ছোটবড় নানা বয়সি শিল্পীদের জমজমাট আসর, ‘মমার্ত’-এর শিল্পের আখড়া। যেখানে হাসি-গল্প-আড্ডায় উপচে ওঠা ফোয়ারার সঙ্গে তুলির টান আর ধূমায়িত পেয়ালা জমে ওঠে উল্লসিত সৌরভে। কত নামীদামি শিল্পীদের দেখেছি ক্যানভাসের আঁচড়ে মাতোয়ারা হয়ে উঠতে। কবজির জোরে, রেখার ক্ষিপ্রতায় সেইসব বইমেলা কাঁপানো শিল্পীদের আজ তেমন চোখে পড়ে কই? প্রকাশ কর্মকার, পরিতোষ সেন, সুনীল দাস অথবা শানু লাহিড়ীর মতো ডাকসাইটে শিল্পীদের মতো হইহই রইরই উচ্ছ্বাস আজ কোথায়? ছাত্রবয়সে এইসব শিল্পীর দিকে বিস্মিত চেয়ে থেকেছি, কখনও চুপিসারে ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়েছি একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে। আবার এই স্রোতের বাইরেও একাকী চিত্রীকে দেখেছি, আপনমনে ছবি আঁকতে।
সময়ের সঙ্গে স্মৃতির ঝোলা ক্রমশ বোঝাই হতে থাকে। সেইসব স্মৃতি একত্রে জুড়ে আমাদের মতো সাধারণের জীবনেও কী যে বিচিত্র কোলাজ গড়ে ওঠে, বলে শেষ করা যাবে না। কখনও মনে হয়, স্মৃতির এই চালচিত্র বুঝি একখান আড়ে-লাটাই পটের মতো। যার দু’দিকে ছড়ানো চেনা আর অচেনা সময়ের জলছবি। এর মাঝখানটুকু যদি বর্তমান, তবে বাঁয়ে রইল ফেলে আসা দিনের স্মৃতি, আর ডান দিকের শুভ্র এলাকা পড়ে রইল জীবনপটুয়ার আগামী আঁচড়ের অপেক্ষায়। ভবিষ্যতে কী আঁকা হবে সেখানে, কেউ জানে না! ভেবে দেখলে, বেদনার স্মৃতি– যতই সে গভীরে ছাপ ফেলুক, মোটা তুলিতে যতই লেপে দিক কালো রেখার পোঁচ– আনন্দের স্মৃতি তবু তাকে ছাপিয়ে যায়। তার দুঃখের রং ফিকে হয়ে আসে সময়ের সঙ্গে। কিন্তু লেখার গোড়াতে এমন গুরুগম্ভীর কথায় মনের ভার বাড়িয়ে তোলা কেন? একটু খুশির কথায় আসি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মৃদুল দাশগুপ্তর বইমেলাধুলো: জোড়হস্তে কফি হাউসের টেবিলে টেবিলে বইমেলায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন গিল্ডকর্তারা
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আনন্দের উৎসব মানে আমাদের মনে খুশির ঝলমলে হাট। আবার তেমন জমকালো উৎসব নয়, প্রতিদিনের এমন আটপৌরে স্মৃতিও আনন্দে ভরে দেয়। নিত্যদিনের কথা রেখে বলি, পালাপার্বণের মতোই এই বইমেলার স্মৃতি, তাকে কোনওমতে আর আটপৌরে বলতে পারি না। ভাবনা আর সাজসজ্জার নিরিখে সে মহা-উৎসব। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের শেষে চোদ্দো নম্বর জায়গাটা আজ তার জন্য পাকা। ফি মরশুমেই বইমেলা কেমন যেন রূপকথার পাখায় ভর করে আসে। কয়েকটা দিন কেবল নেশাগ্রস্তের মতো ঘুরে বেড়ানো। এ দোকান থেকে সে দোকান, সেখান থেকে আরেকটা। সবসময় যে প্রচুর কেনাকাটি চলে তা নয়– কেমন ঘোরের মধ্য দিয়ে চলা। দোকানের দেয়ালজুড়ে সাজানো থরে থরে বই, অদম্য অবসেশনে সেদিকে চেয়ে থাকা। হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখা, আশপাশের কেউ তাকাচ্ছে কি না, দেখে নিয়ে একফাঁকে নতুন বইয়ের গন্ধ নেওয়া– এর একটা আলাদা মোহ, অন্য নেশা। তাছাড়াও না কিনে একঝলক দেখে নেওয়ার সুযোগটাই বা কম কীসে? শিরোনাম আঁকা মলাট থেকে স্পাইন গড়িয়ে ব্যাক-কভারের লেখায় তাকে জেনে নেওয়া, চটজলদি বইয়ের অন্দরমহলের একটা আন্দাজ পাওয়ার চেষ্টা– কে না করে থাকে! কেবল টেক্সট শুধু নয়, প্রচ্ছদপটে ছবির ব্যঞ্জনা, শিরোনাম লেখায় অক্ষরলিপির গড়ন, ভিতরের সজ্জা বা আঁকিবুঁকি মিলিয়ে তাকে আভিজাত্যের কোন কোঠায় ফেলা হবে– মনের মধ্যে সে গবেষণাও চলে বইকি। কোনও জরুরি বই, ডায়েরির পাতার দীর্ঘ তালিকার ওপরে যাদের অবস্থান– দীর্ঘদিন যাদের জন্য অনুসন্ধান জারি আছে, খ্যাপার মতো সে অমূল্যরতন বইমেলায় আকুল হয়ে খুঁজে বেড়ানো অনেক পাগল পাঠকের বিশেষ কাজ। মেলার সময় যত এগিয়ে আসে, ততই বেড়ে চলে মনের ছটফটানি। শীতের হাওয়ায় নাচন লাগার মতোই বইমেলার জন্য বসে থাকা উদগ্র অপেক্ষায়, অমোঘ টানে।
পিছনে তাকিয়ে মনে করতে পারি না বইমেলার মাঠে কবে প্রথম গিয়েছিলাম। কোন সাল হবে কে জানে? সাতের দশকের শেষে নাকি আটের দশকের গোড়ায়, সে আজ আর মনে পড়ে না। তবে রবীন্দ্রসদনের বিপরীতে, একাডেমির উলটোদিকের মাঠে বইমেলার সেই দিনগুলো স্পষ্ট হয়ে আছে। এখনও ভিড়ের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে মনে হয়, এই মেলা প্রকৃতপক্ষে কাদের জন্য সেজে ওঠে? সে কি শুধু লেখক, প্রকাশক আর পাঠকের জন্য? না, তা তো নয়। দলে দলে কত মানুষ যে এখানে ভিড় জমান, তার অন্ত নেই। কেবল বইয়ের পশরা নয়, সেই সঙ্গে আরও অজস্র জিনিস। বিপণন, বিনোদন আর প্রয়োজন এখানে মিলেমিশে একাকার। কোথাও বসেছে গানের দল, কেউ-বা ছড়িয়ে দিয়েছে পটচিত্রের সম্ভার। কাছেই হয়তো বিশাল ছাতার নীচে চা-কফির জমায়েত। আবার সারি সারি দোকানের মাঝে চাঁদোয়ার তলায় বড় একটা জায়গা জুড়ে আর্টিস্টদের আড্ডা। ছোটবড় নানা বয়সি শিল্পীদের জমজমাট আসর, ‘মমার্ত’-এর শিল্পের আখড়া। যেখানে হাসি-গল্প-আড্ডায় উপচে ওঠা ফোয়ারার সঙ্গে তুলির টান আর ধূমায়িত পেয়ালা জমে ওঠে উল্লসিত সৌরভে। কত নামীদামি শিল্পীদের দেখেছি ক্যানভাসের আঁচড়ে মাতোয়ারা হয়ে উঠতে। কবজির জোরে, রেখার ক্ষিপ্রতায় সেইসব বইমেলা কাঁপানো শিল্পীদের আজ তেমন চোখে পড়ে