প্রতিবন্ধকতা শারীরিক হোক কিংবা মানসিক, তা মানুষের সামনে সবসময় কঠিন চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। জীবনের মঞ্চে কেউ কেউ সেই লড়াই জিতে নায়কের মর্যাদা পান। কেউ আবার দৈনন্দিন রোজনামচায় ‘সাধারণে’র লড়াই লড়ে যান। আর চান, সম্মান, সম-অধিকারের মর্যাদা। পান কি? অধিকাংশ ক্ষেত্রে পান না। আসলে দিব্যাঙ্গরা যে করুণার পাত্র নন, সেই সহজ সত্যটা আমরা মেনে নিতে পারি না। প্রকৃত ‘প্রতিবন্ধী’ কারা, তা ভাবার বিষয়।
যে কোনও প্রতিবন্ধকতাই– তা সে শারীরিক হোক বা মানসিক, মানুষের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ খাড়া করে।জীবনের মঞ্চে যাঁরা সেই লড়াই জিতে দেখান, তাঁরা পান নায়কের মর্যাদা। তাদের নিয়ে খবর হয়, ছবি বের হয় সংবাদমাধ্যমে। সাফল্যের স্বাদ হয়তো তাঁদের কষ্টকর জীবন-যন্ত্রণা কিছুটা লাঘব করে। পথ চলা মসৃণ হয়।
কিন্তু যাঁরা যাবতীয় প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গী করে দৈনন্দিন রোজনামচায় নিত্যদিনের যুদ্ধে লড়ছেন, তাঁদের অনেকেই ‘সেলিব্রিটি’ নন। তাঁদের লড়াইয়ের কি কোনও দাম নেই? কেউ হয়তো ‘সুস্থ-স্বাভাবিক’ মানুষের সহানুভূতির প্রত্যাশী। অনেকে তা-ও নন। তাঁরা চান সম্মান, সম-অধিকারের মর্যাদা। কিন্তু সে-তো অনেক দূরের কথা। ন্যূনতম সহানুভূতিও কি তাঁরা পান? বাসের ‘হ্যান্ডিক্যাপ’ আসনে আরামে বসে থাকা ‘সাধারণ’ যাত্রীকে যখন সিট ছেড়ে দিতে হয়, তাঁদের মুখে এখনও তাহলে কেন বিরক্তির রেখা ফুটে ওঠে? রেলের টিকিট কাউন্টারে বিশেষভাবে সক্ষম কর্মীর পরিষেবা দিতে দেরি হলে কেন ভেসে আসে ‘বক্রোক্তি’? আর এই ধরনের মানসিকতা যে মোটেও বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, তারই সাম্প্রতিক নিদর্শন দু’টি ঘটনা।
এক, নয়াদিল্লি থেকে চেন্নাই যাওয়ার পথে বিমানের দরজায় হুইলচেয়ার চেয়েছিলেন বিশ্বমঞ্চে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা প্যারা-অ্যাথলিট সুবর্ণা রাজ। উড়ান সংস্থার কর্মীরা তাতে কর্ণপাত করার প্রয়োজন মনে করেননি। এমনটা প্রথম নয়, আগেও তিনি এই ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। বাধ্য হয়ে ব্যক্তিগত হুইলচেয়ার নিয়ে তিনি চলাফেরা করেন। কোনও এক উড়ান সংস্থার কল্যাণে সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত। ২০১৪ সালের প্যারা এশিয়ান গেমসে দু’টি পদক দিতেছিলেন সুবর্ণা। ২০১৩-য় থাইল্যান্ডে প্যারা টেবিল টেনিস ওপেনেও দু’টি পদক জিতেছিলেন তিনি। তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ্যে আসতেই বিমান সংস্থা দুঃখ প্রকাশ করেছে। উপযুক্ত তদন্তের আশ্বাসও দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন, তাহলে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে কীভাবে!
দ্বিতীয় ঘটনাটি তো আরও মারাত্মক। জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধকতার শিকার আরুষি সিং। হুইলচেয়ারে বসেই তাঁকে চলাফেরা করতে হয়। কলকাতা বিমানবন্দরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক সিআইএসএফ কর্মী তাঁকে তিনবার “উঠে দাঁড়িয়ে দু’পা হেঁটে” আসতে বলেন। অক্ষমতার কথা জানালে তাঁকে বলা হয়, “দু’মিনিটের জন্য উঠে দাঁড়ান’। আইনের ছাত্রী আরুষির আগেও এই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাঁর প্রশ্ন, নিরাপত্তা সংস্থার ম্যানুয়ালে কি দিব্যাঙ্গদের অপমান করার নিদান দেওয়া হয়? নিজের মুখে বারবার শারীরিক অসুবিধার কথা প্রকাশ করা আদতে কি মানসিক নির্যাতনের মধ্যে পড়ে না?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আমাদের দেশের পুরাণ-মহাকাব্যে কিন্তু দিব্যাঙ্গদের অসম্মান করা হয়নি। আমরা অন্ধ-মুনির কথা পড়েছি। জেনেছি অষ্টবক্র মুনির কথা, যিনি অষ্টবক্র গীতা রচনা করেছিলেন। যোড়শ শতকের কবি সুরদাস অন্ধ হয়েও পেয়েছেন প্রচুর সম্মান। ‘খোঁড়া’ তৈমুরের তো রাজ্য চালাতে কোনও সমস্যা হয়নি। স্মরণীয় হয়ে আছেন হেলেন কেলার, মেক্সিকোর কালজয়ী চিত্রশিল্পী ফ্রিডা কোহলো, গণিতবিদ জন ন্যাশ-সহ অনেকেই। তাহলে আজ এই দশা কেন?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
প্রতিদিনের রেলযাত্রায় বিভিন্ন স্টেশনে দিব্যাঙ্গদের জন্য শৌচালয় অনেকেই দেখে থাকবেন। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যায়, সেগুলি তালাবন্ধ। এটা ঠিকই যে, প্রতিদিন স্টেশনে বহু দিব্যাঙ্গ মানুষের সমাগম হয় না। কিন্তু একজনও যদি আসেন, তিনি কি জরুরি প্রয়োজনের সময় চাবি খুঁজে বেরবেন? ভিনরাজ্যের কথা বাদ দিন। এ-রাজ্যের বাস, ট্রেন, ট্রাম বা পরিবহণের কোনও মাধ্যমে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী দিব্যাঙ্গদের সহজে ওঠানামার কোনও বন্দোবস্ত অন্তত চোখে পড়ে না। অথচ ১৯৯৫ সালের প্রতিবন্ধকতা আইনেই সমান সুযোগ, অধিকার রক্ষার বিষয়গুলি উল্লেখ করা হয়েছিল। ২০০৬ সালে রাষ্ট্রসংঘের ‘অধিকার বিষয়ক সনদ’-এ স্বাক্ষর করেছিল ভারতও। যার অর্থ, প্রতিবন্ধীদের জন্য নতুন আইন প্রণয়নে ভারত দায়বদ্ধ। এর ১০ বছর পরে একটি আইন তৈরি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তার বাস্তবায়ন ঠিক কতটা হয়েছে, এত বছর পর সে প্রশ্ন ওঠা কি খুব অস্বাভাবিক?
আমাদের দেশের পুরাণ-মহাকাব্যে কিন্তু দিব্যাঙ্গদের অসম্মান করা হয়নি। আমরা অন্ধ-মুনির কথা পড়েছি। জেনেছি অষ্টবক্র মুনির কথা, যিনি ‘অষ্টবক্র গীতা’ রচনা করেছিলেন। যোড়শ শতকের কবি সুরদাস অন্ধ হয়েও পেয়েছেন প্রচুর সম্মান। ‘খোঁড়া’ তৈমুরের তো রাজ্য চালাতে কোনও সমস্যা হয়নি। স্মরণীয় হয়ে আছেন হেলেন কেলার, মেক্সিকোর কালজয়ী চিত্রশিল্পী ফ্রিডা কোহলো, গণিতবিদ জন ন্যাশ-সহ অনেকেই। তাহলে আজ এই দশা কেন? বৃহত্তর নাগরিক সমাজ প্রতিবন্ধকতাকে নিয়ে কেন আজও নেতিবাচক মানসিকতা বয়ে চলে?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: আক্রমণের ঝাঁজ বাড়াতেই কি রাজনীতিতে অপশব্দ ফিরে ফিরে আসে?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এর সবচেয়ে সহজ উত্তর সদিচ্ছার অভাব। যতক্ষণ না নিজের গায়ে আঁচ লাগছে, ততক্ষণ দূরে থাকাই ভালো– এই মানসিকতাই যত নষ্টের মূল। আর সে জন্য দায়ী আমরা সকলেই। শুধু সরকার, প্রশাসনের দিকে আঙুল তুলে লাভ নেই। ‘ওরা আলাদা, ওরা অন্য রকম’– এভাবেই দিব্যাঙ্গদের দিকে তাকাতে আমরা অভ্যস্ত। নীরজ চোপড়ার সাফল্য যতটা উচ্চকিতভাবে পালন করা হয়, ততটা ‘সাবাশি’ পান না সুমিত আন্তিল। কিন্তু তিনিও বিশ্বরেকর্ড করেছেন। প্যারালিম্পিকে সোনা জিতেছেন। সেই জ্যাভলিন ছুড়েই। দিব্যাঙ্গরা যে ‘করুণার পাত্র’ নন, নিজেদের সক্ষমতায়-অধিকারে তাঁরা যে ক্রমশ এগিয়ে চলেছেন, কোথাও হয়তো সেটা আমরাও মেনে নিতে পারি না।
সত্যিকারের ‘প্রতিবন্ধী’ কারা, সেটাও এবার ভেবে দেখার সময় হয়েছে।