আজকের পৃথিবীতে প্রতিরোধ ও পরিবর্তনের ধারণা পাল্টালেও, উগ্র জাতীয়তাবাদ, দক্ষিণপন্থী জনপ্রিয়তাবাদ ও আগ্রাসী নয়া-সাম্রাজ্যবাদের বিপদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হলে লেনিনের রাজনৈতিক চিন্তাকে নতুন করে পড়া দরকার। প্রতিটি যুগ নিজের জায়গা থেকে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে। বিপ্লবের অর্থ বিবর্তিত হয়। কিন্তু, লক্ষ্য, পন্থা, সংগঠন, চেতনা, ও সত্যের সন্ধান আমাদের নিত্য পাথেয়। সুতরাং, লেনিনের জীবন ও চিন্তা থেকে অনুপ্রেরণার রসদ পাবে সমস্ত প্রজন্মের মানুষ।
বলশেভিক বিপ্লবের প্রধান রূপকার ও অন্যতম ক্ষুরধার বিশ্লেষক হিসেবে ভ্লাদিমির লেনিন যে উত্তরাধিকার রেখে গেছেন, তা এক কথায় প্রতিদন্দ্বীহীন। কিন্তু, তার এই নজিরবিহীন অসামান্যতা জন্ম দিয়েছে নানা বিতর্কের। তাকে কেন্দ্র করে একাধারে বীরপূজা এবং কঠোর সমালোচনার শেষ নেই। তাছাড়া, কোনও রাষ্ট্র তাত্ত্বিক স্থান-কালের ঊর্ধ্বে নন। এই বিষয়টি লেনিনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য।
একটা ছোট আকারের প্রবন্ধে সেই বহুমাত্রিক বিতর্কের আলোচনা করব না। লেনিন সৃজনশীলভাবে মার্কসের পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণকে রাশিয়ার সমাজবিজ্ঞান, পুঁজিবাদের ভূ-অর্থনীতি এবং নেতৃত্ব ও কর্মের রাজনীতিতে যুক্ত করেছিলেন। লেনিন রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবকে সমাজতান্ত্রিক উদ্দেশ্যের সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে এখানে কিছু কথা বলব।
…………………………………………………………………………………………………………………………………
লেনিনের মতে, পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছিল পুঁজিবাদী বিকাশের অসম স্তরের আন্তঃসংযুক্ত রাষ্ট্র গঠন থেকে। লেনিন বিশ্বাস করতেন যে বিশ্ব পুঁজিবাদ তার সবচেয়ে দুর্বল সংযোগ স্থলে (বা লিঙ্কগুলিতে) সবচেয়ে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, তার সবচেয়ে উন্নত পর্যায়ে নয়। কিন্তু পুঁজিবাদ থেকে একটি নতুন সামাজিক পরিকাঠামো, গঠন ও গণচেতনা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠে না।
……………………………………………………………………………………………………………………………………
প্রথমত, লেনিন নিঃসন্দেহে মার্কসবাদের প্রকৃত উত্তরসূরি। কিন্তু, মার্কসের লেখার সঙ্গে লেনিনের ব্যাখ্যার একটা ধাতুগত অনৈক্য আছে। মার্কস ও এঙ্গেলস ফলিত তত্ত্বের দিশারি হলেও তাঁদের আলোচনা ছিল মূলত ধনতন্ত্রের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও সমালোচনা। তাঁরা সমাজতন্ত্রের কোনও রাজনৈতিক তত্ত্ব নির্মাণ করেননি। মার্কসের অন্যতম যুক্তি হল বাস্তবিকতা তত্ত্বের সীমানা নির্ধারিত করে দেয়, তাই এখানে অন্ধ ভবিষ্যৎ বাণী বা বৌদ্ধিক ফাটকাবাজির কোনও জায়গা নেই। যেহেতু তাঁরা বহুদিন কোনও সমাজতান্ত্রিক ও বৈপ্লবিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তাঁদের