পাঁচশোর মহাকীর্তি হতে পারত ভাইজ্যাকেই। বাজবলের জয়ধ্বজা বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে সতীর্থদের কাঁধে চেপে মাঠ ছাড়তে পারতেন অশ্বিন, সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টেই। সেখানে না হলেও রাজকোটে হল। ভারত-ইংল্যান্ড তৃতীয় টেস্টের দ্বিতীয় দিন। লেগ স্টাম্পের ঈষৎ বাইরে রাখা অশ্বিনের বলটা সুইপ মারতে গেলেন ইংরেজ ওপেনার জ্যাক ক্রলি। এবং বিপদ ডেকে আনলেন। আর সেই সঙ্গে অনিল কুম্বলের পর দ্বিতীয় ভারতীয় প্লেয়ার হিসেবে পাঁচশো উইকেটের মালিক হলেন অশ্বিন।
রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে কেউ বুঝল না। বিশ্বক্রিকেট বুঝল না। ভারতীয় ক্রিকেট বুঝল না। স্বয়ং ক্রিকেট-দেবতা, তিনি কি বুঝেছেন? না বোধহয়। নয়তো এতটা নিষ্ঠুর হতেন না অশ্বিনের ওপর!
তাঁর তো এখন সুখযাপনের কথা। টেস্ট ক্রিকেটে পাঁচশো উইকেট। ক্রিকেট-ব্রহ্মাণ্ডের রাজসভা আলো করে যে নয়জন ৫০০ টেস্ট উইকেটের কীর্তি গড়েছেন, সেই নবরত্নের অন্যতম তিনি। কিন্তু কোথায় সুখের আলাপন! কোথায় উল্লাসের ঢেউ! অশ্বিন সে-সবের শতহস্ত দূরে। কীর্তিস্থাপনের দিনেই দুঃসংবাদ বয়ে এসেছে। মা অসুস্থ। টেস্টের রণভূমি ছেড়ে তাই তাঁকে তড়িঘড়ি ফিরতে হয়েছে। রাজকোটে টেস্টের মাঝপথেই উদ্বিগ্ন পরিবারের পাশে থাকতে ছুটতে হয়েছে তাঁকে। ভারতীয় স্পিনের ‘প্রফেসর’-এর বিনিদ্র রজনী কেটেছে অসুস্থ মায়ের কাছে থেকে।
কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। এমনটা তো প্রাপ্য ছিল না অশ্বিনের। তিনি তো ক্রিকেট-সাধক। অনন্ত অধ্যাবসায়ে লাভ করেছেন সাফল্যের বীজমন্ত্র। ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন এককালের শত-শত তাচ্ছিল্য, উপেক্ষা-অবহেলার চাহনি আর কর্কশ সমালোচনাকে। এই ৫০০ উইকেটের ক্লাবে দ্বিতীয় ভারতীয় বোলার হিসেবে ঠাঁইপ্রাপ্তির শুভক্ষণে তাঁর তো আরও সুখময় পরিসর পাওনা ছিল। ক্রিকেট-বিধাতা তা বুঝলেন কই!
পাঁচশোর মহাকীর্তি হতে পারত ভাইজাকেই। বাজবলের জয়ধ্বজা বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে সতীর্থদের কাঁধে চেপে মাঠ ছাড়তে পারতেন অশ্বিন, সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টেই। সেখানে না হলেও রাজকোটে হল। ভারত-ইংল্যান্ড তৃতীয় টেস্টের দ্বিতীয় দিন। লেগ স্টাম্পের ঈষৎ বাইরে রাখা অশ্বিনের বলটা সুইপ মারতে গেলেন ইংরেজ ওপেনার জ্যাক ক্রলি। এবং বিপদ ডেকে আনলেন। আর সেই সঙ্গে অনিল কুম্বলের পর দ্বিতীয় ভারতীয় প্লেয়ার হিসেবে পাঁচশো উইকেটের মালিক হলেন অশ্বিন। অথচ খুব বেশি দিন আগের তো কথা নয়, এই অশ্বিনকেই বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে খেলানোর ‘সাহস’ দেখাতে পারেনি ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট। স্লো-টার্নার পেয়েও বিশ্বকাপ ফাইনালে অশ্বিনকে নামানোর ঝুঁকি নিতে পারেনি। উপেক্ষার এই পৃথিবী নতুন অভিজ্ঞতা নয় অশ্বিনের কাছে। বিদেশে টেস্ট মানেই অশ্বিন বরাবর ‘সেকেন্ড স্পিনার’। অথচ তাঁর ভাগ্যেই কি না আজ জ্বলজ্বল করছে বিশ্বের সেরা টেস্ট বোলারের তকমা। হায় সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ঘরোরা হোক কিংবা আন্তর্জাতিক– ম্যাচ না থাকলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নেট-নেশন ‘বাধ্যতামূলক’ করেছিলেন নিজের জন্য। তৈরি করেছিলেন নিজস্ব ‘কোর টিম’। যাঁরা বিপক্ষ ব্যাটারদের ডেটা-সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করে দিত তাদের শক্তি-দুর্বলতা। সেই তথ্যকে সামনে রেখে দিনের পর দিন নিজেকে তৈরি করেছেন আজকের অশ্বিন। বোলার হিসেবে নয়, প্রতিপক্ষ ব্যাটারের মোকাবিলা করেছেন একজন সহজাত-ব্যাটারের ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে। এই কারণেই অশ্বিন শুধু স্পিনার নন, ‘প্রফেসর’।