আসলে এই আত্মপরিচয় জ্ঞাপনে তিনি কী বলতে চাইছেন, তা বোঝার মতো বোধ আমরা বিক্রি করে দিয়েছি ভোট সর্বস্ব এবং ক্ষমতার মধুভাণ্ড চেটেপুটে খেতে চাওয়া অপ-রাজনৈতিক সমাজের কাছে। তাই তিনি বহু দূরের অনাবিষ্কৃত জ্যোতিষ্কই থেকে যাবেন আমাদের কাছে।
২১ ফেব্রুয়ারি সাদেক আর আয়েষার বিয়ে হবে তাঁর বাড়িতে, এমনটাই পরিকল্পনা করেছিলেন অম্লান দত্ত। নিজের নাম-লগ্ন ‘কুসুম’ এবং পদবী-লগ্ন ‘গুপ্ত’ পরিহার করে তিনি ভারতখ্যাত অম্লান দত্ত– অর্থনীতিবিদ ও গান্ধীবাদী। ২০১০-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে অম্লানবাবু ফোন করে তাঁর এক কাছের মানুষকে বলেছিলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি আমন্ত্রিতদের জন্য তিনি কিছু জলযোগের ব্যবস্থা করতে চান। অম্লান দত্তর নির্দেশ সেই ‘কাছের মানুষ’ চলচ্চিত্র পরিচালক অরুণ চক্রবর্তীর সর্বাগ্রে পালনীয়। “কিন্তু বিকেল না হতেই সুগত হাজরা আমাকে ফোন করে বললেন যে, অম্লানদা হঠাৎ অসুস্থ বোধ করছেন, আমি যেন তাড়াতাড়ি ওঁর বাড়িতে পৌঁছে যাই। পথে বীণাদির সঙ্গেও আমার কথা হয়। ওখানে গিয়ে দেখি অম্লানদা ইজিচেয়ারে বসে আছেন, চোখের দৃষ্টি ভাষাহীন, খুব ধীরে ধীরে শ্বাস নিচ্ছেন। ঘামে শরীর ভিজে গেছে, হাত-পা একেবারে ঠান্ডা। বীণাদি আর আমি ঘষে ঘষে অম্লানদার হাত-পা গরম করার চেষ্টা করলাম। বীণাদি আমার হাতে Sorbitrate দিলে কোনওরকমে অম্লানদার জিভের তলায় দিয়ে দিই। ততক্ষণে অ্যাম্বুলেন্সকে খবর দিয়ে দিয়েছি। পাশেই থাকেন ডাঃ পার্থসারথি ভট্টাচার্য, তিনিও সময়মতো পৌঁছে যান এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করেন, কিন্তু সবাইকে হতাশ করে ছ’টা পনেরো মিনিটে অম্লানদা চলে গেলেন।”– লিখেছেন অরুণবাবু। তাঁর পরিচালিত তথ্যচিত্র ‘অম্লান- এক অনাবিষ্কৃত জ্যোতিষ্ক’-র মূল কথা শতবর্ষী অর্থনীতিবিদের মানবপ্রেম। এই পরিচালক অম্লান দত্তকে নিয়ে আরও একটি ছবি তৈরি করেছিলেন ‘কবি অম্লান’ শিরোনামে।
অম্লান দত্ত ও শিবনারায়ণ রায় ছিলেন গত শতকের মধ্যপর্বের প্রধান দুই বুদ্ধিজীবী এবং ঘোষিতভাবে বামবিরোধী। তাঁদের তৃতীয় সঙ্গী ছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ। এই তিন মনস্বীর চরিত্রলক্ষণ ছিল জেদ ও স্পষ্টবাদিতা, যূথবদ্ধতার সঙ্গে বিরোধ। শিবনারায়ণ রায় প্রয়াত হন ২০০৮-এর ২৬ ফেব্রুয়ারি। সাহিত্য আকাদেমি শিবনারায়ণ স্মরণের আয়োজন করেছিল। সেই শোকসভায় অম্লান বলেছিলেন যে, তাঁর জীবনের প্রধান দুই ব্যক্তি (শিবনারায়ণ ও গৌরকিশোর) চলে গেছেন, একা বেঁচে থাকতে তাঁর অপরাধী লাগছে। বস্তুত এঁরা তিনজনই ছিলেন র্যাডিকাল হিউম্যানিস্ট। শিবনারায়ণের শেষ জীবন মানবেন্দ্রনাথ রায়ের রচনার সম্পাদনা এবং তাঁর জীবনী লিখে অতিবাহিত হয়। মৃত্যুর আগে সে কাজ তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পেরেছিলেন। অন্যদিকে, অম্লান আর গৌরকিশোর দু’জনে ছিলেন গান্ধীপন্থীও। অম্লান গান্ধীতে ফেরার কথা বলেছিলেন: ‘গান্ধীজিই সভ্যতার