আমি নিজেকে সাজাচ্ছি, না আঁকছি– এই প্রশ্নটা আমাকে তাড়া করত। ছোটবেলায় হয়তো এইভাবে কথা বলতে পারতাম না, বা বুঝতাম না। কিন্তু এখন বুঝতে পারি যে, এই মনুষ্যজীবনের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হচ্ছে যে, সে নিজেকে দেখতে পায় না। সেই দেখা-না-দেখা নিয়েই ‘রোববার.ইন’-এ লেখা শুরু করলাম। এই লেখা আসলে নিজের খোঁজ, নিজেকে দেখতে চাওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা। শুরু হল দেবশঙ্কর হালদারের কলাম ‘নটুয়া’। আজ প্রথম পর্ব।
১.
ক’দিন আগে দর্শকাসনে বসে একটা নাটক দেখলাম। যে নাটকটা দেখলাম, সেটায় ৩০ বছর আগে আমি অভিনয় করেছিলাম। এখন অন্যরা করছেন, নাটকটির ধরন স্বাভাবিকভাবেই পাল্টে গিয়েছে। অভিনেতা-অভিনেত্রী যাঁরা করেছেন, তাঁরা আজকের অভিনেতা-অভিনেত্রী। কয়েকজন পুরনো অভিনেতা তো আছেনই। আমি যে চরিত্রটি করেছিলাম, সেই চরিত্রটি আজকে যে ছেলেটি করছে, তার এখনও ৩০ বছর বয়স হয়নি বোধহয়। অর্থাৎ, তার জন্মের আগে যেটা আমি করেছি, সেটা আজকে দর্শক হিসেবে আমি দেখছি। সে নাটকটি আমার বড় প্রিয়। আমার সে নাটকে খুব আদর হয়েছিল। দর্শক ভালোবেসেছিলেন, আমিও চরিত্রটিকে খুব আদরে গ্রহণ করেছিলাম এবং নির্মাণও করতে পেরেছিলাম বলে মনে হয়।
আমি যদি ওই ৩০ বছর আগে নাটকের চরিত্রায়ণ করার সময়ে এই লেখাটি লিখতে বসতাম, তাহলে আমি যা ভাবতাম, আজকে কি আমি তাই ভাবি? মাঝখানে ৩০ বছর যে পেরিয়ে গেলাম। এখন যে কথা বলি বা লিখি, তার সঙ্গে আগের আমি-র তফাত থাকবেই, কিন্তু কোথাও একটা নাড়িতে মিলও থাকবে, থাকবেই।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………
যাত্রা যেহেতু মাঠে হত, সেই মাঠেই সাজঘর তৈরি হত, সেখানে সার সার যাত্রার ট্রাঙ্কগুলো পাতা থাকত। ট্রাঙ্কের ওপর আসন পেতে, সামনের আরেকটা ট্রাঙ্কের ওপর রূপসজ্জার জিনিসপত্র রাখা থাকত। একটি আয়নাও রাখা থাকত। বাবাকে দেখতুম হাতে ওই আয়নাটি সামনে ধরে চোখ আঁকছেন, রং মাখছেন, নিজেই নিজের মেকআপ করছেন।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আমার বাবা, অভয় হালদার, যাত্রার একজন প্রথিতযশা শিল্পী এবং প্রায় ৪৫ বছর চুটিয়ে অভিনয় করেছেন, পরে কিছুদিন যাত্রায় ম্যানেজারিও করেছেন, যাকে বলে সংগঠনের কাজ। আমি জন্ম ইস্তক বাবাকে দেখেছি অভিনয় করতে। বাবাকে চিনতামই অভিনেতা হিসেবে। যাত্রা যেহেতু মাঠে হত, সেই মাঠেই সাজঘর তৈরি হত, সেখানে সার সার যাত্রার ট্রাঙ্ক পাতা থাকত। ট্রাঙ্কের ওপর আসন পেতে, সামনের আরেকটা ট্রাঙ্কের ওপর রূপসজ্জার জিনিসপত্র রাখা থাকত। একটি আয়নাও রাখা থাকত। বাবাকে দেখতুম, হাতে ওই আয়নাটি সামনে ধরে চোখ আঁকছেন, রং মাখছেন, নিজেই নিজের মেকআপ করছেন। যাত্রায় প্রত্যেকে নিজেই