কই? প্রকাশ কর্মকার, পরিতোষ সেন, সুনীল দাস অথবা শানু লাহিড়ীর মতো ডাকসাইটে শিল্পীদের হইহই রইরই উচ্ছ্বাস আজ কোথায়? ছাত্রবয়সে এইসব শিল্পীর দিকে বিস্মিত চেয়ে থেকেছি, কখনও চুপিসারে ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়েছি একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে। আবার এই স্রোতের বাইরেও একাকী চিত্রীকে দেখেছি, আপনমনে ছবি আঁকতে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পবিত্র সরকারের বইমেলাধুলো: বইমেলার গেটে কবি অরুণ মিত্রকে স্যালিউট করেছিল পুলিশ
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সেবারে দেখেছিলাম, ছোট একটা স্টলে চটের ওপর বসে মন দিয়ে কার্ড এঁকে চলেছেন একমাথা ঝাঁকড়া চুলের পূর্ণেন্দু পত্রী। তখন বোধহয় সদ্য আনন্দবাজারের শিল্প বিভাগের দায়িত্ব থেকে সরে তিনি এসেছেন। স্টলে সাজানো ওঁরই কিছু বইপত্র, ধারেপাশে তেমন ভিড় নেই। আমি এগিয়ে এসে ওঁর আঁকা একটা কার্ড কিনলাম। সাদাকালোর জোরালো ক্যালিগ্রাফিতে আঁকা পলাশ গাছের ছবি, ঘন চাইনিজ ইঙ্কে মোটা আঁচড়ের টান। ছবি শেষ হতে খস খস করে নাম সই করে দিলেন– আমি তো মুগ্ধ একেবারে! ওঁর আঁকা প্রচ্ছদ, বিশেষ করে কবিতার বইয়ের কভার বা ক্যালিগ্রাফির অন্ধ ভক্ত আমি। বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ নির্মাণে পূর্ণেন্দু পত্রী এক বিশেষ নাম। বাংলা ক্যালিগ্রাফির ক্ষেত্রে বিনোদবিহারী থেকে সত্যজিৎ ঘরানার সার্থক উত্তরসূরি। তাঁর কাজের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। মনে আছে, আরেকবার অটোগ্রাফ নিতে গেলে উনি আমার খাতায় লিখে দিয়েছিলেন ছোট্ট একটি বাক্য। আজীবন স্মরণে রাখার মতো কথা– ‘সুখী ও সার্থক হও’। তবে রূপকথার মতো অলীক যেন এই শব্দবন্ধ। সত্যিকার সুখী হতে এ পর্যন্ত কেউ পেরেছে কি না, জানি না। আর সার্থক হয়ে ওঠা যে কত কঠিন, তা এই বিকেলবেলার রোদ্দুর আমার কানে কানে জানান দিয়ে যাচ্ছে। সুখ এবং সার্থক হয়ে ওঠার অলীক আশীর্বাদের মতোই সেই অটোগ্রাফের খাতাখানা খোয়া গিয়েছে। পলাশ গাছের ছবি আঁকা সেদিনের কার্ড আমার সংগ্রহে আজও সযত্নে রক্ষিত।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তখন বোধহয় সদ্য আনন্দবাজারের শিল্প বিভাগের দায়িত্ব থেকে সরে তিনি এসেছেন। স্টলে সাজানো ওঁরই কিছু বইপত্র, ধারেপাশে তেমন ভিড় নেই। আমি এগিয়ে এসে ওঁর আঁকা একটা কার্ড কিনলাম। সাদাকালোর জোরালো ক্যালিগ্রাফিতে আঁকা পলাশ গাছের ছবি, ঘন চাইনিজ ইঙ্কে মোটা আঁচড়ের টান। ছবি শেষ হতে খস খস করে নাম সই করে দিলেন– আমি তো মুগ্ধ একেবারে! ওঁর আঁকা প্রচ্ছদ, বিশেষ করে কবিতার বইয়ের কভার বা ক্যালিগ্রাফির অন্ধ ভক্ত আমি।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মনে পড়ে, ‘মহানগর’ শিরোনামে সমরেশ বসু সেই পর্বে নতুন পত্রিকা প্রকাশ করছেন। আচমকা তাকিয়ে দেখি, শুভ্র ধুতি-পাঞ্জাবিতে একটি স্টলে উপবিষ্ট স্বয়ং সম্পাদক। আগে সামনে থেকে দেখিনি তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। ওঁর ছোট মেয়ে মৌসুমী বসু তখন ছাপাই ছবি নিয়ে কলাভবনে পড়ে, আমাদের চেয়ে কিছু সিনিয়র। ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই দেখেছি মৌসুমীদির হাতে অটোগ্রাফের খাতা ধরিয়ে দিতে, বাবার সই সংগ্রহের জন্য। আমার আর নেওয়া হয়নি। ‘দেখি নাই ফিরে’ প্রকাশের সময়ে ওঁকে অনেকবার কলাভবনে আসতে দেখেছি, কিন্তু প্রথম দর্শন সেই বইমেলায়। সকলের মতো তখন আমারও শখ বইতে অটোগ্রাফ নেওয়ার। মনে আছে, বইমেলায় আনন্দের স্টল থেকে পরিতোষ সেনের ‘আমসুন্দরী ও অন্যান্য রচনা’ কিনে পরে তাতে সই করিয়েছিলাম। একইভাবে বিশ্বভারতীর স্টল থেকে ‘শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ’ নিয়ে একদিন ছুটির সকালে স্কেচ করতে গিয়ে শ্যামবাটীতে রানী চন্দের বাড়ি গিয়ে হাজির। স্কেচখাতার সঙ্গে কাঁধ-ঝোলায় তাঁর বই, শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ। উনি সই করে দিয়ে বললেন, পিছনের দিকে বাগানে গিয়ে পেয়ারা নিতে। তখন আনন্দ রাখি কোথায়! তবে লীলা মজুমদারের অটোগ্রাফ দেওয়ার গল্পটা আরেকরকম। সেবারে বইমেলায় মায়ের জন্য একটা বই কিনব বলে আনন্দের স্টলে ঢুকেছি। প্রচণ্ড ভিড়, কী নেবো মনস্থির করতে পারছি না। অবশেষে হঠাৎ লীলাদির লেখা ‘রান্নার বই’টা চোখে পড়ল। সেটা নিয়েই আপাতত শান্তিনিকেতনে ফিরেছি, ক’দিন পরে বাড়ি গিয়ে মাকে দেব। তার আগে একদিন লীলাদির বাড়িতে হাজির, মায়ের জন্য কেনা বইতে আপনার সই চাই। উনি ভেতর থেকে একখানা কলম নিয়ে এসে হাসিমুখে বইয়ের পাতায় খস খস করে লিখে বললেন– ‘এই নাও, তোমার মাকে দিও’। পাতা উলটে দেখি উনি লিখেছেন– “সুখ হ’ক, শান্তি হ’ক। ভালো করে রাঁধলেই সব হবে”। সংসারে সুখ আর শান্তির কী আশ্চর্য মন্ত্র সে। আজ মনে হয়, বাজারছাওয়া ‘সুইগি’ ‘জোম্যাটো’র প্রবল দাপটে এই কি সুখীসংসারের গোড়ার কথা বা গোপন কথা নয়?
আমার মা চলে গেছেন অনেক দিন, বইটা এখন আমার জিম্মায়। তার মলাট বিবর্ণ হয়ে এসেছে, স্পাইনে খুলে এসেছে সেলাইয়ের সুতো। কিন্তু পাতা ওলটালেই ঝলমল করে ওঠে নীল কালিতে লেখা লীলাদির সেই অক্ষরগুলো।