, ভবিষ্যতের ‘গ্রেটেস্ট শোম্যান’, রাজ কাপুর। তিনিই সংক্ষেপ করলেন রাধিকার নাম, রাধু। আর, ব্যাপ্তি দিলেন তাঁর লেন্সকে। পছন্দসই আলো না পেলে, ১৫ মিনিট লাগুক কী ১৫ দিন, ওঁরা দু’জনেই বিখ্যাত অপেক্ষা করায়।
ধৈর্য তো ছোটখাটো জিনিস, দম বটে কে. আসিফ আর কামাল আমরোহির! ‘মুঘল-এ-আজম’-এর শুট আসিফ শুরু করলেন ১৯৪৬-এ। বানালেন ১৪ বছর ধরে, নানা ঝঞ্ঝাট সয়ে। আর, ‘পাকিজা’-র শুট আমরোহি শুরু করলেন ১৯৫৬-য়। কাজটা করলেন ১৫ বছর ধরে। দু’জনেরই নো সমঝোতা, সিনেমা নিয়ে। তাঁদের একরোখামির পালে হাওয়া দিলেন কে? লেন্সের আড়ালে, সিনেমাটোগ্রাফার, আর. ডি. মাথুর।
‘মুঘল-এ-আজম’-এর তিনটে ভার্সন: হিন্দি, তামিল, ইংরেজি। প্রতিটা দৃশ্য শুট হবে তিনবার, তিনটে ভাষায়। এক-একটা শটের লাইট বসাতে লাগবে ৭-৮ ঘণ্টা। কারণ, সেটের আয়তন প্রায় সত্যি-সত্যি প্রাসাদ। একটা গোটা শিফটে লাইট বসানোর পর, অ্যাক্টররা আসবেন। শুটিং শুরু, রাত ১২টায়। একটা শট ‘ওকে’ মানে, তিনটে ভাষায় তিনটে শট ‘ওকে’। সারারাত শুটিং করে, ক্যামেরা টিম পাবে কয়েক ঘণ্টার রেস্ট। পরদিন আবার বসাবে অন্য শটের লাইট। বুঝুন!
অম্বর ফোর্টে গিয়ে, আসিফের আইডিয়া এল শিশমহলের– নানাদিক থেকে ইমেজের রিফ্লেকশন। আর্ট টিম সেট বানাল এক বছর ধরে। এদিকে, দেশ-বিদেশের সিনেমাটোগ্রাফির পত্র-পত্রিকা ঘেঁটে, ততদিনে কিছুই বের করতে পারলেন না মাথুর। কী করা যায়? এক্সপেরিমেন্ট শুরু, দিনরাত। একদিন, রিফ্লেকটর পেপারে লাইট ফোকাস করে, সেটের পিলারে প্রতিবিম্বিত আলো দেখে, ইউরেকা! ওটাই শিশমহলের বাউন্সড লাইটিং।
‘পাকিজা’-র সিনেমাটোগ্রাফার, জোসেফ ওয়ার্শিং মারা গেলেন প্রোডাকশন শেষ হওয়ার আগেই। ‘মুঘল-এ-আজম’-এর রাইটিং টিমে থাকার সূত্রে, আমরোহি চিনতেন মাথুরকে। তাঁকেই বললেন বাকিটুকু উতরে দিতে। বাকিটুকু মানে? শুধু শুটিং? ধুস! দেড় দশক ধরে, একাধিক হাতে শুট হওয়া রিলগুলো দেখুন! মনে হবে, ওগুলো আলাদা যুগের আলাদা ফিল্মের। ল্যাবে বসে, এক-একটা রিল ধরে ধরে, এক-একটা ফ্রেম মেলাতে শুরু করলেন মাথুর। আমরা দেখলাম ফাইনাল প্রিন্ট, নিখুঁত।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ফ্ল্যাশব্যাক। পর্ব ১৭: যে ছায়ার আলোতে বড় হয়েছেন শ্রীদেবী, রজনীকান্ত, কমল হাসান
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
খুঁতখুঁতে বটে সুব্রত মিত্র, সত্যজিৎ রায়ের প্রথমদিকের সিনেমাটোগ্রাফার। শোনা যায়, সুব্রত একবার একটা টোস্টার কিনতে, ঢুঁড়ে ফেললেন গোটা কলকাতা। ল্যান্সডাউনে ফেরার পথে, কিনলেন অনেকরকম পাউরুটি। বাড়িতে ঢুকে, প্রত্যেকটা, হ্যাঁ, প্র-ত্যে-ক-টা স্লাইস টোস্ট করলেন। দেখলেন, সবকটা স্লাইস সমানভাবে টোস্ট হয়নি; হয় রং মেলেনি, নইলে মেলেনি মুচমুচেপনা। তখুনি দোকানে গিয়ে, টোস্টার ফেরত দিলেন তিনি। আর, বাতিল টোস্টগুলো খাইয়ে দিলেন রাস্তার কুকুরদের।
‘পথের পাঁচালি’ থেকে ‘নায়ক’ পর্যন্ত সত্যজিতের কাজ দুনিয়া জুড়ে এমনি এমনি গেঁথে যায়নি। ক্যামেরা অন থাক বা অফ, কোনও জিনিস ওপর-নিচে হলেই, না-পসন্দ সুব্রতর। চা-পাতা ভিজবে মাপ মতো; জলটা গরম হবে বেশিও না, কমও না। মশারির চারটে কোণ টাঙানো হবে সমান। ফ্রেমে চাই আলো-ছায়ার সঠিক বন্দিশ; ল্যাবে প্রসেস হবে পারফেক্ট; থিয়েটারের প্রোজেক্টরে গোলমাল যেন না থাকে। প্যারিসের ফিল্ম স্কুলে পড়াকালীন, ত্রুফোর সিনেমাটোগ্রাফার, নেস্টর অ্যালমেন্ড্রস মুগ্ধ হলেন ‘চারুলতা’ দেখে। সুব্রতর টেকনিক কাজে লাগালেন তিনিও।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ফ্ল্যাশব্যাক। পর্ব ১৬: যাদের ১৮ হয়নি, তারা এসব বুঝবে না; আর, যাদের ১৮ হয়েছে, তারা মজা পাবে
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সিনেমা, ‘কাগজ কে ফুল’। গান, ‘ওয়াক্ত নে কিয়া ক্যা হাসিঁ সিতম…’। দৃশ্যটা মনে করুন। নায়ক, একজন ডিরেক্টর। অধিকাংশ শট তাই সেটের ভেতরেই। কয়েকটা বড় আয়না বসিয়ে, স্টুডিওর ছাদ থেকে গড়িয়ে আসা রোদ্দুরের মায়াজাল বাঁধলেন সিনেমাটোগ্রাফার, ভি. কে. মূর্তি। নিও-রিয়েলিস্ট সিনেমাটোগ্রাফিতে, পূর্ব ভারতে সুব্রত, তো পশ্চিম ভারতে মূর্তি। গুরু দত্তের ‘বাজি’-তে, সিনেমাটোগ্রাফার ভি. রাত্রার বদলে, দুয়েকটা শট নেওয়ার সুযোগ পেলেন তিনি। ব্যাস, মূর্তি আর গুরু– দু’জনে বিমূর্ত করে দিলেন পাঁচের দশক। তাঁর দীর্ঘদিনের সহকারী, গোবিন্দ নিহলানি বলেছেন, ‘ইন্ডিয়ান ফিল্মের ইমেজে সত্যিকারের গুরু, মূর্তি।’
জহুরি জহর চেনে। বিমল রায় নিজে ছিলেন সিনেমাটোগ্রাফার, নিউ থিয়েটার্সে। অ্যাসিস্ট্যান্ট কমল বোসকে চিনতে ভুল হয়নি তাঁর। কমলকে বম্বে নিয়ে গেলেন তিনি। বিমল রায়ের ডিরেকশনে, আইকনিক সব সিনেমার লেন্সে, কমল। ‘পেহলা আদমি’-র একটা দৃশ্য, জঙ্গলে, ঘুটঘুটে রাত। খুব সামান্য লাইট নিয়ে, ক্যামেরা অন করলেন কমল। গোটা ইউনিট অবাক, এ কী রে ভাই! নিজের ইনস্টিংক্টে ভরসা রেখে, যা করলেন কমল, শেষমেশ সকলেই খুশ।
বিমল রায় মারা যাওয়ার পর, তিনি ঢুকলেন অসিত সেন আর ফিরোজ খানের টিমে। ফিরোজের ফিল্মমেকিং সেন্স, আগের দু’জনের উলটো। আফগানিস্তানে শুট, ‘ধর্মাত্মা’। একটা সিকোয়েন্সে, মধ্য-প্রাচ্যের যাযাবর উপজাতিদের প্রিয় খেলা, বুজকশি। একটা ভেড়া বা বাছুর ছেড়ে দেওয়া হয় মাঠে। সেটাকে তাড়া করে দু’দলের ঘোড়সওয়ার। ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে বসেই, সেটাকে ধরে গোলে পাঠাতে হয়; মানে, ওটাই বল। এ খেলায় হতাহত হওয়া কোনও ব্যাপার না। ফিরোজ আর কমল চাইলেন, শট যেন রিয়েলিস্টিক হয়। চারিদিকে টগবগে ঘোড়ার মাঝমধ্যিখানে, ক্যামেরা নিয়ে, দাঁড়ালেন কমল। আর, পিছন থেকে তাঁকে জাপটে ধরে রাখলেন ফিরোজ।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ফ্ল্যাশব্যাক। পর্ব ১৫: পারিশ্রমিকের কথা না ভেবেই নপুংসকের চরিত্রে কাজ করতে চেয়েছিলেন শাহরুখ খান
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এখনও পর্যন্ত, ডিরেক্টর হিসেবে, সবথেকে বেশি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডের রেকর্ড বিমল রায়ের, ৭টা। আর, সিনেমাটোগ্রাফিতে রেকর্ডটা তাঁরই প্রিয়তম সিনেমাটোগ্রাফার কমল বোসের, ৫টা। শুধু তাই? লাগাতার ৩ বছর ওই অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার রেকর্ডও তাঁর। শুধু তাই-ই? সাদা-কালো আর রঙিন — তিনি পুরস্কৃত দুটো বিভাগেই। এই একই রেকর্ড, রাধু কর্মকারের। রাধুর ফিল্মফেয়ার, ৪টে।
রাধিকাজীবন কর্মকার, মাত্র ১৬ বছর বয়েসে, ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় এসে, শিষ্যত্ব নিলেন ফটোগ্রাফার যতীন দাসের। দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, আসন্ন দেশভাগ, সদ্য-বিবাহিতা স্ত্রী– কিছুই গ্রাহ্য না করে, গুরুর সঙ্গে পাড়ি দিলেন বম্বে। বম্বে টকিজের কয়েকটা সিনেমায় তাঁর কাজ দেখে, মুগ্ধ হলেন সেইসময়ের কনিষ্ঠতম ডিরেক্টর-প্রোডিউসার, ভবিষ্যতের ‘গ্রেটেস্ট শোম্যান’, রাজ কাপুর। তিনিই সংক্ষেপ করলেন রাধিকার নাম, রাধু। আর, ব্যাপ্তি দিলেন তাঁর লেন্সকে। পছন্দসই আলো না পেলে, ১৫ মিনিট লাগুক কী ১৫ দিন, ওঁরা দু’জনেই বিখ্যাত অপেক্ষা করায়।
বলা হয়, ডিরেক্টরের চোখ সিনেমাটোগ্রাফার। রাধু বলতেন, ক্যামেরাই তাঁর তৃতীয় নয়ন। রাজ কাপুর এতই ভালোবাসতেন তাঁকে, শোনা যায়, আর. কে. স্টুডিওর গেটে, জাস্ট ‘রাধু কর্মকারের বাড়ির লোক’ বললেই, সোওজা এন্ট্রি। শুধু রাজ কাপুর? মশাই, চার্লি চ্যাপলিন প্রশংসায় পঞ্চমুখ তাঁর কাজের! গান, ‘প্যার হুয়া ইকরার হুয়া…’। চ্যাপলিন বিশ্বাস করতে পারেননি, ওই আউটডোরটা আসলে স্টুডিওর ভেতরেই! ইন্ডাস্ট্রির তাবড়জনদের সঙ্গে যাঁর ওঠা-বসা, সেই রাধু কর্মকার, শুটিং না থাকলে, গাড়ি চড়তেন না; বরাবর তাঁর যাতায়াত, বাসেই।
হিন্দি সিনেমায় ফটোগ্রাফির একটা বিশেষ স্টাইলকে বলা হয়, ‘যশ চোপড়া শট’। বি. আর. চোপড়া ফিল্মস থেকে বেরিয়ে, নিজের ইউনিট বানানোর তোড়জোড় করছিলেন যশ। খবর পেয়ে, অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্যামেরাম্যান কোরেগাঁওকার ওরফে কে জি (Kay Gee) ঢুকলেন তাঁর টিমে। তখন একের পর এক অ্যাকশন ফিল্মে, যশ– ‘দিওয়ার’, ‘ত্রিশূল’, ‘কালা পৎথর’। সুচারু লেন্সে কে জি সামলালেন রাগী নায়কদের আগুন-তুবড়ি। সেই যশ-ই যখন হাত দিলেন রোমান্সে, সেই কে জি-ই মাতিয়ে দিলেন ক্যামেরা। হ্যাঁ, ‘কভি কভি’ আর ‘সিলসিলা’।
দুঃখের হলেও সত্যি, স্টার আর ডিরেক্টরের জৌলুশে হারিয়ে যান এইসব নেপথ্যের মানুষ। কে জি-কেই দেখুন, ওরকম অপরূপ সব ফ্রেমের রূপকার, মাত্র কিছু বছরেই, আবছা! এমনকী, ইন্টারনেটের জনারণ্যে, একটাও ছবি নেই তাঁর। প্রচুর চেষ্টাচরিত্র করে, এই প্রথম, অনলাইনে এল তাঁর মুখ। আর, সে দৌলতেই, আজ ঋদ্ধ এ কলাম।