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও অবশ্য থমানো যায়নি অশ্বিনকে। থামানো যায়নি অশ্বিনের নিজেকে প্রমাণ করার জেদকে। নিজেকে মেলে ধরেছেন অনন্য উচ্চতায়। কিন্তু তারপরেও রাজকীয় অভ্যর্থনা, সাফল্য উদযাপনের সুযোগটুকু আর কোথায় পেলেন ভারতীয় অফস্পিনার! রত্নগর্ভা জননীর অসুস্থতা তাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়েছে পরিবারের কাছে। ভাগ্যের এমন বিড়ম্বনা দেখলে একটা কথাই মনে উদ্ভাসিত হয়, ক্রিকেট মহাকুলে অশ্বিন যেন আজও ‘সূতপুত্র’ কর্ণ– যার বীরত্ব আছে, স্বীকৃতি নেই।
শুক্রবার পাঁচশোতম উইকেট শিকারের পর অশ্বিনকে ঘিরে যখন উল্লাসমুখর তাঁর সতীর্থরা, ড্রেসিংরুমে আরও একজনের মুখে দেখা যাচ্ছিল তৃপ্তির হাসি। রাহুল শরদ দ্রাবিড়। অশ্বিনের মতো তিনিও তো বরাবর ‘কাব্যে উপেক্ষিত’। এক দক্ষিণির যন্ত্রণা, আরেক দক্ষিণি বুঝবেন। নিশ্চয় বুঝবেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: বাংলা ক্রিকেটের অন্তর্জলী যাত্রার শুরু আছে, শেষ নেই
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
৫০০-র ল্যান্ডমার্কে পদার্পণে ৯৮টি টেস্ট খেলতে হয়েছে অশ্বিনকে। বল করেছেন ২৫,৭১৪টি। দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়া– ক্রিকেটের এই চতুষ্টয় ‘সেনা’ (SENA) নেশনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত ২৫ টেস্টে ৭১ উইকেট নিয়েছেন। অর্থাৎ ম্যাচ পিছু প্রায় তিনটি করে। তবে এসব শুকনো পরিসংখ্যান দিয়ে অশ্বিনের শ্রেষ্ঠত্বকে বোঝা মুশকিল। তা বুঝতে গেলে একবার তলিয়ে যেতে হবে, ৩৭-এর স্পিনারের মনের গহনে। কেরিয়ারের শুরুর দিকে যখন সাফল্য হাতড়াচ্ছেন, তখন বেশকিছু প্রাক্তন তারকা অশ্বিনকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ইংরেজ স্পিনার গ্রেম সোয়ানকে অনুসরণের। উল্লেখ্য, তা করেননি অশ্বিন। কী করেছিলেন? শোনা যায়, নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন অনুশীলনে। ঘরোরা হোক কিংবা আন্তর্জাতিক– ম্যাচ না থাকলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নেট-সেশন ‘বাধ্যতামূলক’ করেছিলেন নিজের জন্য। তৈরি করেছিলেন নিজস্ব ‘কোর টিম’। যাঁরা বিপক্ষ ব্যাটারদের ডেটা-সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করে দিত তাদের শক্তি-দুর্বলতা। সেই তথ্যকে সামনে রেখে দিনের পর দিন নিজেকে তৈরি করেছেন আজকের অশ্বিন। বোলার হিসেবে নয়, প্রতিপক্ষ ব্যাটারের মোকাবিলা করেছেন একজন সহজাত-ব্যাটারের ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে। এই কারণেই অশ্বিন শুধু স্পিনার নন, ‘প্রফেসর’। ক্রিকেটটা কবজির জাদুতে নয়, খেলেন মগজাস্ত্রে শাণ দিয়ে। তাই সময়ের চাকা যত গড়িয়েছে, ততই ঔজ্জ্বল্য বেড়েছে অশ্বিনের। তাঁর মধ্যে প্রকৃত ‘ম্যাচউইনার’-এর খোঁজ পেয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট। কিন্তু অশ্বিনের সেই পরিশ্রম দাম দিল কই! ক্রিকেট জনতার কাছে তো তিনি আইপিএলের মঞ্চে ‘মানকাডিংয়ের জনক’। কিংবা ইউটিউব-ভাষণে স্পষ্টবক্তা। এর বেশি তো কিছু নন।
তাই কথা ফুরলেও আক্ষেপ মেটে না। ফিসফিসিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়– রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে কেউ বুঝল না। বিশ্বক্রিকেট বুঝল না। ভারতীয় ক্রিকেট বুঝল না। স্বয়ং ক্রিকেট-দেবতা? তিনিও না।