অন্য কাহিনির চেয়ে রাম কাহিনির জনপ্রিয়তা ছিল অনেক বেশি ফলে যত দিন যেতে থাকে অমর চিত্রকথার ঝুলিতে একে একে আসতে থাকে রামায়ণের নানা ছোট-বড় চরিত্র। প্রকাশ পায় ‘লঙ্কার প্রভু’, ‘বালী’, ‘দশরথ’, ‘রামের পূর্বপুরুষ’, ‘মহিরাবণ’, ‘কুম্ভকর্ণ’ ইত্যাদি। রামকাহিনির উৎস ধরে প্রকাশিত হয় রামের নয় পূর্বপুরুষের গল্প। কালিদাসের রঘুবংশম-কে আশ্রয় করে।
শুরুর গল্পটা অনেকের জানা। ১৯৬৭ সালে টেলিভিশনে একটি কুইজ শো দেখছিলেন ‘ইন্ডিয়া বুক হাউস’-এর কর্মচারী অনন্ত পাই। দেখলেন, স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা অবলীলায় গ্রিক পুরাণের কঠিন সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু যে দিল্লিতে প্রতি বছর জায়গায় জায়গায় রামলীলা হয়, তারা সামান্য ‘রামের মায়ের নাম কী?’ প্রশ্নের উত্তর দিতে দশবার ঢোঁক গিলছে। অনন্ত পাই বুঝে গেলেন তাকে ঠিক কী করতে হবে।
বোম্বেতে ফিরে প্রথমেই নিজের স্ত্রী, ভাইপো-ভাইজিদের নিয়ে ছোট্ট একটা শিশু-কিশোরদের ম্যাগাজিন প্রকাশ করলেন ভদ্রলোক। নাম দিলেন ‘ফ্যামিলি নিউজ’। নিজের হাতে তাতে পুরাণের নানা কাহিনি লিখতেন। কিন্তু তাতে তেমন সাড়া পাচ্ছিলেন না। এবার তার নজর পড়ল ছবিতে গল্পের দিকে। আই বি এইচের প্রকাশক মীরচন্দানীকে বলে বিদেশি ক্লাসিক ইলাস্ট্রেটেড সিরিজের দেশি রাইট নিয়ে কিছু বই হিন্দিতে ছেপে দেখলেন। সুবিধে হল না। এইখানে মীরচন্দানি একটা ভাল বুদ্ধি দিলেন পাইকে। বললেন, ‘আপনি বরং উল্টোটা চেষ্টা করুন না। বিদেশি গল্পকে দেশি ভাষায় না এনে দেশি গল্পকে ইংরাজিতে ছেপে দেখুন।’
১৯৬৭ সালে প্রথমবার ‘ইন্ডিয়া বুক হাউস’ থেকে ভারতীয় পুরাণের গল্পকে সম্বল করে কমিকস বেরল। কৃষ্ণ। লেখক অনন্ত পাই। আঁকিয়ে রাম ওয়াহিরকর। সাফল্য দেরিতে এল, কিন্তু এল। প্রথম দুই তিন বছর হাজার দশেক বিক্রির পর আচমকা বইয়ের বিক্রি আকাশ ছুঁল। আটের দশক আসতে না আসতে বিক্রি লাখ পেরল। ১৯৯০-তে অমর চিত্রকথা বিক্রি হতে লাগল ৮০ লক্ষের-ও বেশি!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: সম্পদ ও বিপদ– কলকাতা দুই-ই দিয়েছিল বিবেকানন্দকে, প্রাণভরে