লেখায় যে বিমূর্ততা আছে, তা নজিরবিহীন। অন্যদিকে, লেনিন ছিলেন বলশেভিক আন্দোলনের প্রধান কাণ্ডারি। তাঁর রাজনৈতিক ভরকেন্দ্র ছিল সমকালীন রাশিয়া, সেদেশের রাজতন্ত্রের শোষণ ও তার বিরুদ্ধে বেড়ে ওঠা গণপ্রতিরোধের বিবর্তন। সশস্ত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পুরাধা স্বরূপ তাঁর আলোচনার কেন্দ্রে থেকেছে আন্দোলনের নানা দিক, সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার সমস্যা ও বিপদের চুলচেরা বিশ্লেষণ, এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের সারা বিশ্বব্যাপী প্রসারের প্রয়োজনীয়তার খতিয়ান।
লেনিনের নানা অবদানের অন্যতম ধনতন্ত্রের পতনের আলোচনা। মার্কস ধনতন্ত্রের সংকট মুহূর্ত নির্দেশ করেছেন উন্নত ধনতন্ত্রের অমীমাংসিত দ্বন্দ্বের শেষ মুহূর্তে। পশ্চিমি ইউরোপের পটভূমিতে তৈরি উন্নত ধনতন্ত্র ছিল মার্কসের অস্তিত্বগত অভিজ্ঞতা। এর বিপরীতে লেনিন দেখেছেন অপেক্ষাকৃত অন্নুনত আধা সামন্ততান্ত্রিক ও আধা ধনতান্ত্রিক রাশিয়াকে। মার্কস বিপ্লবের সম্ভাবনাকে দেখেছিলেন ধনতন্ত্রের অন্তিমে; লেনিন মার্কসবাদী বিশ্লেষণে একটি সিদ্ধান্তমূলক পরিবর্তন আনেন। ঐতিহ্যগত মার্কসবাদী পূর্বাভাসে, শুধুমাত্র পুঁজিবাদের সবচেয়ে উন্নত পর্যায়ে দ্বন্দ্বগুলি ধনতন্ত্রের পতন ঘটায় এবং তারপরে উৎপাদন ব্যবস্থা একটি সামাজিক পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হয়। লেনিনের মতে, পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছিল পুঁজিবাদী বিকাশের অসম স্তরের আন্তঃসংযুক্ত রাষ্ট্র গঠন থেকে। লেনিন বিশ্বাস করতেন যে বিশ্ব পুঁজিবাদ তার সবচেয়ে দুর্বল সংযোগ স্থলে (বা লিঙ্কগুলিতে) সবচেয়ে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, তার সবচেয়ে উন্নত পর্যায়ে নয়। কিন্তু পুঁজিবাদ থেকে একটি নতুন সামাজিক পরিকাঠামো, গঠন ও গণচেতনা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠে না। সমাজকে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি মার্কসবাদী রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন ছিল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। লেনিন পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকে আমাদের মনোযোগ সরিয়ে সামাজিক বা রাজনৈতিক শ্রেণি দ্বন্দ্বের দিকে নিয়ে যান। এইদিক থেকে বিচার করলে তিনি মার্কসের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের সঙ্গে একটি সমাজতাত্ত্বিক সমালোচনা যুক্ত করেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: প্রকৃতি সংরক্ষণে ভ্লাদিমির লেনিনের দূরদৃষ্টি আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক
……………………………………………………………………………………………………………………………………
মার্কস যে পদ্ধতিগত ভাবে পুঁজিবাদের পতনের ব্যাখ্যা দেন, লেনিন তাকে খণ্ডন করেননি। কিন্তু, লেনিনের সময় মার্কস বর্ণিত ধনতন্ত্রের পরিবর্তন হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপিটালিজম সরে গিয়ে অর্থ পুঁজিবাদ এসে গিয়েছে। মার্কস মনে করেছিলেন, অনুপাতহীন বিশৃঙ্খল ধনতান্ত্রিক বৃদ্ধি, পুঁজির ঘনীভবন ও মুনাফার শতাংশের হারের পতন ধনতন্ত্রকে ধংস করবে। কিন্তু, বাস্তবে তা ঘটেনি। লেনিন এর বিশ্লেষণ করেন তাঁর সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্বের মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন যে, ধনতন্ত্র অর্থনীতিকে অসম বৃদ্ধির দিকে ধাবিত করে। উন্নত পুঁজিবাদ দ্রুত বাজারকে প্লাবিত করে। বাজার পণ্যে ছেয়ে গেলে, চাহিদা কমে আসে। তাই, মুনাফা পড়তে থাকে। তখন ধনতন্ত্রের পাশে আসে রাষ্ট্র। তৈরি হয় উপনিবেশবাদ। কিন্তু, ধনতন্ত্র একটা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা। অতএব, আজকের উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশ কাল শীর্ষে থাকবে না। নতুন পুঁজিবাদী শক্তি উঠে আসবে। কিন্তু, সেই দেশও মুনাফার স্বার্থে বাজার বাড়াতে উদ্যোগী হবে। কিন্তু, অধিকাংশ উপনিবেশ পুরনো ধনতান্ত্রিক দেশের হাতে থাকলে পরে নতুন প্রতিদন্দ্বী ধনতন্ত্র ক্রমশ আগ্রাসী শক্তিতে পরিণত হয়। এর থেকে সৃষ্টি হয় যুদ্ধের। লেনিন মনে করেছিলেন এই দ্বন্দ্বের সঙ্গে জুড়বে উপনিবেশের জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা সংগ্রাম ও উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশের শ্রমিক অসন্তোষ। এইভাবে ভেঙে যাবে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা। লেনিনের এই ভবিষ্যৎ বাণী ফলেনি। কেন, সেই আলোচনা এখানে নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু, এটাই প্রথম মার্কসবাদী আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদ ও ভূরাজনীতির জটিল মেলবন্ধনের আখ্যান।
কমিউনিস্ট দল সম্বন্ধে লেনিন যা বলেছেন, তা বহু চর্চিত। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা তৎকালীন রাশিয়ার প্রেক্ষাপটে হয়তো বিপ্লবের প্রয়োজনে ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সুরক্ষার স্বার্থে অনিবার্য ছিল। কিন্তু এর থেকে যে সামগ্রিক আমলাতান্ত্রিকতার প্রবণতা ও এক অতি শক্তিশালী দলীয় রাষ্ট্র গঠনের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল, তা অস্বীকার করা মুশকিল। লেনিন দীর্ঘজীবী হলে এর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতেন কি না অনুমান করা কঠিন। কিন্তু, সমগ্র ইউরোপের সমাজতন্ত্রের দলিলের নিরিখে বিচার করলে আজ মনে হয় দলীয় কেন্দ্রিকতার ধারণাটি আখেরে লাভজনক হয়নি।
লেনিন যদিও ধনী ও মধ্যম কৃষকদেরকে শ্রেণি গোষ্ঠী হিসেবে সদর্থক ভাবে বিবেচনা করেছেন, যারা স্বৈরাচারের উৎখাত এবং বুর্জোয়াদের প্রতিষ্ঠানকে সমর্থন করেছিলেন, কিন্তু, পশ্চাদপটে মনে হয় তিনি সমষ্টিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোতে মধ্য ও দরিদ্র কৃষকদের প্রতিকূল মনোভাবকে সঠিকভাবে বিবেচনা করেননি। অক্টোবর বিপ্লব শুধুমাত্র কৃষক জমির একীকরণই করেনি, মধ্য ও দরিদ্র কৃষকের সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি করেছিল। মাঝারি কৃষকদের বেড়ির চেয়ে অনেক বেশি হারানোর ভয় ছিল। তারা অর্থনৈতিক সমন্বয় ও ভূমি সংস্কারের সমষ্টিবাদী রূপের বিরোধী ছিল। ১৯১৭-র পরে, শ্রেণিস্বার্থ ভিন্ন হয়ে যায় এবং পরে শহর ও দেশের মধ্যে প্রকাশ্য সংঘর্ষের বাতাবরণ তৈরি হয়। অন্যদিকে, চিনে সমষ্টিকরণের পদক্ষেপ অনেক কম সহিংস ছিল এবং সাধারণত বেশি সফল হয়। চিনে, ব্যাপক রক্তপাত এবং মানবজীবনের ক্ষতি ছাড়াই অনেক কম সামাজিক ব্যাঘাতের সঙ্গে যৌথকরণ করা সম্ভব হয়েছিল। মোটের ওপর লেনিন শহর কেন্দ্রিক রাজনীতি ও বিপ্লবের পথিকৃৎ ছিলেন। কিন্তু, মাওয়ের সঙ্গে তুলনা অর্থহীন। এদের পরিপ্রেক্ষিতে বিস্তর ফারাক। লেনিন কৃষকদের সমস্যাকে আরও গুরুত্ব দিলে সমাজবাদের তাত্ত্বিক দিক থেকে অনেক সুবিধে হত– এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
আমার কাছে তিনটি কারণে লেনিন চর্চার আজ প্রাসঙ্গিক। প্রথমত, লেনিন শিখিয়েছেন ধনতন্ত্রকে একটা বিশ্ব-ব্যবস্থা রূপে দেখতে হবে। উন্নত পুঁজিবাদ পিছিয়ে পড়া দেশকে নিপীড়ন ও শোষণ করে। প্রতিরোধ ধারণাগতভাবে সর্বজনীন হলেও, সমাজ পরিবর্তনের সুযোগ অনুন্নত দেশে অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, লেনিন গণতন্ত্র ও পৌর সমাজের অবদানকে পূর্ণমাত্রায় গুরুত্ব দেননি। এটা নিঃসন্দেহে তার রাষ্ট্রতত্ত্বের একটা অন্যতম সীমাবদ্ধতা। কিন্তু, আমরা যদি ইতিহাসের নিরিখে বিচার করি, এটা কি খুব অস্বাভাবিক? গ্রামসি যে পরিস্হিতি ও অভিজ্ঞতা থেকে আধিপত্যের ধারণা ব্যাখ্যা করেন, তা কখনওই লেনিনের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু তার মানে লেনিন গণতন্ত্রের শত্রু ছিলেন, এই সরলীকরণ এক্কেবারে কাম্য নয়। পরিশেষে, আজকের পৃথিবীতে প্রতিরোধ ও পরিবর্তনের ধারণা পাল্টালেও, উগ্র জাতীয়তাবাদ, দক্ষিণপন্থী জনপ্রিয়তাবাদ ও আগ্রাসী নয়া-সাম্রাজ্যবাদের বিপদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হলে লেনিনের রাজনৈতিক চিন্তাকে নতুন করে পড়া দরকার। প্রতিটি যুগ নিজের জায়গা থেকে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে। বিপ্লবের অর্থ বিবর্তিত হয়। কিন্তু, লক্ষ্য, পন্থা, সংগঠন, চেতনা, ও সত্যের সন্ধান আমাদের নিত্য পাথেয়। সুতরাং, লেনিনের জীবন ও চিন্তা থেকে অনুপ্রেরণার রসদ পাবে সমস্ত প্রজন্মের মানুষ।
ঋণ স্বীকার:
Lane, D. (2021). V.I. Lenin’s Theory of Socialist Revolution. Critical Sociology, 47(3), 455-473. https://doi.org/10.1177/0896920520958451
Anderson, Perry. Considerations on western Marxism. Verso Books, 2016.