জেব্রা ক্রসিং দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মনে হত, আমি দুর্ঘটনার বাইরে, একটা পরিসরে ঢুকে পড়েছি। এখানে চালককে নির্দেশ দেওয়া আছে, ওটা পথচারীর নিজস্ব পরিসর, এই রাস্তার ওপর বেছানো সাদা মোটা মোটা শোয়ানো রেখা, আমাকে বেঁধে ফেলল। এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত। প্রচ্ছদ: হিরণ মিত্র
অসম্ভব সুন্দর একটি প্রাণী। যার সমান্তরাল রেখারা কথা বলে। নানা ধাঁধা সৃষ্টি করে। বিখ্যাত তথ্যচিত্র নির্মাতা, বার্ট হ্যান্সট্রা-র একটা এমন চিত্র ছিল, নাম ‘জু’। ক্যামেরা রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, সামনে এক সুবেশা মহিলা হেলে-দুলে হেঁটে চলেছেন। অনেকটা ক্যাটওয়াকের মতো। ক্যামেরা তাকে তাক করল। আরও এগিয়ে গেল, ধরল তার পোশাক। তার ব্যাগ, সব জায়গায় কালো ডোরা-কাটা আঁক। স্ট্রাইপ। ক্যামেরা এবার পিছিয়ে এল। দেখা গেল একপাল জেব্রা হেঁটে যাচ্ছে। কখন স্ট্রাইপে স্ট্রাইপে মিশে গেছে, আমরা বুঝতে পারিনি। এখান থেকে সার্কাসে ঢুকে গেলে, দেখা গেল, জলজ্যান্ত গাধা, গোটা গায়ে সাদা রং মেখে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে, একজন শিল্পী, কালো কালি নিয়ে তার গায়ে কালো রেখা এঁকে, গাধাকে জেব্রা বানাচ্ছে। জেব্রা খুবই মহার্ঘ জন্তু। অনেক বিধিনিষেধ তাকে নিয়ে, তাই গাধা হয়ে গেল জেব্রা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………
একসময় কলকাতায় ঘোড়ার বদলে গাড়ি টানত জেব্রা, সে ছবি আমরা দেখেছি। বেশ অদ্ভুত লাগত দেখতে। জেব্রারা হয়তো অত ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন নয়। নম্র স্বভাবের। শরীরে ভারী। পরে তাদের চিড়িয়াখানায় স্থান হয়। একসময় বাড়িতে জেব্রা পোষাও হত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………
জেব্রার স্ট্রাইপ এত জনপ্রিয়। এত চোখে পড়ার মতো। রাস্তা পার হতে, পথচারীর জন্য চিহ্নিত হল, কালো রাস্তায় সাদা স্ট্রাইপ। নাম হল: জেব্রা ক্রসিং।
নিরীহ জেব্রা তার প্রভাব বাড়িয়েই চলল। বাংলাদেশে এক ধরনের দর্শক আমার একটা বিচিত্র নাম দিয়েছে। ‘ফিতা ফিতা আর্টিস্ট’। সেই স্ট্রাইপ আমার কাজে, ছবিতে, কখনও প্রচ্ছদে, এই ফিতা বা স্ট্রাইপের দেখা মেলে। হয়তো একটু বেশি মাত্রায়। তাই ফিতা, ফিতা। ড্যানিয়েল বুরেন বলে এক ফরাসি শিল্পী আছেন, তিনি সারা প্যারিস শহর, একদিন সবুজ ফিতায় ভরে দিলেন। তিন ইঞ্চি চওড়া, তার মধ্যে তিন ইঞ্চি ফাঁকে সাদা-সবুজ-এর সমারোহ। একটা ধাঁধা তৈরি হয়। পরের দিকে বুরেন অনেকরকম রং আনলেন কাজে। সত্যি কথা বললে এই হচ্ছে জাত ফিতা, ফিতা আর্টিস্ট। ফিতা এঁকে গেলেন, রং ধীরে ধীরে পাল্টালো। মাপ একই।
একসময় কলকাতায় ঘোড়ার বদলে গাড়ি টানত জেব্রা, সে ছবি আমরা দেখেছি। বেশ অদ্ভুত লাগত দেখতে। জেব্রারা হয়তো অত ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন নয়। নম্র স্বভাবের। শরীরে ভারী। পরে তাদের চিড়িয়াখানায় স্থান হয়। একসময় বাড়িতে জেব্রা পোষাও হত।
এই ৩১ জানুয়ারি বিশ্ব জেব্রা দিবস। কেন কে জানে! তার মানে জেব্রা ‘জাতে’ উঠে গেল।
পশু, জেব্রার ঘোরাফেরা থেকে যদি মাঠের অন্য প্রান্তে চলে যাই, যেখানে ছায়াগুলো, গরাদের মতো, ছায়া ফেলেছে, যদি সেই গরাদে, স্ব-ইচ্ছায় ঢুকে পড়ি, নিজেকে বন্দি করি ছায়ায়, আমার শরীর জুড়ে গরাদের ছায়া, যেন নিজেই জেব্রা বনে গেছি। আশ্চর্য।
………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: আত্মীয়-অনাত্মীয়র অবিছিন্ন ছিছিক্কারেও শরৎচন্দ্রর সাহিত্য তিলমাত্র নিষ্ঠুর হয়ে পড়েনি
………………………………………………………………………………………………………………………………………
বেরিয়ে এসে ক্যানভাসে ঢুকে পড়ি, রং-তুলি হাতে নিয়ে। এখনও জেব্রা-রোগ যায়নি।
সাধে কি আর ‘ফিতা ফিতা’ আর্টিস্ট নাম হয়েছে। কাজগুলো তেমনই। আসলে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মনে হত, আমি দুর্ঘটনার বাইরে, একটা পরিসরে ঢুকে পড়েছি। এখানে চালককে নির্দেশ দেওয়া আছে, ওটা পথচারীর নিজস্ব পরিসর, এই রাস্তার ওপর বেছানো সাদা মোটা মোটা শোয়ানো রেখা, আমাকে বেঁধে ফেলল। এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত। রেখা বেছানো, গালিচার মতো, আমি ধীরে-সুস্থে পার হই। রাস্তাটা দেখি ক্রমশই চওড়া হয়ে যাচ্ছে, যতই এগোই, রাস্তাও ততই এগয়। রেখাগুলো শেষ হচ্ছে না। এক একটা রেখা, লাফ দিয়ে দিয়ে ডিঙোতে থাকি। দেখছি একটা রেখা থেকে আরেকটা সরে সরে যাচ্ছে– তারপর দেখি রেখাগুলো, ভাসছে, যেন এক একটা ভাসমান পাটাতন। জলের তোড় বাড়ছে। আমি শঙ্কিত হয়ে উঠছি। আস্তে আস্তে এটা বোঝা যাচ্ছে। রাস্তা, জেব্রা ক্রসিং, কালো-সাদার খেলা, সব পরিবর্তিত হয়ে জলাভূমির চেহারা নিয়েছে। এরপর আর কিছু মনে নেই।
এই সহস্রাব্দীতে বিশ্বের যে তিনটি বড় সংঘর্ষ, ইরাক, ইউক্রেন এবং ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন, সবক’টাই কূটনৈতিক এবং শান্তিপূর্ণভাবে মিটিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু ‘নিয়ন্ত্রিত’ভাবে যুদ্ধ জিইয়ে রাখা হয়েছে। আর তার জন্য বিশ্বজুড়ে নির্মিত হয়েছে বিপুলায়তন স্যাটেলাইট-টিভি নামক এক অ্যাম্ফিথিয়েটার।