রাধাপ্রসাদ গুপ্তর ছবি তোলার জন্য আলাদা করে যে গল্প তৈরি হয়েছিল, তা নয়। এতই ঘন ঘন যাতায়াত হত আলাদা করে প্ল্যান করে ছবি তুলতে হবে, একথা সত্যিই মনে হয়নি। তবে ছবি তুলতে গেলেই আর.পি একটা কথা বলত, ‘ফিল্ম নষ্ট করিস না।’ তখন রোলের দাম যথেষ্টই। আর.পি. সেটা জানতেন বলেই এ কথা বারেবারে বলতেন। ক্যামেরা বের করতে-না-করতেই বকা খেয়েছি, এমনও হয়েছে! ওর ছবি তুলেছিলাম মাত্র দু’-তিনবারই।
২.
স্কুল শেষের দিক। ১৯৮৫-’৮৬ সাল। এগারো-বারো ক্লাস হবে। কলকাতায় জব্বর শীত পড়েছে সেবার। বিকেল নেমেছে, পাখিরা ফিরছে আর কলকাতা আরও একবার জড়িয়ে নিচ্ছে সোয়েটার-শাল-মাফলার। চায়ের জন্য নতুন করে জল চাপাচ্ছে। এমন এক শীতের বিকেল-সন্ধেয় আমি পৌঁছলাম রাধাপ্রসাদ গুপ্তর বাড়ি, ম্যান্ডেভিল গার্ডেনস-এ। না, এমন নয় যে, সেই প্রথম, আগেও বহুবার গিয়েছি আমার সম্বোধনে ওই ‘আর.পি. কাকু’র বাড়ি। ওর বসার জায়গাটা, সিটিং অ্যান্ড ডাইনিং– কোনও রুম নয়, স্পেস– বেশ ছড়ানো-ছিটোনো জায়গা। সেখানে কাদের না দেখেছি! মুলকরাজ আনন্দ থেকে হুসেন– অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই সেই ঘরে হাজির ছিলেন। মুকলরাজ আনন্দ এবং রাধাপ্রসাদ কাকুর প্রায়শই মতদ্বন্দ্ব হতেও দেখেছি। আপনাদের হয়তো মনে পড়বে, তার ‘কলকাতার ফেরিওয়ালার ডাক আর রাস্তার আওয়াজ’-এর মতো হতভম্ব করে দেওয়া বই! আপাদমস্তক খাদ্যরসিক ভদ্রলোকের ‘মাছ ও বাঙালি’, কিংবা ছোট্ট বই ‘স্থান কাল পাত্র’-র কথাও। এছাড়াও পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা প্রসাদ-গুণ সম্পন্ন বহু বহু লেখা। ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড’ পুড়ে যাওয়ার পর, তার স্মৃতির কাছে ঋণী ছিল এই কলকাতা। কারণ যে-সমস্ত ছবি পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছিল, সেইসব ছবির সমস্ত ইতিহাসই টুকে রাখা ছিল তার মাথায়, অবিকল।
যাই হোক। সেই বিশেষ দিনের কথায় আসি। একথা-সেকথায় সময় গড়িয়ে চলেছে। বাইরের আলো আরও মৃদু। একসময় ফস্ করে আর.পি. আমাকে বলে বসল, ‘অ্যাই, তুই কি ড্রিংক করিস?’ আমি খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আমতা আমতা করে বললাম, ‘হ্যাঁ, মানে ওই আর কী…’।
ছোট্ট একটা বার ছিল আর.পি.-র ডাইনিংয়ে। বলল, ‘গেলাস নিয়ে আয়।’ পেগ মেজার বের করল। তারপর সে নিয়ে দু’-এক কথা। পেগ মেজারে কীভাবে কী ঢালতে হবে, সে-ও দেখাল। আমার জন্য ছোট্ট একটা রামের পেগ বানাল অনেকটা জল দিয়ে। নিজের জন্য বড়। সম্ভবত সেই রাম ছিল ‘ওল্ড মঙ্ক’। গপ্পগুজব চলছে, অল্প অল্প করে খাচ্ছিও ওর দেওয়া মদ। এক-আধবার ঘুরে গেলেন কাকিমাও। তার চোখের থেকে আমার হাতের গেলাস নিষ্কৃতি পায়নি। আড্ডাটা সেদিন একটু বেশিই গড়ায়। এতটাই বেশি যে, আমার বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ১০টা ৩০। আজকের সাড়ে ১০টা দিয়ে তখনকার টালিগঞ্জকে চেনা যাবে না। তখন ১০টা বেজে গিয়েছে মানে রাস্তাঘাট ফাঁকা, রীতিমতো অন্ধকার। বাড়ি ফিরতেই, আমাদের কাজের লোক বলল, ‘দাদাবাবু (আমার বাবা, বসন্ত চৌধুরী) আপনাকে খুঁজছিলেন।’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ওর বসার জায়গাটা, সিটিং অ্যান্ড ডাইনিং– কোনও রুম নয়, স্পেস– বেশ ছড়ানো-ছিটোনো জায়গা। সেখানে কাদের না দেখেছি! মুলকরাজ আনন্দ থেকে হুসেন– অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই সেই ঘরে হাজির ছিলেন। মুকলরাজ আনন্দ এবং রাধাপ্রসাদ কাকুর প্রায়শই মতদ্বন্দ্ব হতেও দেখেছি। আপনাদের হয়তো মনে পড়বে, তার ‘কলকাতার ফেরিওয়ালার ডাক আর রাস্তার আওয়াজ’-এর মতো হতভম্ব করে দেওয়া বই! আপাদমস্তক খাদ্যরসিক ভদ্রলোকের ‘মাছ ও বাঙালি’, কিংবা ছোট্ট বই ‘স্থান কাল পাত্র’-র কথাও।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বাবার জন্য আর.পি. বই পাঠিয়েছিল। পরস্পরের জন্য এই কাজ আমি করে দিতাম। বাবা বই পাঠাত, আর.পি.-ও। বাবার প্রথম প্রশ্ন: ‘তোমার এত দেরি হল?’ বলেছিলাম, ‘আমি তো আর.পি. কাকুর কাছে ছিলাম। তোমার জন্য বই দিয়েছে।’ পরের সেকেন্ডেই প্রশ্ন ছিল: ‘রামটা নিশ্চয়ই আর.পি.-র ওখানেই খেলে।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করেনি বাবা। রাতে খেয়ে শুয়েও পড়লাম। পরের দিন সকাল সাতটায় বাবার ঘরে গিয়েছি কাগজ আনতে। বাবার ঠোঁটে একটা হালকা হাসি ঝোলানো। বলল, ‘আর.পি. ফোন করেছিল।’ আমি খুবই অবাক! এত সকালে! সাধারণত সকাল ১০টার পর কল করত আর.পি.। নিদেনপক্ষে ৯টা। ফোন করে জিজ্ঞেস করেছে, ‘বইটা পেয়েছ তো?’
আমি ক’দিন পর ওর বাড়ি গেলাম। গল্পটা পরিষ্কার হল তখন। বই পেয়েছ কি না, এ বলতে মোটেই সাতসকালে সেই ফোন করা নয়। বাবাকে নাকি আর.পি. বলেছিল, ‘তোমার ছেলেটা বড্ড ভালো, কিন্তু ওর বয়সটা ভালো না। সুতরাং, ওকে তো গাইড করতে হবে, আর তুমি মদ্যপানটা করো না, সেই জন্য আমিই দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নিলাম।’
যদিও শুনেছিলাম, আর.পি.-র স্ত্রী– আমার কাকিমা, বেজায় রাগারাগি করেছিল এ ব্যাপারে। বলেছিল, ‘জিৎকে তুমি রাম খাওয়াচ্ছিলে? ও যেদিন জন্মায়, সেদিন হাসপাতালে আমরা দেখতে গেছিলাম, মনে আছে, বসন্ত কি এ ব্যাপারে জানে?’
আর একদিন সকালে ফোন করেছে আর. পি.। বাবা ধরেছিল সেই ফোন। আমাকে ডেকে দিল। ‘আর.পি. চাইছে’। উল্টোদিকের সেই জলদগম্ভীর গলা– ‘কী রে, তোকে দেখতে পাচ্ছি না অনেক দিন!’ আমি বললাম, ‘আজই যাব ভাবছিলাম। ছোট একটা ছবি করছি, সেই নিয়ে খানিক ব্যস্ত।’ বলল, ‘এডিট কোথায় করছিস?’ বললাম, ‘মৌলনা আজাদ কলেজের কাছে। দেখছি, এডিট শেষে ট্রামে করে পার্ক সার্কাসে নেমে, সেখান থেকে কিছু একটা ধরে নেব।’ বলল, ‘বেশ, পার্ক সার্কাসের ওই দোকানটা জানিস তো, সেখান থেকে একটু আনবি?’
আমাকে অনেক আগে আর.পি. একদিন চিনিয়ে দিয়েছিল দোকানটা। পার্ক সার্কাসের গলির ভেতরে একটা দোকান। আমার ও আর.পি.-র কমন দোকান। ফলে বুঝেছি, কোন দোকানের কথা বলা হচ্ছে। আর ‘একটু আনবি’ মানে কী, তাও বিলক্ষণ জানতাম। তা হল ‘বিফ’। টিফিন কৌটো করে নিয়ে গিয়েছি ওর বাড়ি, এমনটা আগেও হয়েছে। সেদিনও, স্বাভাবিকভাবেই, ওর কথামতো চললাম। টিফিন কৌটো বের করে দিতে আর.পি.-র চোখ চকচক করে উঠল। ন্যাপকিন, কাঁটা চামচ দিয়ে একটা টুকরো প্লেটে সাজিয়ে দিয়ে বলল, ‘কাকিমাকে দিয়ে আয়।’ তারপর কী খেয়াল হল, বলল, ‘না। আমিই যাই।’
কাকিমা কথা বলত খুব নিচু গলায়। ভেতরঘরে কথা বললে, শুনতে পাওয়ার কোনও চান্সই নেই আমার। কিন্তু গোটাটাই আন্দাজ করলাম। আর.পি.-র বাজখাঁই গলা: ‘ছেলেটা কাবাব নিয়ে এসেছে, আমি এটা ফেলে দেব তুমি চাও!’ স্পষ্ট বুঝলাম, আর.পি.-র রেড মিট খাওয়া বন্ধের নির্দেশ রয়েছে ডাক্তারের তরফে। তবু, এই ব্যাপারটাকে কোনওভাবে রোখা যাচ্ছে না। কাকিমা যারপরনাই বিরক্ত। কিন্তু মুশকিল হল, স্বয়ং রাধাপ্রসাদ গুপ্তই যে সকালবেলা ফোন করে বিফ কাবাব আনতে বলেছে, সে উল্লেখ তার জবানিতে কোথাও নেই। পুরো দোষটাই গিয়ে পড়েছে আমার ঘাড়ে। এমনকী, মাংসটা ওর নির্দেশমতোই সাধারণের তুলনায় খানিক বেশি পুড়িয়ে আনা।
রাধাপ্রসাদ গুপ্তর ছবি তোলার জন্য আলাদা করে যে গল্প তৈরি হয়েছিল, তা নয়। এতই ঘন ঘন যাতায়াত হত, আলাদা করে প্ল্যান করে ছবি তুলতে হবে, একথা সত্যিই মনে হয়নি। তবে ছবি তুলতে গেলেই আর.পি একটা কথা বলত, ‘ফিল্ম নষ্ট করিস না।’ তখন রোলের দাম যথেষ্টই। আর.পি. সেটা জানত বলেই একথা বারেবারে বলত। ক্যামেরা বের করতে-না-করতেই বকা খেয়েছি, এমনও হয়েছে! ওর ছবি তুলেছিলাম মাত্র দু’-তিনবারই।
তবে বিশ্বাস করুন, এখনও আমার যে কোনও কিছুর দরকার পড়লে; কোনও তথ্য, বই কিংবা ছবি– মনে হয়, গুগল সার্চ ইঞ্জিন আর.পি.-র কাছে নস্যি। যে কোনও ব্যাপারে তথ্যের বিপাকে পড়লেই ওকে মনে পড়ে। কোন ঘরে, কত নম্বর তাকের কততম বই, কততম পাতার কোন অংশটা দেখতে হবে, এরকম করে বলে দেওয়ার লোক আর নেই। আমার তোলা আর.পি.-র কোনও ছবিই ওর ফোটোগ্রাফিক মেমোরিকে পেরিয়ে যেতে পারেনি, রাধাপ্রসাদ গুপ্তর কাছে তাই বারবারই হেরে গিয়েছি আমার ছবি।
(চলবে)
…পড়ুন ফ্রেমকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
প্রথম পর্ব। ঋতুর ভেতর সবসময় একজন শিল্প-নির্দেশক সজাগ ছিল
বিজ্ঞাপনের নিচে ঠিকানার জায়গায় আমাদের দে’জ পাবলিশিং-এর ঠিকানা, ১৩ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট লেখা আছে। যদি খুব ভুল না করি তাহলে এই ‘সম্মিলিত গ্রন্থপঞ্জী’ দু-বার মাত্র প্রকাশিত হয়েছিল। ‘সম্মিলিত গ্রন্থপঞ্জী’ সংকলন ও ছাপার ভার ছিল বামাদার ওপর।
ধৈর্যের একেবারে চূড়ান্ত সীমায় এসে কবির মনে হয়েছে, ‘ছবিগুলি বুবা লুকিয়ে রেখেছে এই সন্দেহ বরাবর আমার মনে আছে। সে আমার মৃত্যুর অপেক্ষা করবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। তারও বছর তিনেক বাদে কিশোরীমোহনের প্রবল পরিশ্রমে ১৯৪০-এর পুজোর মুখে সেই ছবির অ্যালবাম ‘চিত্রলিপি’ প্রকাশ পেয়েছে।