নামকরণ বা লেবেলিং একটি অত্যন্ত গোলমেলে বস্তু! একটি ১৯০৫-এ প্রকাশিত ইংরেজি ভাষায় লিখিত উপন্যাসিকা বা আখ্যায়িকার বাংলা অনুবাদ, তা প্রথম বাঙালি নারীর ইউটোপিয়া, প্রথম বাঙালি নারীর স্পেকুলেটিভ ফিকশন বা কল্পবিজ্ঞান গল্পের আদিরূপ বললে, নানা রকম বিতর্ক আসে। কিন্তু এখানে ওই জঁরের লক্ষণাক্রান্ত বলে চিহ্নিত করাটাই আসল উদ্দেশ্য। আজকের দিনে ওই প্রাচীন কাহিনিটির ভিতরে ইউটোপিয়া খুঁজে পেলেই আমরা তাকে সে নামে ডাকতে পারি বইকি। ‘সায়েন্স ফিকশনারী’-র দ্বিতীয় পর্ব।
২.
১৫১৬ সালে টমাস মোর লাতিন ভাষায় লেখেন ‘ইউটোপিয়া’, পুরো নামটির অর্থ হল, শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র সম্বন্ধীয় ও নতুন দ্বীপ ‘ইউটোপিয়া’ সম্বন্ধে। ইউটোপিয়া নামের একটি দ্বীপ, যেখানে একটি দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় এলাকাগুলোর অবস্থা ঠিক যা যা হওয়া উচিত, তাই তাই আছে। বইটি সম্পর্কে বলা হয়েছিল, এই গ্রন্থপাঠ ‘not less beneficial than enjoyable’. সেই থেকেই রয়ে গেল ইউটোপিয়ার ধারণা, এবং তার সঙ্গে এসে যোগ হয়েছে ‘ডিসটোপিয়া’ নামক সম্পূর্ণ বিপরীত আরেকটি ধারণাও।
চারের দশকে মার্কিন লেখক রবার্ট হেইনলিন প্রথম আরেক শব্দবন্ধের জন্ম দেন। ‘স্পেকুলেটিভ ফিকশন’। এই জঁর নিয়ে আজকের দিনে সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলে। ১৯৪৯ সালে লিখিত জর্জ ওরওয়েলের ‘১৯৮৪’ থেকে শুরু করে আটের দশকে মার্গারেট অ্যাটউডের ‘হ্যান্ড মেইডস টেল’। এমনকী, প্রাচীন নানা গথিক হরর গোত্রের কাহিনি, যথা ব্রাম স্টোকার-এর ‘ড্রাকুলা’– এও আসলেই স্পেকুলেটিভ ফিকশন। এমনকী, শেক্সপিয়ারের ‘এ মিডসামার নাইটস ড্রিম’-ও তাই। তবে, বিখ্যাত যাবতীয় স্পেকুলেটিভ ফিকশনের মধ্যে অধিকাংশই হল ডিসটোপিয়া। অর্থাৎ, ভবিষ্যৎ বা অন্য কোনও বাস্তবতা সম্পর্কিত, যেখানে সবকিছু মোটেই ভালো নয়।
নামকরণ বা লেবেলিং একটি অত্যন্ত গোলমেলে বস্তু! একটি ১৯০৫-এ প্রকাশিত ইংরেজি ভাষায় লিখিত উপন্যাসিকা বা আখ্যায়িকার বাংলা অনুবাদ, তা প্রথম বাঙালি নারীর ইউটোপিয়া, প্রথম বাঙালি নারীর স্পেকুলেটিভ ফিকশন বা কল্পবিজ্ঞান গল্পের আদিরূপ বললে, নানা রকম বিতর্ক আসে। কিন্তু এখানে ওই জঁরের লক্ষণাক্রান্ত বলে চিহ্নিত করাটাই আসল উদ্দেশ্য। আজকের দিনে ওই প্রাচীন কাহিনিটির ভিতরে ইউটোপিয়া খুঁজে পেলেই আমরা তাকে সে নামে ডাকতে পারি বইকি।