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সেসব কথা থাক। কিন্তু যে রামায়ণের কুইজ দিয়ে আর রাম ওয়াহিরকরের হাত ধরে এই কমিকস সিরিজের যাত্রা শুরু সেখানে রামায়ণ যে আলাদা করে গুরুত্ব পাবেই, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সিরিজে কৃষ্ণের ঠিক চারটি বইয়ের পরেই এসেছে রাম নামের কমিকস। লেখক যথারীতি অনন্ত পাই। এখানে বলে রাখি, লব-কুশ বা সীতার পাতাল প্রবেশ-সহ পরের নানা ঘটনা এই বইতে বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যতটুকু রেখেছেন সেটাই কিশোর উপযোগী ন্যারেটিভ লেখার এক অনবদ্য টেমপ্লেট হিসেবে থেকে যাবে। আবার একেবারে শুরু, মানে যেখানে দস্যু রত্নাকর বাল্মিকী হয়ে উঠছেন, যে গল্প এই রামায়ণে লেখেননি পাই। এখানে কাহিনিকে শিশুদের উপযোগী করে তুলতে শৃঙ্গাররত দুই বকের ব্যাধের দ্বারা বধ এবং আদিকবির মুখের প্রথম শ্লোক ‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ। যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।’ থেকে কামকে সম্পূর্ণ সরিয়ে দিলেন তিনি।
প্রথম দশটি অমর চিত্রকথা সংখ্যার মধ্যে তিনটি ছিল রামায়ণের গল্প। একেবারে শুরুর ১ থেকে ১০ বিদেশি গল্পের অনুবাদ হওয়ার পর, ১১ নম্বর ছিল কৃষ্ণ। সে হিসেবে সিরিজের পরের তিনটিই রাম আশ্রিত কাহিনি; ‘রাম’ (১৫); ‘রামের পুত্ররা’ (১৮) আর ‘হনুমান’ (১৯)। অন্য কাহিনির চেয়ে রাম কাহিনির জনপ্রিয়তা ছিল অনেক বেশি ফলে যত দিন যেতে থাকে অমর চিত্রকথার ঝুলিতে একে একে আসতে থাকে রামায়ণের নানা ছোট-বড় চরিত্র। প্রকাশ পায় ‘লঙ্কার প্রভু’, ‘বালী’, ‘দশরথ’, ‘রামের পূর্বপুরুষ’, ‘মহিরাবণ’ , ‘কুম্ভকর্ণ’ ইত্যাদি। রামকাহিনির উৎস ধরে প্রকাশিত হয় রামের নয় পূর্বপুরুষের গল্প। কালিদাসের রঘুবংশম-কে আশ্রয় করে। একেবারে শুরুর সংস্করণে পাইয়ের লেখা একটা সম্পাদকীয় নোট ছিল। তাতে লেখা ‘ধরা হয় রাম ছিলেন আদর্শ রাজা। গান্ধিজিও রামরাজ্য স্থাপনের কথা বলেছিলেন। রামের পূর্বপুরুষরাও কিছু বীর এবং মহান যোদ্ধা ছিলেন কিন্তু রামের মত সর্বগুণের আধার ছিলেন না। বীরদের-ও চরিত্রে নানা দোষ থাকে, এদের-ও তেমনই ছিল। কারণ পুরাণ মিথ্যে বলে না’– আর তারপরেই তিনি এক অদ্ভুত বাক্য লিখলেন যা সরাসরি ইংরেজিতেই তুলে দিচ্ছি– ‘Like Rama, his ancestors also had flawed characters despite the glory of their personalities.’ কিন্তু গোটা বইতে রামের কোনও flawed character দেখানোর পথে পাই হাঁটেননি। বরং তার পূর্বপুরুষ রঘু, অজ আর দশরথের চেয়ে রাম কত মহান বারবার সেটাই প্রমাণ করেন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সিরিজে কৃষ্ণের ঠিক চারটি বইয়ের পরেই এসেছে রাম নামের কমিকস। লেখক যথারীতি অনন্ত পাই। এখানে বলে রাখি, লব-কুশ বা সীতার পাতাল প্রবেশ-সহ পরের নানা ঘটনা এই বইতে বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যতটুকু রেখেছেন সেটাই কিশোর উপযোগী ন্যারেটিভ লেখার এক অনবদ্য টেমপ্লেট হিসেবে থেকে যাবে। আবার একেবারে শুরু, মানে যেখানে দস্যু রত্নাকর বাল্মিকী হয়ে উঠছেন, যে গল্প এই রামায়ণে লেখেননি পাই।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পাইয়ের লেখা ‘রাম’ বইটি যে মূলত কম্বন আর তুলসীদাসের রামায়ণ মিলিয়ে মিশিয়ে লেখা হয়েছে, সেকথা পাই নিজেই স্বীকার করেছেন। বরং বালী, হনুমান, লঙ্কার প্রভু কাহিনিতে বাল্মিকীর প্রভাব স্পষ্ট। এদের মধ্যে দু’টি কুম্ভকর্ণ আর মহিরাবণের কাহিনি পাই নিয়েছেন আমাদের বাংলার ঘরের কবি কৃত্তিবাসের থেকে। শুরুতে সম্পাদকীয় নোটে সেই উল্লেখ-ও আছে।
পরবর্তীকালে অমর চিত্রকথার রামায়ণ মূলত তিনটি আলাদা বই পায়। একটি ‘বাল্মিকীর রামায়ণ’। পেপারব্যাক। লেখক অনন্ত পাই। এটি একটি স্পেশাল এডিশন হিসেবে ছাপা হয়। পৃষ্ঠাসংখ্যা ৯৬। ২০১০ সালে প্রকাশিত হয় অওধিতে লেখা তুলসীদাসের রামায়ণের ইংরেজি কমিকস রূপ। এখানে সম্পাদক হিসেবে অনন্ত পাইয়ের নাম থাকলেও চিত্রনাট্য মার্জি শাস্ত্রীর। তবে সবচেয়ে বড় রামায়ণের প্রজেক্ট কিছুদিন আগেই (২০১৭) প্রকাশ করেছে অমর চিত্রকথা। এখানে ৬ খণ্ডের হার্ড কভারে ৯৬০ পৃষ্ঠায় বিপুলাকারে গোটা রামায়ণ ধরা হয়েছে। মূলত বাল্মীকির রামায়ণ আশ্রিত এই বিশাল কমিকস বাল কাণ্ড, অযোধ্যা কাণ্ড, অরণ্য কাণ্ড, কিস্কিন্ধা কাণ্ড, সুন্দর কাণ্ড আর যুদ্ধকাণ্ড নিয়ে তৈরি। এই গোটা বইটির স্ক্রিপ্ট লিখেছেন হারিনি গোপালস্বামী শ্রীনিবাসন। পাঁচজন শিল্পী মিলে এই দুরন্ত কাজটিকে রূপ দিয়েছেন যাদের মধ্যে আমাদের বাংলার শিল্পী অরিজিৎ দত্ত চৌধুরীও আছেন।
একেবারে শেষে একটু এই বাংলার কথা বলি। এখনও যে কোন বাঙালি শিশুকে প্রথমবার রামায়ণের স্বাদ দিতে পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তীর ছবিতে রামায়ণের পরপরই যে রামায়ণের দিকে হাত বাড়ানো হয়, তা উপেন্দ্রকিশোরের রামায়ণ। রাজশেখর কৈশোরে আর তারপরেও রামায়ণের নেশা থাকলে আরও নানাবিধ। এর মধ্যে যদি আর একটিও রামায়ণ মাথা গলাতে পারে, তা অবশ্যই পাইয়ের অমর চিত্রকথা। সম্পূর্ণ কিশোরপাঠ্য হয়েও মূলানুগ, এবং রামায়ণের মূল রস এতে অক্ষুণ্ণ। কিশোরের সঙ্গে তাঁদের বাবা-মায়েরা পড়লেও অনেক কিছু জানতে পারবেন, যা আগে হয়তো জানা ছিল না। রামায়ণের পাঠান্তর, স্থানিক ভেদে গল্পের পরিবর্তন, চরিত্রের বিন্যাস– এই সমস্ত কিছু তুলি কালিতে ধরেছেন অমর চিত্রকথার লেখক শিল্পীরা। এত বড় মহাকাব্যকে এইভাবে ধরা সহজ কাজ না।