মধুসূদন একদিন বাবা রাজনারায়ণকে বলল, ‘‘আই সাই ফর অ্যালবিয়ন’স ডিসট্যান্ট শোর’’! অ্যালবিয়ন-এর সুদূর সমুদ্রসৈকতের জন্য আমি মনকেমনের দীর্ঘশ্বাস ফেলি! সেখানেই আমার বাড়ি, আমার দেশ, আমার স্বপ্ন, সেখানে না গেলে আমি মহাকবি হতে পারব না। কিন্তু অ্যালবিয়নটা কোথায়? জানতে চান রাজনারায়ণ দত্ত। কিশোর মধুর বিস্মিত উত্তর, ইংল্যান্ডের অন্য নাম অ্যালবিয়ন, জানো না তুমি? অবাক হয়ে তাকান রাজনারায়ণ তাঁর ছেলের দিকে, ঠিক যেমন অবাক হয়ে জাতিস্মর ছোট্ট মুকুলকে দেখে তার বাবা-মা সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘সোনার কেল্লা’-য়! মুকুল কেবলই আঁকে সোনার কেল্লার ছবি।
এক যে আছে জেলা-শহর, নাম তার ‘যশোহর’, লোকে বলে যশোর। সেই জেলায় এক গ্রাম, সাগরদাঁড়ি। আর সেই গ্রামে এক নদী, কপোতাক্ষ। এক যে আছেন জমিদার, রাজনারায়ণ দত্ত, সেই নদীর ধারে তাঁর প্রাসাদের মতো বাড়িতে। আর আছেন তাঁর বউ– জাহ্নবী। রাজনারায়ণ শুধু জমিদার নন, তিনি সদর দেওয়ানি আদালতের প্রতিষ্ঠিত উকিলও বটে। ঠিক ২০০ বছর আগে, ১৮২৪-এর ২৫ জানুয়ারি, রাজনারায়ণ দত্ত এবং জাহ্নবীর পুত্র হয়ে জন্মাল শ্রী মধুসূদন। সে বড় হতে লাগল ২০০ বছরের পুরনো সেই গ্রামে। তারপর কপোতাক্ষর জলে শিখল সাঁতার। গ্রামের গাছের ছায়ায় বসে মা জাহ্নবীর কাছে সে শুনল রামায়ণ-মহাভারতের গল্প। আর গ্রামের যাত্রাগান, বাউলগান, দেবদেবীর গান শুনে সে শিখল গান।
মধুসূদনের যখন আট বছর বয়স বাবা রাজনারায়ণ-মা জাহ্নবীর সঙ্গে সে চলে এল কলকাতায়। রাজনারায়ণ বাড়ি কিনলেন খিদিরপুরে। আর ছেলেকে ভর্তি করলেন খিদিরপুরের স্কুলে। কলকাতাতেও জমে উঠল তাঁর ওকালতি। দু’-বছর পরেই, অর্থাৎ মধু ন’য়ে পড়তে না পড়তেই, সে হিন্দু স্কুলের জুনিয়ার বিভাগের ছাত্র! আর তার মাস্টারমশাইরা প্রত্যেকেই দেশি বা বিলিতি সাহেব! কিছুদিনের মধ্যেই মধু হিন্দু কলেজের ছাত্র। সে ইংরেজিতে কবিতা লিখছে। তার লেখা ইংরেজি কবিতা ও প্রবন্ধ ছাপা হচ্ছে কলকাতার সব বিখ্যাত পত্রিকায়: লিটেরারি গ্লিমার, কমেট, ব্লসম, ক্যালকাটা লিটেরারি গেজেট! ইংরেজিতে নারী-শিক্ষা নিয়ে প্রবন্ধ লিখল মধু! কে বলবে বাঙালির লেখা ইংরেজি!
সাহেব শিক্ষকরা বললেন, মধু তো আকস্মিক জ্যোতিষ্ক। কাদের মধ্যে মধু নতুন নক্ষত্র? তারা প্রত্যেকে ব্রিলিয়ান্ট– যারা মধুর সহপাঠী। কিন্তু মধুর ধারে-কাছে কেউ নেই– শিক্ষকরা একমত। সহপাঠীদের মধ্যে উজ্জ্বলতমরা হল রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক, ভূদেব মুখোপাধ্যায়। মধুর পাশে তারাও ম্লান। এহেন মধু একদিন বাবা রাজনারায়ণকে বলল, ‘‘আই সাই ফর অ্যালবিয়ন’স ডিসট্যান্ট শোর’’! অ্যালবিয়ন-এর সুদূর সমুদ্রসৈকতের জন্য আমি মনকেমনের দীর্ঘশ্বাস ফেলি! সেখানেই আমার বাড়ি, আমার দেশ, আমার স্বপ্ন, সেখানে না গেলে আমি মহাকবি হতে পারব না। কিন্তু অ্যালবিয়নটা কোথায়? জানতে চান রাজনারায়ণ দত্ত। কিশোর মধুর বিস্মিত উত্তর, ইংল্যান্ডের অন্য নাম অ্যালবিয়ন, জানো না তুমি? অবাক হয়ে তাকান রাজনারায়ণ তাঁর ছেলের দিকে, ঠিক যেমন অবাক হয়ে জাতিস্মর ছোট্ট মুকুলকে দেখে তার বাবা-মা সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘সোনার কেল্লা’-য়! মুকুল কেবলই আঁকে সোনার কেল্লার ছবি। রাজস্থানের কোথায় আছে এই সোনার কেল্লা, যেখানে মুকুল যায়নি কোনও দিন! তবু সোনার কেল্লার জন্যই মনকেমন তার। সেখানেই বাড়ি ফিরতে চায় সে! সেটাই তার আসল ঠিকানা। তারই ডাক এসে পৌঁছয় মুকুলের কাছে অচেনা অজানা অস্পষ্ট সুদূর থেকে!
বালক রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির পিছনে বাগানের মধ্যে এক যে আছে পালকি। আর ছোট্ট রবি সেই পালকিতে একা বসে থাকে দুপুরবেলা। আর পালকি তাকে নিয়ে চলে কত না মাঠ-ঘাট গ্রাম-নগর পেরিয়ে তেপান্তরের ধারে। এইসব রবির মনকেমনের দেশ। আজীবন রবীন্দ্রনাথকে ডেকেছে তার স্বপ্নের পরীর দেশ, আজীবন তিনি বাড়ি ফিরতে চেয়েছেন ভূগোলের বাইরে রূপকথার তেপান্তরে। মৃত্যুর এক বছর আগেও বাড়ি ফেরার তৃষ্ণা এবং আকুতি তাঁকে ছেড়ে যায়নি। ১৯৪০-এর ১০ জানুয়ারি তিনি লিখলেন তাঁর সেই বিখ্যাত গান: ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে।’ বালক বয়সে রবীন্দ্রনাথের মনকেমন তেপান্তরের জন্য। আর ৭৯ বছরের রবীন্দ্রনাথ ‘তেপান্তরের পাথারে যান পথ ভুলে–’ একথা তিনি জানিয়েছেন তাঁর গানেই, যে-গানের শেষে সত্যিই তিনি পৌঁছে যান পরীর দেশে? কিন্তু তারপর? ‘পরীর দেশে বন্ধ দুয়ার দিই হানা।’ খোলে কি কোনও দিন সেই দরজা? পারি কি আমরা সত্যিই পৌঁছতে সেই জায়গায়, সেই ঠিকানায়, যার জন্যে আমাদের আজীবন মনকেমন?
কেন আমাদের এই ফেরার বাসনা? কেন আমরা পিছন ফিরে তাকাই বারবার? কাকে ফেলে এলাম যে তারই কাছে ফিরতে হবে? ফিরতে যদি বা ইচ্ছেও করে, এবং ধেয়ে আসে ‘নস্ট্যালজিয়া’, যে-শব্দটির আক্ষরিক অর্থ বাড়ি-ফেরার বাসনা– কার কাছে ফিরব? কোন ঠিকানায় ফিরব? কাকে ফেলে এসেছি পিছনে, যে সারাজীবন কষ্ট পেতে হচ্ছে মনকেমনে?
৫৩ বছরের রবীন্দ্রনাথ ফাল্গুনের বিকেলে তাঁর একটি গভীর মনকেমনের গানে তুললেন এই প্রবুদ্ধ প্রশ্ন: ‘কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে?’ নস্ট্যালজিয়ার গভীর পাতাল-স্তর থেকে উঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথের এই গান: ‘তুই ফেলে এসেছিস, কারে, মন, মনরে আমার, তাই জনম গেল শান্তি পেলি না রে, মন, মন রে আমার।’
উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস শান্তি পাননি সারাজীবন, তাঁর মনকেমনের ঠিকানা, তাঁর নস্ট্যালজিয়ার ‘ইনিস্ফ্রি’ খুঁজে পাননি বলে। এবং এই খুঁজে না পাওয়ার বেদনা এবং সন্ধানের তাড়না থেকে পাগল-পারা ইয়েটস এইমাত্র বেঁচে গেলেন লন্ডনের রাস্তায় গাড়িচাপা পড়তে-পড়তে!
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
যে মানুষ জীবনের সব কিছু হারাতে-হারাতে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ, কথাও বলতে হয় বেশিরভাগ সময়ে নিজের সঙ্গে, সেই মানুষটির কি মনে পড়তেই পারে না রাত যত বাড়ে নিজের সন্তানের মুখ, যে-সন্তানের সঙ্গে তার শেষ দেখা তার এগারো বছর বয়সে, যে-সন্তানকে সে আর চিনতে পারবে না বইমেলায় দেখা হলে, কিন্তু যার কাছে সে ফিরতে চায় এখন! কিন্তু কী আশ্চর্য! আমরা ভুলে যাই অন্য এক স্রোতের কথা, যাকে দেখা যায় না, যার কোনও শব্দ নেই, যার গতিপথ আটকানো যায় না কোনওভাবে– যার নাম সময়।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ইয়েটস রাস্তা পেরচ্ছেন এই ভাবনায় আচ্ছন্ন ও অমনস্ক হয়ে– আজও দোকানটার শোকেসে ওই ঝরনাটাকে দেখতে পাব তো? শুনতে পাব তো তার শব্দ? যে-শব্দ আমাকে ডাকে স্বপ্নের রাজ্য ইনিস্ফ্রি-র পানে? যে শব্দ শুনে ইয়েটস লিখেছেন তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার একটি। যে কবিতায় তিনি বলছেন, তাঁকে যেতেই হবে সেই দেশে যেখানে ঊষার ঘোমটা থেকে ধীরে খসে পড়ে শান্তি, যেখানে ভোরের ঝিঁঝিঁরা এখনও ডাকছে: হোয়্যার পিস্ কামস্ ড্রপিং স্লো, ড্রপিং ফ্রম দ্য ভেল্ অফ দ্য মর্নিং টু হোয়্যার দ্য ক্রিকেট সিংগ্স!
‘এক কাজ করো তুমি। তুমি বিক্রি করে দাও তোমার মনকেমন, তোমার সমস্ত নস্ট্যালজিয়া, তোমার সব অতীত। আমাদের কাছে। আমরা ভাল দাম দেব, বেশ ভাল দাম দিয়েই কিনব আমরা তোমার এই অতীত বিলাস!’
–অতীত আবার বিক্রি করা যায় না কি? কীভাবে বিক্রি?
–বিনিময় প্রথা। তুমি যদি তোমার অতীতের সর্বস্ব দান কর, আমরা তোমাকে দারুণ একটা ভবিষ্যৎ দেব, যেখানে কোনও মনকেমন, কোনও নস্ট্যালজিয়া থাকবে না!
–আমার প্রেম, ভালোবাসা, প্রেমের চিঠি, অতীতের কান্না, দুঃখ, হতাশা সব দিয়ে দিতে হবে?
–ওসব বোঝা নিয়ে কী করবে? হালকা হও।
না, প্রাগ অধিকার করা কমিউনিস্টদের কাছে তাঁর অতীত বিক্রি করেননি মিলান কুন্দেরা। পরিবর্তে চেক ভাষা থেকে ফরাসি ভাষায়, প্রাগ থেকে প্যারিসে বেছে নিয়েছেন নির্বাসন! তিনি তাঁর নিজের ভাষায় আর লিখলেন না। লিখলেন ফরাসি ভাষায়। আর তার প্রায় সব লেখাই ঘরে ফেরার ইচ্ছে, নস্ট্যালজিয়া, এবং নিজের ঠিকানা খুঁজে না পাওয়ার বেদনা থেকে। তিনি পাতার পর পাতা লিখেছেন যে বিষয়টি নিয়ে বারবার, তা হল হারানো চিঠি। হারানো মুখ। হারানো ভালোবাসা। এবং হারানো বাসা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলেছেন, ‘আমার কোনও বাড়ি নেই। কোনও ঠিকানাতেই আমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ হয়তো নস্ট্যালজিয়াই মিলান কুন্দরার একমাত্র এবং শেষ ঠিকানা।
প্রান্ত জীবনে এসে আমার একটি কথা বারবার মনে হয়, গম্বুজ ছাড়া যেমন গির্জা বা মসজিদ হয় না, গর্ভগৃহ ছাড়া যেমন মন্দির হয় না, তেমনই ফেরার বাসনা ছাড়া জীবন হয় না। কিন্তু প্রশ্ন হল, ফিরব কোথায়? ফিরব কী করে, কোন পথে? ‘যে পথ দিয়ে চলে এলি সে পথ এখন ভুলে গেলি’– এই বিহ্বলতা ও বিস্ময় শুধু কি রবীন্দ্রনাথের? আমাদের নয়? ফেরার টান আমরা কে না অনুভব করি, বিশেষ করে যত শেষের দিকে চলে আসে আমাদের জীবন? যত দীর্ঘ হয় অতীত আর যত বিন্দুসম হয় ভবিষ্যৎ, ততই যেন বাড়ে অতীতের টান!
যে মানুষ জীবনের সব কিছু হারাতে-হারাতে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ, কথাও বলতে হয় বেশিরভাগ সময়ে নিজের সঙ্গে, সেই মানুষটির কি মনে পড়তেই পারে না রাত যত বাড়ে নিজের সন্তানের মুখ, যে-সন্তানের সঙ্গে তার শেষ দেখা তার এগারো বছর বয়সে, যে-সন্তানকে সে আর চিনতে পারবে না বইমেলায় দেখা হলে, কিন্তু যার কাছে সে ফিরতে চায় এখন! কিন্তু কী আশ্চর্য! আমরা ভুলে যাই অন্য এক স্রোতের কথা, যাকে দেখা যায় না, যার কোনও শব্দ নেই, যার গতিপথ আটকানো যায় না কোনওভাবে– যার নাম সময়। সময়ই তৈরি করে নস্ট্যালজিয়া, মনকেমন, ফিরে যাওয়ার তাগিদ, তাড়না, ব্যাকুলতা। কিছু সময়েই ফেরার পথে সব থেকে বড় বাধা। আমরা যা কিছু ছেড়ে এসেছি এবং যা কিছুর কাছে ফিরতে চাই– সময় সব বদলে দিয়েছে। সময়ের সেতু পেরিয়ে ফেরা অসম্ভব। কারণ ‘আমি’ আর সেই ‘আমি’ নেই। আর অতীতের সব কিছু, যা কিছু বর্তমান হয়ে জ্বলজ্বলে জ্যান্ত হয়ে আছে মনকেমনে, সব আলোকবর্ষ দূরের মরা নক্ষত্রের আলো। নেই। তবু আছে! অলীক। তবু দৃশ্যমান। কিন্তু আমাদের নস্ট্যালজিয়ার ওম্, আমাদের ফেলে-আসা ঠিকানায় ফেরার উষ্ণ ইচ্ছে যেন না জুড়িয়ে যায় অন্তরে। ফেরার ইচ্ছেই আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। সত্যি বলতে, যত বয়স বাড়ছে অনুভব করছি, ফেরার ইচ্ছেটাই ফায়ারপ্লেস। ওই আগুন ও তাপই বাঁচিয়ে রেখেছে বেঁচে থাকার বেদনাময় মাধুর্য।