নেটফ্লিক্সে সদ্য মুক্তি পেয়েছে অবিনাশ অরুণের ছবি, ‘থ্রি অফ আস’। ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত শৈলজা ফিরে গিয়েছিল ছোটবেলায় গ্রামে। বিগত জন্মে। আর জোয়েলের মতোই, সব কিছু ভুলে যাওয়ার আগে, শৈলজা মুগ্ধবালিকার মতো ছুঁয়ে দেখছিল তার স্মৃতির শহর। তার ভেঙ্গুরলা গ্রাম। স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখছিল স্কুলের বেঞ্চ। নাচের মুদ্রা। আর সেই একটা কুয়ো। শৈলজা কিন্তু স্মৃতির বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই করছিল না। যে ‘আমি’কে সে ভুলে যাবে চিরতরে, আয়নার সামনে দাঁড়ালেও হয়তো চিনতে পারবে না আর!
একটা স্মৃতির কুয়ো। গভীরে অন্ধকার। হাত ফসকে যে অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল প্রিয়জনের মুখ! সে অন্ধকার আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে– আজীবন! ব্ল্যাকহোলের মতো টেনে নিতে চাইছে রক্ত, মাংস, অবশিষ্ট স্মৃতি। কুয়োতলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কৈশোর। নাচের স্কুল। সাইকেল-যুগল। আর বিস্তীর্ণ সৈকত। শুধু ঢেউ। ঢেউয়ের শব্দ। কিন্তু এই সমস্তটাই মুছে যাবে একদিন। সমুদ্রজল যেমন করে ধুয়ে দেয় ছোট ছোট বালির পাহাড়! শেষমেশ শুধু দাঁড়িয়ে থাকে একজন মানুষ। ধরে নিই তার নাম– শৈলজা। যেন নিঃস্ব! ভারহীন। হু হু করে বুক।
এমন এক সমুদ্রের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল জোয়েল এবং ক্লিমেন্টাইন। আমরা দেখছি, ক্লিমেন্টাইন লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, জোয়েলের স্মৃতি থেকে। যেন একটা একটা আনটাইটেল্ড ফোল্ডার। ডিলিট করে দিচ্ছে কেউ। অথচ জোয়েল চাইছে ক্লিমেন্টাইন থাকুক। প্রেমে উথালপাতাল করে দিক আবার। স্মৃতিনির্মিত দেশে, কখনও মহাদেশে জোয়েল ক্লিমেন্টাইনের হাত ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তাই। ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে অতীত। যে যন্ত্র, যে অতিপ্রাকৃতিক প্রক্রিয়া জোয়েলের স্মৃতিপথে ঢুকে পড়েছে, জোয়েল সেই স্মৃতিলুপ্ততার বিরুদ্ধে একটা অসম যুদ্ধ করতে করতে একটা সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে। এরপর কিচ্ছু থাকবে না। স্মৃতির ভেতরে ক্লিমেন্টাইন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: সফদর মারা গেছে, কিন্তু ধমনীতে সে বেঁচে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
–‘আর কিছুক্ষণ পরেই আমি হারিয়ে যাব। জোয়েল, কী করব আমরা এখন?’
–‘মুহূর্তটা উপভোগ করি!’
স্মৃতি তো মুহূর্তজাত। তাই বোধহয় চন্দ্রবিন্দু গেয়েছিল, ‘মুহূর্তরা মুহূর্তের কাছে ঋণী’। যদি স্মৃতিবিলুপ্তি ঘটতে শুরু করে, সাধ হয় মুহূর্তগুলো রিভাইস দিয়ে নিতে। শেষবারের জন্য। আসলে এতক্ষণ যা লিখলাম, তা ঘটছিল ‘ইটার্নাল সানশাইন অফ দ্য স্পটলেস মাইন্ড’ ছবিতে। বিস্মৃতির আপাত অনিবার্য পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছিল একটি ছেলে, একটি মেয়ে।
হঠাৎ করেই সে-ছবির কথা মনে পড়ল? তা ঠিক নয়। নেটফ্লিক্সে সদ্য মুক্তি পেয়েছে অবিনাশ অরুণের ছবি, ‘থ্রি অফ আস’। ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত শৈলজা ফিরে গিয়েছিল ছোটবেলায় গ্রামে। বিগত জন্মে। আর জোয়েলের মতোই, সব কিছু ভুলে যাওয়ার আগে, শৈলজা মুগ্ধবালিকার মতো ছুঁয়ে দেখছিল তার স্মৃতির শহর। তার ভেঙ্গুরলা গ্রাম। স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখছিল স্কুলের বেঞ্চ। নাচের মুদ্রা। আর সেই একটা কুয়ো। শৈলজা কিন্তু স্মৃতির বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই করছিল না। যে ‘আমি’কে সে ভুলে যাবে চিরতরে, আয়নার সামনে দাঁড়ালেও হয়তো চিনতে পারবে না আর! সেই আদি উৎসের ‘আমি’তে কিংবা সেই আত্মায় বেঁচে থাকতে চাইছিল তিন-চারটে দিন। শৈলজার এই স্মৃতিসফরে সঙ্গী হয়েছিল দীপঙ্কর। তার স্বামী। এবং প্রদীপ কামাথ। একজন কবি। শৈলজার না-হওয়া প্রেম।
বিস্মরণের গল্প শুনতে শুনতে ফের মনে পড়ছিল একটি উপন্যাস। ‘মেমোরি পুলিশ’। একটি অনামী দ্বীপে আকস্মিকভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য বস্তু। কোনও এক অদ্ভুতুড়ে শক্তির ক্রিয়াকর্মে। ক্রমশ বোধগম্য হয়, বাস্তবে না, সেসব হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের স্মৃতি থেকে। ধরা যাক, একটি বই। এইবার বই-সম্পর্কিত যাবতীয় ধারণা যদি আমাদের স্মৃতি থেকে লোপ পেয়ে যায়, তবে সে কি আর ‘বই’ থাকে? ইয়োকো ওয়াগার এ-উপন্যাসও যুদ্ধের আখ্যান। স্মৃতির সঙ্গে রাষ্ট্রের। একটি অল্পবয়সি মেয়ে গল্প বলতে শুরু করেছে। মেয়েটির মায়ের স্মৃতি তখনও অনাক্রান্ত। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য গোপন তোরঙ্গে সেই মা যত্ন করে তুলে রেখেছে যা কিছু হারিয়ে গেছে। যেন গোপন তোরঙ্গ ধারণ করছে শুধুই স্মৃতি। যেমন শৈলজার ক্ষেত্রে প্রদীপ কামাথ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
স্মৃতি তো মুহূর্তজাত। তাই বোধহয় চন্দ্রবিন্দু গেয়েছিল, ‘মুহূর্তরা মুহূর্তের কাছে ঋণী’। যদি স্মৃতিবিলুপ্তি ঘটতে শুরু করে, সাধ হয় মুহূর্তগুলো রিভাইস দিয়ে নিতে। শেষবারের জন্য।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
স্মৃতিভ্রংশের এই অসুখের আগে শৈলজা কেমন ছিল? এখন কেমন আছে? ভবিষ্যতে কেমন থাকবে? শৈলজার যেন তিন সত্তা! একশরীরে বর্তমান। তিন সত্তার মধ্যে একটি প্রদীপ কামাথ। একটি দীপঙ্কর। আর সর্বশেষটি সমুদ্রজল। হয়তো স্বতন্ত্রভাবে সিনেমায় বিচরণ করেনি। করছে আমাদের মস্তিষ্কে। আমরা টের পাচ্ছি, কৈশোরের কোল ছিঁড়ে যখন শৈলজা চলে গিয়েছিল! সে-মুহূর্তের আশ্চর্য বিষাদ। অবিনাশ অরুণের প্রথম ছবি ‘কিল্লা’-র কথাই যদি বলি। সেখানেও তো অমন বিষাদ। এগারো বছর বয়সি চিন্ময়, বাবার মৃত্যুর পর, ছেড়ে যাচ্ছে তার গ্রাম। আদরের স্কুল। আর বন্ধু। তারপর সম্পূর্ণ নতুন জীবনের সম্মুখীন চিন্ময়। আবেগের অথৈ জলে হাবুডুবু। চিন্ময়ের বোধজুড়ে অগাধ প্রকৃতি। আসলে চিন্ময় বড় হচ্ছে। চিন্ময় যদি কখনও ছোটবেলার গ্রামে ফিরে আসে, তবে কি শৈলজার সঙ্গে তার দেখা হয়ে যাবে? জানি না।
দেখুন, ক্যামেরা চলছে শৈলজার সমান্তরালে। পুরনো কেল্লায়। ক্যামেরা এখন প্রদীপ কামাথের চোখ হয়ে গেছে। সে দেখছে প্রাচীন বটগাছের শিকড়। কেল্লার হাড়-জিরজিরে দেওয়াল। আর একঝলক শৈলজার মুখ। সে এক আদিম প্রেম। যে প্রেমের আলো পেয়ে প্রদীপের মুখ কয়েক মুহূর্তের জন্য উজ্জ্বল। তারপর অন্ধকার। কেন? যেহেতু শৈলজার স্মৃতি এরপর ক্ষয়ে যাবে। কী অসামান্য এই দৃশ্য! দীর্ঘ কোনও কবিতা মনে হয়। বোধ করি তেমনভাবেই ছবিটি নির্মাণ করেছেন অবিনাশ অরুণ এবং দুই সংলাপ-লিখিয়ে বরুণ গ্রোভার ও শোয়েব জুলফি নাজির। শৈলজার চরিত্রে শেফালি শাহ এবং প্রদীপের চরিত্রে জয়দীপ আহলাওয়াত– আশ্চর্য! শান্ত নদীর মতো! তবুও, দীপঙ্করের চরিত্রে সানন্দ কিরকিরে হৃদয়ে গেঁথে থাকে বেশি। দীপঙ্করের হাত ধরেই তো ভেঙ্গুরলা গিয়েছিল শৈলজা। প্রদীপ কামাথ নামটির সঙ্গেও তার পরিচয় তখনই! আবেগে উদ্বেলিত সে হয়েছে, অথচ কী পরিমিত স্বভাবে। শৈলজা এবং প্রদীপ– উভয়ের বিগতজন্ম তাকে অবাক করে দিয়েছে। এতে কোনও নাগরিক কালি লেগে নেই। বরং মুহূর্তের উদযাপন আছে। অপার ভালো লাগা আছে।
শৈলজা ও প্রদীপ! এরপরে আমরা উঠে পড়ব একটা নাগরদোলায়। ২৮ বছর ধরে জমিয়ে রাখা দুঃখকথা উগড়ে দেব শূন্যে ভাসতে ভাসতে। নাগরদোলা গোল গোল ঘুরবে। অতীত। বর্তমান। ভবিষ্যৎ। সময়গ্রন্থিতে নাগরদোলাই ঘুরবে। আমরা কখনওই ফিরে যেতে চাইব না সেইসব ফাগুন ফাগুন দিনে। স্মৃতির শহরটা ধসে যাবে একদিন। স্মৃতির অসুখ যখন জাঁকিয়ে বসবে শৈলজার, এসে দাঁড়াব একটা কুয়োর সামনে। তারপর দীর্ঘশ্বাস।
স্মৃতিহীনতার? নাকি আজন্মকাল ধরে যে মৃত মুখ আমরা ভুলতে চেয়েছি, সেটা ভুলে গেলাম বলে? শরীরটা মনে হবে পালকের তৈরি! হাওয়া দিলেই উড়ে যাব ঠিক!