শেষ স্টেশন’। দুই চিন্তাধারাকে নিজের জীবনে মেলাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি, ‘গান্ধীর শিক্ষাচিন্তা, পল্লি-সংগঠন এবং সর্বোপরি জীবনধারণে অত্যাবশ্যক বস্তুর অতিরিক্ত বিলাস-বাহুল্য ত্যাগের মহান আদর্শ তিনি নিজের জীবনে আমৃত্যু অনুশীলন করেছেন, যার তুলনা সহজে মেলে না। মাকড়সার জালের ডিজাইনের একটা পাঞ্জাবি পরতেন– ছেঁড়া সেলাই করতে করতে ডিজাইনটির সৃষ্টি হয়েছিল।’– লিখেছেন অরুন্ধতী ভট্টাচার্য। নিজ বিশ্বাস ও দর্শন অনুযায়ী সেই জীবনযাপন আজ আক্ষরিক অর্থে বিরল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সাহিত্য আকাদেমি শিবনারায়ণ স্মরণের আয়োজন করেছিল। সেই শোকসভায় অম্লান বলেছিলেন যে, তাঁর জীবনের প্রধান দুই ব্যক্তি (শিবনারায়ণ ও গৌরকিশোর) চলে গেছেন, একা বেঁচে থাকতে তাঁর অপরাধী লাগছে। বস্তুত এঁরা তিনজনই ছিলেন র্যাডিকাল হিউম্যানিস্ট। শিবনারায়ণের শেষ জীবন মানবেন্দ্রনাথ রায়ের রচনার সম্পাদনা এবং তাঁর জীবনী লিখে অতিবাহিত হয়। মৃত্যুর আগে সে কাজ তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পেরেছিলেন। অন্যদিকে, অম্লান আর গৌরকিশোর দু’জনে ছিলেন গান্ধীপন্থীও।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অম্লান দত্ত একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তক ও সমাজ দার্শনিক। কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে সময় কাটাতে ভালোবাসতেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মনে হত কফি হাউসে বসেও সবসময় তিনি কিছু না কিছু নিয়ে ভাবছেন। অধিকাংশ সময়েই একটা টেবিলে একাই বসে থাকতেন। একবার কফি হাউস বন্ধ করে দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে। অসংখ্য প্রতিবাদকারীর মধ্যে অন্যতম মুখ ছিলেন অম্লান। তখন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা বিষয়ে প্রায়ই বিতর্ক হত। কখনও পৃথকভাবে, কখনও-বা ছাত্র ও শিক্ষক মিলেমিশে। সেই সব বিতর্কে বসত চাঁদের হাট। কখনও উৎপল দত্ত ও বোম্মানা বিশ্বনাথনের মধ্যে, আবার কখনও হীরেন মুখোপাধ্যায় ও অম্লান দত্তর মধ্যে। উৎপল দত্তদের বিতর্কে রসিকতা থাকত বেশি, অম্লান দত্তদের বিতর্কে থাকত শাণিত যুক্তি। হীরেন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বিতর্কে কোনও-না-কোনওভাবে মানুষের ভবিষ্যৎ যুক্ত থাকত, কী করলে সমাজের মঙ্গল হয়, তাই ছিল তাঁদের তর্কের উপজীব্য।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ইলিয়াস এবং আমাদের মধুর করুণ বাসনা
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অম্লান দত্ত (জন্ম: ১৭ জুন ১৯২৪) ত্রিশ ছোঁয়ার আগেই তাঁর ‘For Democracy’ বইটি লেখেন। বইটি আইনস্টাইনের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল, বিজ্ঞানীর লেখা সপ্রশংস চিঠি বর্তমান প্রতিবেদকের দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। দার্শনিক রাসেল কমিউনিস্ট একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে অম্লানবাবুর যুক্তির উপস্থাপনায় চমৎকৃত হয়েছিলেন। অম্লান তাঁর জগৎ-বিখ্যাত ওই গ্রন্থে বলেছেন যে, গণতান্ত্রিক চেতনার প্রসারের জন্য জনগণের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার আবশ্যক। নিজের অধিকারগুলি সম্বন্ধে জনগণ সচেতন না হলে, সেসব অধিকারের সংরক্ষণে সজাগ ও উদ্যোগী না হলে সমূহ বিপদ। অন্য মানুষের জীবনধারা সম্বন্ধে সহনশীল হওয়া, ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে শ্রদ্ধাশীল হওয়া– গণতান্ত্রিক প্রাণসত্তার জন্যে এমন দৃষ্টিভঙ্গি অপরিহার্য। সহনশীলতা প্রকৃতিদত্ত গুণ নয়, সযত্ন পরিচর্যার মাধ্যমেই এর বিকাশ ঘটে। সহনশীলতা যে কত সহজে বিঘ্নিত হয়, তা শতকের মধ্যভাগে ম্যাকার্থিবাদের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক আদর্শ থেকে মার্কিন-রাষ্ট্রের স্খলনে লক্ষিত হয়েছিল। আবার ক্ষমতা বিচ্ছুরণের মধ্য দিয়েই গণতন্ত্রকে প্রসারিত করতে হবে। সমাজের রাজনৈতিক কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে সংসদীয় ও প্রশাসনিক ক্রিয়াকর্মে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের জন্য সাধারণ মানুষকে অধিকতর ক্ষমতা দিতে হবে। আর এই সংগঠন চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। নিচে থেকে গড়ে তুলতে হবে, আর এ-জন্য জনগণকেই উদ্যমী হতে হবে।
চারিদিকে আজ গণতন্ত্রের মুখোশে একনায়কের দাপট দেখতে দেখতে ভীত সন্ত্রস্ত আমরা অম্লান দত্তর শরণ নিতে পারি, কিন্তু নিই না। হুজুগ আর চটজলদির এই যুগ, চিন্তার দীনতা নিয়ে বাঁচতে ভালোবাসে। অধ্যাপক, উপাচার্য, আধিকারিক ইত্যাদি পেশাগত পরিচয়কে আড়ালে রেখে অম্লান দত্ত বলতে পছন্দ করতেন– ‘আমি চিন্তা করি’। আসলে এই আত্মপরিচয় জ্ঞাপনে তিনি কী বলতে চাইছেন, তা বোঝার মতো বোধ আমরা বিক্রি করে দিয়েছি ভোট সর্বস্ব এবং ক্ষমতার মধুভাণ্ড চেটেপুটে খেতে চাওয়া অপ-রাজনৈতিক সমাজের কাছে। তাই তিনি বহু দূরের অনাবিষ্কৃত জ্যোতিষ্কই থেকে যাবেন আমাদের কাছে।
প্রায় দেড় দশক আগে একুশে ফেব্রুয়ারির দিন অম্লান দত্তর বাড়িতেই, তাঁর ছবির সামনে সাদেক আর আয়েষার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। তিন দিন আগে প্রয়াত মানুষটির শেষ কাজ তো ওটাই ছিল, যা তিনি উদ্যোগ নিয়েও সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। অম্লান মানবতা আর একুশের চেতনা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল এই ঘটনায়।
ঋণ: তরুণ সান্যাল, অতীন্দ্রমোহন গুণ, অরুণ চক্রবর্তী-র প্রবন্ধ
ফটোগ্রাফির মস্ত শখ বিপুলদার। মাঝে মাঝেই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন ছবি তুলতে পত্রপত্রিকার জন্য। নানা বিষয়ে আজগুবি সব ছবি দেখেছি সে ছবি খুব একটা কোথাও প্রকাশ করতেন না। অবাক হয়েছিলাম ওঁর পাবলিক টয়লেটের প্যান ভর্তি বিষ্ঠার ছবি দেখে। অনেক। গা ঘিনঘিন করেনি, বরং মনে হচ্ছিল যেন চমৎকার সব বিমূর্ত চিত্রকলা।