নিজের মেকআপ করতেন সেই সময়ে। আমি দূর থেকে বাবার দিকে তাকিয়ে দেখতাম, বাবা মুখের ওপর যে বলিরেখা আঁকছেন, বা চোখটাকে বড় করে আঁকছেন, বা ঝুলপিটাকে আরও একটু চওড়া করে নিচ্ছেন, দূর থেকে দেখতে দেখতে মনে হত, বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন, না কি সামনে ধরা আয়নাটায় ছবি আঁকছেন? বাবা তো নিজের ছবিটা দেখছেন আয়নার ভিতর, আমরা বাইরে থেকে সেটা দেখতে পাচ্ছি। নিজের মুখের ওপর তাকিয়ে কিন্তু উনি নিজের এই বলিরেখা, নিজের দাড়িগোঁফ, নিজের বিস্ফারিত চোখ– এগুলো দেখতে পাচ্ছেন না। উনি দেখছেন আয়নার মধ্য দিয়ে, আর আমি দেখছি ওঁকে মাঝে মাঝে উঁকিঝুঁকি দিয়ে।
আমি নিজেকে সাজাচ্ছি, না আঁকছি– এই প্রশ্নটা আমাকে তাড়া করত। ছোটবেলায় হয়তো এইভাবে কথা বলতে পারতাম না, বা বুঝতাম না। কিন্তু এখন বুঝতে পারি যে, এই মনুষ্যজীবনের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হচ্ছে যে, সে নিজেকে দেখতে পায় না। নিজের চোখ দিয়ে কিছুতেই দেখার সুযোগ নেই তার। আমি যখন পুকুরের দিকে তাকাই, নদীর দিকে তাকাই, জলের ছায়া পড়ে তাতে– দেখি। কিন্তু নিজের চোখ দিয়ে নিজেকে দেখা যায় না। আমি আয়না ধরলে তো দারুণ দেখি, সারাদিন দেখি, দিবারাত্র দেখি, সারাক্ষণই দেখে আসছি, ওই আয়নায় একমাত্র আমাকে দেখা খাচ্ছে। অন্য লোক আমাকে দেখে বলে– তোমার মুখটা আজকে কীরকম মেঘলা দেখাচ্ছে, আরে তোমার মুখে তো আজ রোদ-ঝলমল করছে, কিংবা তোমার মুখে এত উপত্যকা ছিল জানতাম না তো! কিংবা তোমার মুখটা এরকম গড়ানো পথের মতো আজকে আবিষ্কার করলাম। এইসব যখন বলে, তখন আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওগুলো আবিষ্কার করার চেষ্টা করি আর ভাবি এ তো আমি আয়নার মধ্য দিয়ে দেখছি, জলের মধ্য দিয়ে দেখছি, আবার অন্য কারও সাহায্যে, অন্যের লাঠিতে ভর করে দেখছি। কিন্তু আমি যখন সেজে উঠছি, তখন আমার সমস্ত সাজ, কখনও রোদ্দুর দিচ্ছে, কখনও বৃষ্টি দিচ্ছে, কখনও বজ্রবিদ্যুৎ দিচ্ছে, কখনও ধুলো-মাটি দিচ্ছে, কখনও রঙিন জল দিচ্ছে। সেই পুরো সাজটায় যে আমি রঙিন হয়ে উঠছি, অথবা ধূসর হচ্ছি, যা-ই হই না কেন, সেইটা আমার দেখার উপায় নেই। কিন্তু আমি যখন অন্যের দিকে তাকাচ্ছি, তার সবটা আমি আবার দেখতে পাচ্ছি।
তাই আমার মনে হয়েছিল ছোটবেলা থেকে, এই জীবনে আমি যখন নিজেকে দেখতে পাব না, এইরকমই যখন দস্তুর, তাহলে আমাকে অন্যের চোখেই দেখতে হবে নিজেকে। মনে হত, আমার বাবা এমন একটি কাজ করেন, যে কাজটির মধ্যে এই দেখা, এই আকাঙ্ক্ষাটা দারুণভাবে প্রোথিত আছে। সেই দেখা-না-দেখা নিয়েই ‘রোববার.ইন’-এ লেখা শুরু করলাম। এই লেখা আসলে নিজের খোঁজ, নিজেকে দেখতে চাওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা।