রতন কাহার জন্মেছিলেন খটঙ্গার নিকটবর্তী কেঁদুলি গ্রামে। উত্তরাধিকার সূত্রে রক্তে ছিল সুর। ঠাকুরদা রাখহরি কাহার ছিলেন অন্ধ-গায়ক। গ্রামে গ্রামে ঘুরে গান গেয়ে মাধুকরী করে সংসার চালাতেন রাখহরি। রাখহরির ছেলে অচলচন্দ্র কাহার লোকের বাড়িতে মুনিশ খাটতেন আর তাঁর স্ত্রী টুকটুকি বাড়ি বাড়ি বাসন মাজা, কাপড়-কাচার কাজ করতেন। প্রবল অভাব, সব দিন ঘরে হাঁড়ি চড়ে না। উপরন্তু মহাজনের শোষণ আর গোরা সিপাইদের অত্যাচার। এইরকম এক পরিবারে বড় হয়ে ওঠা রতনের।
কার্তিক মাসের ভোর। মন্দিরা বাজিয়ে সিউড়ির পথে পথে টহল দিচ্ছেন প্রায় ৯০ ছুঁইছুঁই এক বৃদ্ধ। খালি পা, গায়ে একটা মলিন বাটিকের পাঞ্জাবি। হাঁটু পর্যন্ত মলিন ধুতি, গলায় নামাবলি। ঘাড় পর্যন্ত লুটিয়ে পড়েছে দুধ সাদা চুল, দাড়ি গোঁফ নিপুণভাবে কামানো। রতন কাহার।
হতদরিদ্র মানুষটির বিলাসিতা বলতে ওই টিপটপ কামানো গাল। সম্প্রতি মানুষটি ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত। স্বপ্না চক্রবর্তীর গাওয়া রতন কাহারের লেখা গান ‘বড় লোকের বিটি লো লম্বা লম্বা চুল’ প্রবল জনপ্রিয় হলেও রেকর্ডে গানটির কথা ও সুর প্রচলিত লেখা ছিল। সুদীর্ঘকাল পরে সর্বহারা মানুষটির এই স্বীকৃতি প্রাপ্তির মুহূর্তে চলুন একটু পিছন ফিরে দেখি।
রতন কাহার জন্মেছিলেন খটঙ্গার নিকটবর্তী কেঁদুলি গ্রামে, এই কেঁদুলি জয়দেবের জন্মস্থান নয়। উত্তরাধিকার সূত্রে রক্তে ছিল সুর। ঠাকুরদা রাখহরি কাহার ছিলেন অন্ধ-গায়ক। গ্রামে গ্রামে ঘুরে গান গেয়ে মাধুকরী করে সংসার চালাতেন রাখহরি। রাখহরির ছেলে অচলচন্দ্র কাহার লোকের বাড়িতে মুনিশ খাটতেন আর তাঁর স্ত্রী টুকটুকি বাড়ি বাড়ি বাসন মাজা, কাপড়-কাচার কাজ করতেন। প্রবল অভাব, সব দিন ঘরে হাঁড়ি চড়ে না। উপরন্তু মহাজনের শোষণ আর গোরা সিপাইদের অত্যাচার। এইরকম এক পরিবারে বড় হয়ে ওঠা রতনের। অচলচন্দ্র এক সময় বুঝতে পারলেন কেঁদুলিতে থেকে সংসার নির্বাহ করা তাঁর পক্ষে একরকম অসম্ভব। বউ-বাচ্চা সঙ্গে করে চিরকালের জন্য কেঁদুলি ছাড়লেন স্বপরিবার। উঠলেন শ্বশুরবাড়ি সিউড়িতে। ত্রাণ-সমিতির কাছে নগরীপাড়ায় বাসা বাঁধলেন অচলচন্দ্র।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: স্কুল সার্ভিসের কল্যাণে দেখেছিলাম অন্য এক সন্দেশখালিকে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সিউড়িতেই বালক রতন কাহারের মধ্যে গান-বাজনার অদম্য নেশা দেখা দিল। লেখাপড়া বেশি দূর হল না অভাবের কারণেই। বালক বয়স থেকেই বিড়ি বাঁধার কাজ নিলেন। কারণ একটাই, বিড়ি বাঁধার কাজ করতে হয় ঘরে বসে। একই সঙ্গে বিড়ি আর গান দুটোই বাঁধা যায়। গানের জন্যই কিশোর রতনের ডাক আসত আলকাপ দলে। আলকাপের ছোকরা হয়ে অর্থাৎ মেয়ে সেজে নাচতেন গাইতেন। শুরু হল বন্যার মতো গান বাঁধা। ভাদু-টুসু-ঝুমুর-বাউল গানে উপচে উঠল রতনের খাতা। তারপর যুবক রতনের বিয়ে হল, সন্তান এল ঘরে। কিন্তু মাত্র এক বছরের মাথায় শিশু-সন্তান রেখে রতনের স্ত্রী চলে গেলেন পরপারে। পাড়ার লোকে বলল, ওইটুকু দুধের শিশুকে কে দেখবে! রতনের আবার বিয়ে দাও। সেই দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রীর সঙ্গেই আজও তাঁর সংসার।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সিউড়িতেই বালক রতন কাহারের মধ্যে গান-বাজনার অদম্য নেশা দেখা দিল। লেখাপড়া বেশি দূর হল না অভাবের কারণেই। বালক বয়স থেকেই বিড়ি বাঁধার কাজ নিলেন। কারণ একটাই, বিড়ি বাঁধার কাজ করতে হয় ঘরে বসে। একই সঙ্গে বিড়ি আর গান দুটোই বাঁধা যায়। গানের জন্যেই কিশোর রতনের ডাক আসতো আলকাপ দলে। আলকাপের ছোকরা হয়ে অর্থাৎ মেয়ে সেজে নাচতেন গাইতেন। শুরু হল বন্যার মত গান বাঁধা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বিড়ি বাঁধা আর গান বাঁধার পাশাপাশি পথের নেশা চিরকাল ঘরছাড়া করেছে রতনকে। কখনও আজকের ‘বাউল সম্রাট’ পূর্ণচন্দ্র দাসের সঙ্গে ভিড়ে গান গেয়ে বেরিয়েছেন গ্রামে গ্রামে, বাউল গানের আসরে, আবার কখনও যাত্রা দলে বিবেকের গান গাইবেন বলে জুটে গিয়েছেন মহামায়া অপেরা, শক্তি অপেরায়। সে-ও ওই গানের নেশার সঙ্গে দুটো বাড়তি পয়সা রোজগারের তাগিদে। কিন্তু রোজগার আর কতই বা হয় ! আজও তিনি বিয়ে দিতে পারেননি মেয়ের।
এইভাবেই চলতে চলতে জয়দেবের বাউলমেলায় আলাপ হয়ে যায় আকাশবাণীর আর্য চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি রতনকে প্রথম রেডিওতে গান গাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেটা ১৯৭৬ সাল। রতন গাইলেন নিজের বাঁধা গান– ‘আম তানা না, ভালো লাগে না’।
রতনের অজস্র গান এখন জনপ্রিয়। ‘বড়লোকের বিটি লো’ ছাড়াও ‘ভাদু লে লে পয়সা দু-আনা’, ‘সরে আয় ভাদু তোর মাথা বেঁধে দি’, ‘ভাদু ভেলে চল ময়ূরাক্ষী ক্যানেলে কত জল’ প্রভৃতি অজস্র গান মানুষের মুখে ফেরে। একসময় সিউড়ির ‘আনন’ নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থিয়েটারেও গান গেয়েছেন। ১৯৭৯ সালে স্বপ্না চক্রবর্তী রতনের ‘বড়লোকের বিটি লো’ রেকর্ড করার আগেই ১৯৭৭ সালে স্বয়ং রতন কাহার আকাশবাণীতে গানটি গেয়েছিলেন। গানটি তিনি বেঁধেছিলেন ১৯৭২ সালে। রতন কাহারের মুখেই শোনা গানটির জন্ম-বৃত্তান্ত। সারা সিউড়ি শহর পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতেন রতন। সিউড়ি স্টেশনের লাগোয়া তালতলা নিষিদ্ধ-পল্লিতে একদিন দেখেছিলেন একজন যৌনকর্মী-মা তার কন্যার চুল বেঁধে দিচ্ছেন পরম মমতায়। রতন কাহারের মনে হয়েছিল– এই মেয়েটির বাবা হয়তো কোনও বড়লোক মানুষ যার সন্তান গর্ভে ধরেছিলেন এই পতিতা জননী। ‘বড়লোকের বিটি লো’ ভাবনাটি তখন থেকেই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে, হাঁটতে হাঁটতেই মনে মনে গাইতে থাকেন সেই গান, যা পরবর্তী সময়ে ইতিহাস সৃষ্টি করবে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: গাছেদের কাছে একটু-আধটু দাঁড়িয়ে থাকা শিখে নিই
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সারাটা জীবন গানেই বেঁচে রইলেন রতন কাহার। জীবনের সূচনার কথা বললেন গানে, লিখলেন– ‘কেঁদুলি আমার জন্মভূমি/ কেঁদুলি আমার প্রাণ/ যদি জানি কিছু সে তো/ মা দ্বারবাসিনীর দান।’ সেই তিনিই এই ৮৮ বছর বয়সে গানে বেঁধে রাখলেন ভারতের চন্দ্রবিজয় নিয়ে। লিখলেন– ‘যাবে গো যাবে গো মানুষ মহা আকাশে।’ গান ছাড়া রতন কাহার শূন্য। সম্প্রতি গড়গড়িয়া গ্রামে শিলাজিতের ‘নৌকা’র পক্ষ থেকে রতন কাহাকে সম্মাননা দেওয়া হয়। শিলাজিৎ রতন কাহারকে অনুরোধ করেন একটা গান গাওয়ার জন্য, উনি বলেন– ‘আমি দুটো গান গাইবো।’ এই বয়সেও মঞ্চে নিখুঁত ছন্দে নেচে নেচে গাইতে পারেন। বীরভূম তাঁর প্রাণ। সেই প্রাণের বীরভূমের কথা বলতে গিয়ে গান বাঁধেন– ‘বীরভূমের রাঙ্গামাটিতে/ গাইবো বাউল একতারা হাতে/ মনের আনন্দেতে দিনে প্রভাতে/ আমাদের ভাঙ্গায় কত সুখের ঘুম/ বিবাগী বাউলের দেশ ভাই/ মোদের এ বীরভূম।’
তিনি জানেন এই সাধের বীরভূম ছেড়ে, এই সাধের পৃথিবী ছেড়ে তাঁকেও চলে যেতেই হবে। গানের পাখি রতন কাহার তাই গেয়ে ওঠেন– ‘আমার গান শুনে যান ও গো বাবু/ দুখেরই সংসারে/ এখন আমি শুকনো পাতা/ কখন যাবো ঝরে–’ ঝরে যেতে তো সকলকেই হবে রতন কাহার, কিন্তু আপনার মতো ক’জনই বা সুরে বাঁধতে পারে সেই সত্যকে ! অমন করে হেসে হেসে নেচে নেচে আর কেইবা মরণকে কলা দেখিয়ে গাইতে পারে– ‘অন্তিমকালে জীবন আমার টলমল টলমল করে !’