কাজেই বলতেই পারি, ১৯০৫ সালে বেগম রোকেয়া লিখিত ‘‘সুলতানা’স ড্রিম’’, যার বাংলা অনুবাদ ‘সুলতানার স্বপ্ন’ (লেখকের নিজের করা অনুবাদ), সেটিই হল নারী লিখিত প্রথম ইউটোপিয়া, যা কল্পবিজ্ঞানধর্মী, নারীবাদী, স্পেকুলেটিভ ফিকশন। এবং অনেক স্পেকুলেটিভ ফিকশনের ধারার বিপরীতে গিয়েই, এটি একটি স্বর্ণকল্পনা, একটি আদর্শ সমাজের কল্পনা। এটুকু দাবি করলে খুব ভুল হবে না। স্পেকুলেটিভ ফিকশনের বিশাল তাঁবুর ভেতরে এই টেক্সটটি ধরে যাবেই, যা আবার বিশেষভাবেই আধুনিক নারীবাদীদের পঠনপাঠনের ও আগ্রহের বিষয় আজকের দিনে।
কে এই বেগম রোকেয়া?
‘আমাদের যখন স্বাধীনতা ও অধীনতাজ্ঞান বা উন্নতি ও অবনতির প্রভেদ বুঝিবার সামর্থ্যটুকুও থাকিল না, তখন ক্রমশ তারা ভূস্বামী প্রভৃতি হইতে হইতে আমাদের স্বামী হইয়া উঠিল। আর আমরা তাহাদের গৃহপালিত পশুপক্ষী বা মূল্যবান সম্পত্তিস্বরূপ হইয়াছি।’
এইসব লেখা ১৯০৪ সালের। বাংলার নারী-স্বাধীনতা বলতে আমরা যা নিয়ে মাতামাতি করি, সেসবের বেশ কিছু বছর আগেই। উপরের লেখাটি রোকেয়ার, যাঁকে ‘বেগম’ বলা উচিত হবে কি না, তা নিয়ে খোদ লেখাটিই সন্দেহ জাগায়।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সেই ইউটোপিয়াই পরের উপন্যাস ‘পদ্মরাগ’-এ প্রসারিত হয়, কিন্তু এখানে আর স্বপ্নের অবতারণা নেই। বাস্তবেই একটি গার্লস স্কুলকে ঘিরে নারীদের সমন্বয় দেখান রোকেয়া, ঠিক যেমনটা তিনি চান, যেমনটা হলে ভালো হত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
রোকেয়া মুসলমান নারী বা বাঙালি নারীদের মধ্যে বহু বিষয়ে অগ্রণীই ছিলেন না শুধু, রোকেয়া সম্ভবত বিশ্বের প্রথম ‘ফেমিনিস্ট ইউটোপিয়ান নভেল’-এর রচয়িতা। বিশ শতকের প্রথম, তথা দ্বিতীয়ভাগে ‘ফেমিনিস্ট ইউটোপিয়ান নভেল’ নামে পশ্চিমি সাহিত্যে এক জঁর দেখা দেয়। সেই নভেলগুলোর বেশ খানিক আগেই সেই ধারায় ‘‘Sultana’s Dream’’ রচিত। ১৯০৫ তার প্রথম প্রকাশ, পরে Indian Ladies Magazine-এ পিরিয়ডিকালি প্রকাশিত হয় ১৯০৮ সালে।
