সতেরো বছরের দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনের পথ পরিক্রমায় যেমন ক্রীড়াব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্য পেয়েছি, তেমনই সাহচর্য লাভ করেছি দিকপাল ক্রীড়া সাংবাদিকদের। যাঁদের কেউ কেউ প্রভাব বিস্তারের সঙ্গে সমৃদ্ধও করেছেন জীবনকে। ‘খেলাইডোস্কোপ’-এ এবার তাঁদের কথা তুলে ধরার পালা। আজ দ্বিতীয় কিস্তি।
দুলালদা ভারি মজার মানুষ। দুলালদা কখনও রাগ করে না!
দুলালদার পেট যন্ত্রণা শুরুর পাঁচ মিনিটের মধ্যে বিরিয়ানি খাওয়ার শখ জাগে। দুলালদা রাত্তির দশটার শো-এ শাহরুখ খানের খাজা সিনেমা তিন নম্বর বার দেখবে বলে টানাটানি শুরু করে (কী না, প্রথম দু’বার ফার্স্ট সিন মিস হয়েছে!)। দুলালদা অফিস এসে বকবক করে কখনও কখনও মাথা ধরিয়ে দেয়। দুলালদা সময় বিশেষে আমার বকাঝকা (বয়সে আমি কিন্তু অনেক ছোট, অনেক জুনিয়র, তবু) নির্বিচারে সহ্য করে। কিন্তু দুলালদা কক্ষনও রাগ করে না!
দুলালদা, অর্থাৎ প্রথিতযশা সাংবাদিক দুলাল দে-র সঙ্গে আমার সখ্য-আলাপ-পরিচয় দু’ভাগে। প্রথমে দু’মাস ‘আনন্দবাজার’-এ। তার পর এই ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ, বছর সাত ধরে যা চলছে। ‘আনন্দবাজার’-এ থাকাকালীন দুলালদার সঙ্গে বর্তমানের উষ্টুম-ধুষ্টুমের তেমন সুযোগ পাইনি। একে তখন নিজে স্রেফ গেঁড়ি-গুগলি গোত্রীয় ছিলাম। দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিনিয়রদের বোলবোলাও আর তোড়ফোঁড়ের ঠেলায় আমার পাঁয়তারা কষার বিশেষ জায়গা ছিল না। তা ছাড়া দুলালদা ‘আনন্দবাজার’-এ চাকরি করে মাত্র মাস দু’য়েকের জন্য। এক আকাশ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ‘সংবাদ প্রতিদিন’ থেকে এসেছিল। দু’মাস পর এক সাগর চোখের জল নিয়ে ফিরে গিয়েছিল। অতীব ‘পরোপকারী’ কতিপয় সিনিয়রের কাঠি-শিল্পের বলি হয়ে (যাঁদের মধ্যে একজন আবার নাকি ময়দানি বচন অনুযায়ী চরম নির্মোহ এক সাধক)। পুরনো সেই দিনের কথা মনে পড়লে দুলালদার আজও ঈষৎ দুঃখ হয়। কিন্তু আমার ভালই লাগে। কানের কাছে তা হলে আর লাগাতার বকবক করত কে? রাত একটায় পাঞ্জাবি ধাবায় রুটি-কিমা খাওয়ার বায়না জুড়ত কে? দুলালদা আজ ‘আনন্দবাজার’-এ থাকলে আমাদের ‘সংবাদ প্রতিদিন’ স্পোর্টসের জীবন যে বড় আলুনি হয়ে যেত!
আসলে কী জানেন, মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রুর নাম বাংলায় ‘অহং’। হিন্দিতে ‘ঘমন্ড’। ইংরেজিতে ‘ইগো’। এই অহং, ঘমন্ড, কিংবা ইগো মানুষে-মানুষে দেওয়াল তৈরি করে। দূরত্ব বাড়ায়। মমত্ব কমায়। দুলালদার সাড়ে পাঁচশো দোষ থাকতে পারে। কিন্তু নেই শুধু ইগো। অথচ থাকতে পারত। থাকলে কিছু বলারও থাকত না। মনে রাখা দরকার, কাগজ হিসেবে আমরা আঞ্চলিক। পশ্চিমবঙ্গ-ভিত্তিক। সর্বভারতীয় কাগজ আমরা নই। কিন্তু তারপরেও দুলাল দে ভারতীয় ফুটবলে প্রথম দু’য়ে থাকা সাংবাদিক। অনেক আচ্ছা-আচ্ছা রাঘব-বোয়াল সাংবাদিক যে খবর পেতে ঘোল খেয়ে যায়, দুলালদা তা পায় ফুৎকারে। মুর্গির ঠ্যাং চিবোতে-চিবোতে! কিন্তু তার পরেও প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই ভদ্রলোককে (ভাবাই যায় না এখন সাতচল্লিশ-আটচল্লিশ) নাক সিঁটকে চলে যেতে কখনও দেখিনি। সাংবাদিক হিসেবে দুলালদার শ্রেষ্ঠ খবর (অন্তত আমার দেখা) বহু, বহু বছর ধরে ‘নিরুদ্দেশ’ থাকা মজিদ বাসকারকে খুঁজে বের করা। যদিও দুলালদা নিজে বিশ্বাস করে, মজিদ-আবিষ্কার আদতে পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা। বরাতজোরে পাওয়া (মুশকিল হল, পরিশ্রমী না হলে বরাত অকেজো হয়ে থাকে বলেই জানি)। বিশ্বাস করে, ওর সেরা খবর প্লেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন গঠনের কাহিনি। যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন চলেছিল লম্বা সময় ধরে। এবং যা লিখে দেওয়ার পর ভারতবর্ষের তৎকালীন এক নম্বর ফুটবলারের সঙ্গে দুলালদা-র বাক্যালাপ বন্ধ ছিল ছ’মাস। সেই প্লেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের খবর লেখার সময় আমি ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ কাজ করতাম না। কিন্তু ইরান থেকে বাসকর সাহেবের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় ছিলাম, ওটা দেখেছি। তা, বাসকর-বিস্ফোরণের পর দুলালদা’র কলার উঠতে পারত কিছুটা। ওঠেনি। আচরণেও অবজ্ঞা জুড়তে পারত। জোড়েনি। বরং সাক্ষাৎকার বাগানোর পর দুলালদা’র সঙ্গে ফোনালাপ বেশ এখনও মনে করতে পারি।
‘রাজু, ফাটাফাটি হয়ে গিয়েছে! মজিদ বাসকরকে পেয়ে গিয়েছি!’
‘কী??’
‘হ্যাঁ। কী করে বল তো….।’ ব্যস, হম্বিতম্বির ছায়াও না ছুঁয়ে শুরু হয় সরল ধারা-বিবরণ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সাংবাদিক হিসেবে দুলালদার শ্রেষ্ঠ খবর (অন্তত আমার দেখা) বহু, বহু বছর ধরে ‘নিরুদ্দেশ’ থাকা মজিদ বাসকারকে খুঁজে বের করা। যদিও দুলালদা নিজে বিশ্বাস করে, মজিদ-আবিষ্কার আদতে পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা। বরাতজোরে পাওয়া (মুশকিল হল, পরিশ্রমী না হলে বরাত অকেজো হয়ে থাকে বলেই জানি)। বিশ্বাস করে, ওর সেরা খবর প্লেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন গঠনের কাহিনি। যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন চলেছিল লম্বা সময় ধরে। এবং যা লিখে দেওয়ার পর ভারতবর্ষের তৎকালীন এক নম্বর ফুটবলারের সঙ্গে দুলালদা-র বাক্যালাপ বন্ধ ছিল ছ’মাস।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
নিঃসন্দেহে সাংবাদিক হিসেবে দুলালদা প্রবল জনপ্রিয়। আবার মহা বিতর্কিতও বটে! আজ পর্যন্ত দেখিনি, কোনও সাংবাদিককে নিয়ে এত ‘মিম’ হয়েছে, অতিকায় ‘টিফো’ বেরিয়েছে! আর কোথাও গিয়ে এর প্রত্যেকটা দুলাল দে নামটাকে আরও বেশি সর্বাত্মক করে ছেড়েছে। সে ভাল হোক বা খারাপ। প্রিয় হোক বা অপ্রিয়। এতটুকু ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে লিখছি না। দুলালদাকে নিয়ে যাঁরা ঠাট্টা-তামাশা-মস্করা করেন, তাঁদের ধারণাও নেই কোন অবস্থা থেকে মানুষটার উত্থান। যতদূর জানি, সোনার চামচ দূরস্থান, জন্মগ্রহণের সময় মুখে সোনার জল করা চামচও ছিল না। স্বপ্ন দেখার সময় বাবার কারখানায় লকআউট দেখতে হয়েছে। ফুটবলার হওয়ার সাধকে কবর-চাপা দিয়ে ইট-চুন-সুড়কির হিসেব রাখতে হয়েছে। প্রায়শই দুলালদা-কে জিজ্ঞাসা করি, জীবনের প্রতি তোমার এত চাহিদা কেন? সাংবাদিকতা করছ। মাঝে ব্যবসাপাতি করতে গেলে। এখন আবার স্ক্রিপ্ট লিখছ, সিনেমা করছ। দু’দণ্ড শান্তি পেতে পারো তো। যা আছে, যতটুকু আছে, তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারো তো।
মুচকি হাসে দুলালদা। বলে, ‘পারি না।’
আমি জানি, কেন পারে না। আসলে জঠরের জ্বালা অনুভব করলে মানুষের মধ্যে জান্তব একটা জেদ কাজ করে কখনও কখনও। সারা জীবন ধরে তখন তাকে তাড়া করে সাফল্যের বন্য ক্ষুধা। কারণ, সে শেষ জীবনে আর কোনও অনিশ্চয়তা রাখতে চায় না। তাতে বর্তমানে যদি ভয়ানক ঝুঁকিও নিতে হয়, অসুবিধে নেই। প্রয়োজনে সাত দিন ধরে একটা খবর ধাওয়া করতে দেখেছি দুলালদাকে। মজিদ বাসকর তল্লাশি-পর্ব চলেছিল আড়াই বছর ধরে। মজিদের এক পরিচিত ছিলেন। ইয়েজদি। ভদ্রলোক দুলালদা-কে ‘অমুকের নম্বর দাও, তমুকের নম্বর দাও’ বলে দিবারাত্র জ্বালাতেন। দুলালদা বিনিময়ে মজিদের ফোন নম্বর চাইত। আসলে তখন ভারতীয় ফুটবলে তারকা-প্রথা ক্রমশ বিলুপ্তির পথে। কর্পোরেট হাওয়া গায়ে ঝাপটা মারছে। ময়দানে মহাতারকা আর দেখতে পাওয়া যেত না তেমন। চাঁদমারি বদলে দুলালদাও তখন চাইত এমন কিছু করতে, যা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাই মজিদ। তাই তাঁর সাক্ষাৎকার জোগাড়ে নাওয়া-খাওয়া ভুলে দুলালদা’র নেমে পড়া। যা আড়াই বছরের সাধ্যসাধনা শেষে জোটে আরবে, এশিয়ান কাপ করতে গিয়ে। ইংরেজিতে একে কী বলে জানেন? বলে, ‘বুল ডগ টেনাসিটি’! শৈশব আমারও দারুণ কিছু কাটেনি। অভাব-অনটন আমাকেও দেখতে হয়েছে অবাধ। কিন্তু দুলালদার মতো সাফল্যের তাড়না আমার কখনও ছিল না। তাই ওর মতো সাংবাদিকও আমি হতে পারিনি।
জানি, এ লেখা পক্ষপাতদুষ্ট মনে হবে অনেকের। বলা হবে, এক অফিসে পাশাপাশি বসে কাজ করে, তাই লিখতে পারছে না। দুলাল দে-র দোষ দেখতে পাচ্ছে না। আছে তো, দোষ আছে। যেমন আপনার আছে। আমার আছে। আমাদের সবার আছে। কিন্তু দোষের চেয়ে দুলালদার গুণ বেশি আছে। পরিষ্কার লিখছি, ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ দুলালদা আর আমাকে যৌথভাবে যখন ক্রীড়া সম্পাদক করা হয়, একাধিকবার বলেছি, তুমি একক ভাবে হও। কারণ, তুমি অনেক সিনিয়র, এই সম্মান তোমার এককভাবে প্রাপ্য। আমি অনেক ছোট, আমার অনেক সময় পড়ে আছে। আমলই দেয়নি দুলালদা। উল্টে বলেছে, “শোন, ডিপার্টমেন্ট চালানো তোর মজ্জাগত। ওটা তুই-ই চালাবি। তোর গোল প্রয়োজন, আমি তোর হয়ে গোল করে দেব। যা হব, আমরা দু’জনেই হব।”
এর পরেও বলবেন মানুষটা খারাপ? দাগিয়ে দেবেন ‘মাচা’ কিংবা ‘লোটা’ বলে? লোকটার মনুষ্যত্ব দেখেও দেখবেন না? শুধুই খুঁজবেন দোষ? ঠিক আছে, চলুন সাধ মিটিয়ে দিচ্ছি। বলছি খুঁজে-পেতে না হয় একখানা। আমার মতে, দুলালদা যদি দৈনন্দিন নানাবিধ সাত-সতেরোয় না ডুবে একটা কিংবা দুটো বিষয়কে চাঁদমারি করত, আরও উঁচুতে যেত, সাফল্যর নতুন শৃঙ্গ ছুঁত।
দুলালদা ভারি মজার মানুষ। আমি নিশ্চিত, এটুকু লিখলাম বলে দুলালদা একটুও রাগ করবে না!
…পড়ুন খেলাইডোস্কোপ-এর অন্যান্য পর্ব…
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৬: যে দ্রোণাচার্যকে একলব্য আঙুল উপহার দেয়নি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৫: সাধারণের সরণিতে না হাঁটলে অসাধারণ হতে পারতেন না উৎপল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৪: মনোজ তিওয়ারি চিরকালের ‘রংবাজ’, জার্সির হাতা তুলে ঔদ্ধত্যের দাদাগিরিতে বিশ্বাসী
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৩: অনুষ্টুপ ছন্দ বুঝতে আমাদের বড় বেশি সময় লেগে গেল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১২: একটা লোক কেমন অনন্ত বিশ্বাস আর ভালোবাসায় পরিচর্যা করে চলেছেন বঙ্গ ক্রিকেটের
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১১: সম্বরণই বঙ্গ ক্রিকেটের বার্নার্ড শ, সম্বরণই ‘পরশুরাম’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১০: যাঁরা তৈরি করেন মাঠ, মাঠে খেলা হয় যাঁদের জন্য
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৯: খণ্ড-অখণ্ড ভারতবর্ষ মিলিয়েও ক্রিকেটকে সম্মান জানাতে ইডেনতুল্য কোনও গ্যালারি নেই
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৮: ২০২৩-এর আগে আর কোনও ক্রিকেট বিশ্বকাপ এমন ‘রাজনৈতিক’ ছিল না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৭: রোহিত শর্মার শৈশবের বাস্তুভিটে এখনও স্বপ্ন দেখা কমায়নি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৬: বাংলা অভিধানে ‘আবেগ’ শব্দটাকে বদলে স্বচ্ছন্দে ‘বাংলাদেশ’ করে দেওয়া যায়!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৫: ওভালের লাঞ্চরুমে জামাইআদর না থাকলে এদেশে এত অতিথি সৎকার কীসের!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৪: ইডেনের কাছে প্লেয়ার সত্য, ক্রিকেট সত্য, জগৎ মিথ্যা!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৩: এ বাংলায় ডার্বিই পলাশির মাঠ
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২: গ্যালারিতে কাঁটাতার নেই, আছে বন্ধনের ‘হাতকড়া’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১: চাকরি নেই, রোনাল্ডো আছে