বঙ্গভঙ্গের কাল। অভিজাত, প্রগতিশীল, হিন্দু পরিবারের মেয়েরাও তখন পরপুরুষ কে দেখছেন চিকের আড়াল থেকে। লেখিকা এদিকে প্রশ্ন তুলে ফেললেন জেনানা বা পর্দার মতো ‘স্বাভাবিক’ ব্যাপারস্যাপার নিয়ে। সুলতানা অবাক হয়ে দেখল, (আসল পৃথিবীর জেনানার মতোই) নারী-ইউটোপিয়ায় ‘মর্দানা’ বা পুরুষের পর্দার ব্যবস্থা। এইভাবে ভারতের তথা বিশ্বের প্রথম ফেমিনিস্ট ইউটোপিয়া এঁকে ফেললেন রোকেয়া। এখানে নারীরা স্বাধীনভাবে বিচরণ করে। পুরুষরা বদ্ধ থাকে, কারণ তারা উন্মত্ত আচরণ করে। আবার অনুশোচনা করে শুদ্ধ হলে তারাও মুক্ত হয়। এইসব লেখা হয়েছিল পশ্চিমের প্রথম ফেমিনিস্ট ইউটোপিয়া ‘হারল্যান্ড’ (Herland) রচিত হওয়ারও ১০ বছর আগে।
সেই ইউটোপিয়াই পরের উপন্যাস ‘পদ্মরাগ’-এ প্রসারিত হয়, কিন্তু এখানে আর স্বপ্নের অবতারণা নেই। বাস্তবেই একটি গার্লস স্কুলকে ঘিরে নারীদের সমন্বয় দেখান রোকেয়া, ঠিক যেমনটা তিনি চান, যেমনটা হলে ভালো হত।
এক প্রতাপশালী জমিদার বাড়ির তিন অবরোধবাসিনী কন্যার একজন রোকেয়া। বাবা জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ আলি হায়দার আবু সাবের। মেয়ের ছোটবেলা থেকে পড়াশুনোর দিকে মন। বাংলা ভাষাকে বেদম ভালোবাসেন। বাবাকে লুকিয়ে পড়েন। দাদার কাছে মোমবাতির আলোতে পাঠ সম্ভব হয়। কিন্তু বাবা জানতে পেরে তুমুল ক্রুদ্ধ হন। এবং বিয়ে দিয়ে দেন।
১৮৯৬ সাল। এবার ষোড়শী রোকেয়ার নিকাহ্ হয়ে গেল বিহারের ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। বিপত্নীক সাখাওয়াত হোসেন তার থেকে বয়সে বহু বড় ছিলেন। উপরন্তু, তাঁর আগের পক্ষের সন্তানাদিও ছিল। তবু অসমান এই বিয়ে রোকেয়ার কাছে নিয়ে এল অপ্রত্যাশিত এক সৌভাগ্য। সাখাওয়াত ছিলেন বাস্তবিক অর্থেই প্রগতিশীল ও উদারমনা। স্ত্রীর জ্ঞানপিপাসাকে অনুভব করে, তাকে নির্বাপিত করার বদলে আরও উজ্জ্বল করে তুললেন তিনি। স্বামীর উৎসাহে নিশ্চিন্ত মনে পুরোদমে পঠনপাঠন শুরু করল নববধূটি। সাখাওয়াত হোসেন নিজে উর্দুভাষী হলেও স্ত্রীর বাংলা চর্চায় বাধা দেননি কখনও, তবে স্বামীর কাছে উচ্চমানের ইংরেজি শিক্ষা সম্ভব হলেও ভাগলপুরের অবাঙালি পারিপার্শ্বিকে বাংলা শেখার তেমন সুযোগ পাননি রোকেয়া। পড়ালেখার পাশাপাশি এ সময় থেকেই সারাদিন মনের মধ্যে ভিড় করে আসা হাজারো ভাবনা ও কল্পনাকে গল্প-কবিতার আকারে লিখে রাখতে শুরু করেন তরুণী রোকেয়া, কখনও ইংরেজি আবার কখনও বা প্রিয় মাতৃভাষায়।
পরে, আমরা আলোচনা করতেই পারি, কেন ১৯০৫ সালের এই কল্পগল্পটিকে আজকের অধ্যয়নে, কল্পবিজ্ঞানের প্রথম যুগের সমস্ত লক্ষণ সম্পন্ন মনে করা হচ্ছে।
(চলবে)
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই