প্রখরভাবে মার্কসবাদী বিশ্বাসের সঙ্গে গভীর বৌদ্ধিক উপলব্ধির এক অত্যাশ্চর্য মিশেল কুমার সাহানি। তাঁর ছবিতে নারীরা স্বাধীন, পুরুষেরা পেলব। এবং প্রতিটি ইমেজ নিভৃত, অন্তর্মুখী ও অন্দরমহলের রহস্যে মোড়া। কুমারের কাহিনিগুলিতে শ্রেণিচেতনা ও সাম্যবাদের ধারণা মুখস্থ বুলির মতো আসে না। বরং এক গাঢ় বোধ পর্যালোচনার জন্ম দিয়ে বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করায়।
দ্বিধায় দীর্ণ তরুণীটির পায়ের পাতা সংকুচিত হয়। পুরুষতান্ত্রিক পরিবারের আর্কিটাইপ পিতা তাকে আজন্ম-লালিত ঘেরাটোপে বড় করেছেন। সেই ঘেরাটোপকে অগ্রাহ্য করার ক্ষণ মুহূর্ত আগে, তরুণীটি পায়ের পাতা সংকুচিত করে শাড়ির নীচে লুকিয়ে ফেলে। কুমার সাহানির ক্যামেরা দেখে, শাড়ির রং লাল; আর সে শাড়ির জমিতে সাদা রঙের আলপনা আঁকা। তরুণীর পায়ের নীচে কার্পেট। সে কার্পেটও লাল, অথচ সে রঙের প্রকৃতি অন্য। কারণ রঙেরও রকমফের হয়। লাল ও সাদার সহাবস্থান যে রূপে লালকে প্রকাশ করে, অন্য রঙের উপস্থিতি অনিবার্যভাবে লালের স্বরূপ পালটে দেয়।
এ দর্শন শুধু রং নয়, পারিপার্শ্বিক প্রতিটি ব্যক্তি ও বস্তুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কুমার সাহানির সিনেমা, এ দর্শনকে মান্যতা দেয় ও প্রতিটি ইমেজে ফুটিয়ে তোলে। তাঁর ছবিগুলিতে যা কিছু দৃশ্য ও যেটুকু শ্রাব্য, সবই জীবন্ত, অস্তিত্বময় ও অসীম যত্নের সঙ্গে পরিকল্পিত।
প্রখরভাবে মার্কসবাদী বিশ্বাসের সঙ্গে গভীর বৌদ্ধিক উপলব্ধির এক অত্যাশ্চর্য মিশেল কুমার সাহানি। তাঁর ছবিতে নারীরা স্বাধীন, পুরুষেরা পেলব। এবং প্রতিটি ইমেজ নিভৃত, অন্তর্মুখী ও অন্দরমহলের রহস্যে মোড়া। কুমারের কাহিনিগুলিতে শ্রেণিচেতনা ও সাম্যবাদের ধারণা মুখস্থ বুলির মতো আসে না। বরং এক গাঢ় বোধ পর্যালোচনার জন্ম দিয়ে বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করায়। পরিচয় ঘটায় চরিত্রদের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের সঙ্গে। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয় ফ্যাসিবাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও কঠোর সমালোচনা। কিন্তু যাঁরা কুমারকে চেনেন, তাঁরা জানেন, সে ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ কতটা মার্জিত, কতটা মননশীল। কুমারের আশ্চর্য বৌদ্ধিক সহিষ্ণুতা তাঁকে এ-ব্যাপারে সক্ষম করেছে।
বৌদ্ধ দর্শন বলে, একটি গাছের পাতাগুলিকে দূর থেকে একরকম লাগলেও, কাছ থেকে তারা প্রত্যেকে পৃথক। আবার একটি পাতার প্রতিটি রেখা একে অপরের থেকে, কণামাত্র হলেও, ভিন্ন। তাই কোনও শিল্পী যদি সেই গাছের একটি প্রতিমূর্তি বানান, বা চিত্রাঙ্কন করেন, তাঁকে প্রতিটি পাতার প্রতিটি রেখার প্রতি যত্নশীল হতে হবে; যাতে তারা একে অপরের নিছক অনুকরণ না হয়ে ওঠে। নিজের ছবিতে শট ডিজাইনের সময়, কুমার এই দর্শন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। তাঁর প্রতিটি ইমেজ (এক দৃশ্যের হোক, বা অন্য) একে অপরের থেকে আলাদা, এবং কোনও ইমেজই অপ্রয়োজনীয় নয়। অর্থাৎ যদি কোনও একটি ইমেজ গোটা ছবি থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়, হয় ছবিটির সামগ্রিক অর্থ বদলে যাবে, অথবা থেকে যাবে অসম্পূর্ণ। আর এজন্যই কুমারের ছবি দর্শকের অখণ্ড মনোযোগ দাবি করে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
দেশে ও বিদেশে বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে কুমার সিনেমা নিয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের বলতেন, কোনও সিনেমা বুঝতে হবে, প্রত্যাশার এই চাপ নিয়ে কখনও সিনেমা দেখো না। এমনকী, সর্বদা এটাও ভেবো না যে, কোনও সিনেমা বা সেই সিনেমার কোনও দৃশ্যের মানে তৎক্ষণাৎ অবগত হবে! বরং সময় দাও। অনুভব করার চেষ্টা করো। সবসময় মানে বোঝার পিছনে ছুটলে, অনেক ক্ষুদ্র বিস্ময়, অনেক আশ্চর্য খুঁটিনাটি, অজানা থেকে যাবে। এই ধী ও দর্শন, আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বিপরীত। এ যেন কবিতা পড়ার মতো করে সিনেমা পড়তে বলছেন কুমার।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আমাদের ক্রমাগত ছুটে চলা জীবনের লয়ে কুমারের ইমেজ স্থিতির জন্ম দেয়। তাঁর ক্যামেরা একটি স্থানকে আর্কাইভ করে ঐতিহাসিকের চোখে। কারণ যে কোনও স্থান, সেই স্থানে বসবাসকারী চরিত্রদের মনস্তত্ত্বে ছাপ ফেলতে থাকে। একটি বাড়ি বছরের পর বছর যে চিহ্নগুলি ধরে রাখে তার দেওয়ালে, দরজায় বা চৌকাঠে; একটি খাদান যেভাবে সময়ের প্রতীক রেখে যায় তার প্রতিটি পাথরে; তা সংলাপ তৈরি করে অতীতের সঙ্গে, এবং অতি অবশ্যই হয়ে ওঠে বর্তমানকে বোঝার পাথেয়। এ শিক্ষা কুমারের অন্যতম গুরু ঐতিহাসিক ও গণিতজ্ঞ ডি. ডি. কোশাম্বীর কাছ থেকে পাওয়া। আবার কুমারের আরেক গুরু ঋত্বিক ঘটক শেখান, একজন শিল্পীর দায়বদ্ধতাগুলি। প্রতিটি ইমেজের অসীম গুরুত্বকে উপলব্ধি করার শুরুও ওঁর হাত ধরেই। সঙ্গে জীবনবোধে প্রোথিত হয়ে যায় নিজের কাল ও পারিপার্শ্বিককে সর্বদা গুরুত্ব দেওয়ার প্রেরণা। ‘পুণে ফিল্ম ইন্সটিটিউট’-এ পড়ানোর সময়, ঋত্বিক শিখিয়েছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের সভ্যতাকে বুঝতে, আদিবাসী জীবনযাত্রার গুরুত্ব কী অপরিসীম! কুমারের ছবিও সে কথাই বলে।
কুমার বিশ্বাস করতেন, সিনেমা বানানো ও সিনেমা নিয়ে চর্চা– সমাজের অন্যান্য জীবিকার মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত সিনেমা, বা চারুকলার অন্য যেকোনও শাশ্বত রূপ একজন মনোযোগী দর্শক বা শ্রোতার উত্তরণ ঘটায়। সিনেমার কোনও শিক্ষার্থীর তোলা ছবি দেখে তিনি প্রশ্ন করতেন, এই ছবিটি নির্মাণের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাত্রা করে, তোমার মধ্যে কি পরিবর্তন এসেছে? কী গভীর অথচ সরল এই জানতে চাওয়া! যখন সবাই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাতে ব্যস্ত, তখন এই প্রশ্ন, আমাদের শিল্পভাবনার মূল শিকড়কে নাড়িয়ে দেয়। সিনেমা নির্মাণের যাবতীয় বাহ্যিক, বাণিজ্যিক ও আত্মকেন্দ্রিকতার বাইরে দাঁড়িয়ে এই জিজ্ঞাসা, আত্মানুসন্ধানের পরিপূরক হয়ে ওঠে। আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্রেফ আর্থিক প্রতিপত্তি লাভের উপায় হিসেবে চারুকলার জন্ম হয়নি। বরং চারুকলা আমাদের মধ্যে গতির জন্ম দেয়। সেইসঙ্গে, সামাজিক ও পারিবারিক শ্যাওলার স্তরকে নির্মূল করার পথও দেখায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: সিনেমায় ‘এক্সট্রা’ ডাকটা বদলে হল ‘জুনিয়ার আর্টিস্ট’, কিন্তু ওদের প্রতি আচরণটা বদলাল না
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
দেশে ও বিদেশে বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে কুমার সিনেমা নিয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের বলতেন, কোনও সিনেমা বুঝতে হবে, প্রত্যাশার এই চাপ নিয়ে কখনও সিনেমা দেখো না। এমনকী, সর্বদা এটাও ভেবো না যে, কোনও সিনেমা বা সেই সিনেমার কোনও দৃশ্যের মানে তৎক্ষণাৎ অবগত হবে! বরং সময় দাও। অনুভব করার চেষ্টা করো। সবসময় মানে বোঝার পিছনে ছুটলে, অনেক ক্ষুদ্র বিস্ময়, অনেক আশ্চর্য খুঁটিনাটি, অজানা থেকে যাবে। এই ধী ও দর্শন, আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বিপরীত। এ যেন কবিতা পড়ার মতো করে সিনেমা পড়তে বলছেন কুমার। কবিতায় যেমন প্রতিটি অক্ষরের আলাদা ওজন থাকে, সিনেমাতেও তো প্রতিটি ফ্রেম গভীরতার সাক্ষর বহন করে। কুমার, কবিতার মতো গহীন রহস্য বুনে দেন নিজের চিত্রভাবনায়।
ঔপনিবেশিক প্রভাবমুক্ত এই ভাবনার ফসল কুমারের শট ডিজাইনের প্রতিটি ফ্রেম, যা ভীষণভাবে ভারতীয়– রঙের ব্যবহারে, ক্যামেরার চলনে, চিত্রকলার অনুরণনে, পৌরাণিক বা লোককথার অনুপ্রবেশে এবং ধ্বনি পরিকল্পনায়। ছবিগুলিতে শটের কম্পোজিশন ভারতের বিভিন্ন চিত্রশৈলীকে যেমন মনে পড়ায়, তেমনিই কিছু বিশেষ রঙের ব্যবহার, ও একটি রঙের সঙ্গে আরেকটি রঙের প্রয়োগ সেই উদাহরণকে চিরস্থায়ী করে তোলে। এই ছবিগুলির চলন যেন ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের স্মারক। ধীর লয়, স্থির গতি, ও ক্রমাগত ইম্প্রোভাইজেশনের মধ্যে দিয়ে অন্তিমে উপনীত হওয়া। এরসঙ্গে, কথকতার যে ধারা ভারতীয় সংস্কৃতিতে চির প্রবহমান, সে ধারা সিনেমার আঙ্গিকে আনার অনন্য নিদর্শন কুমারের ছবিগুলি। যা বক্তব্যের দিক থেকে মনস্তাত্ত্বিক, দ্বান্দ্বিক ও আপোসহীন।
এই শিরদাঁড়া সোজা রাখা, আপোসহীন থাকা কুমারের মজ্জাগত ছিল। আর ছিল শিশুর মতো অনুসন্ধিৎসা। সিনেমার বাইরে অন্যান্য নানা বিষয়ে তাঁর কৌতূহল ছিল শিক্ষার্থীদের মতো। সেই কৌতূহল তাঁকে সন্ধান দিয়েছিল অফুরন্ত জ্ঞান ও বীক্ষার। এবং এই বীক্ষা তিনি কুক্ষিগত করে রাখেননি। বরং বিনিসুতোয় বুনে দিয়েছেন তাঁর শিষ্যদের মধ্যে। যেভাবে শাড়ির পাড় বোনেন তন্তুকার, যেভাবে ফসল বোনেন কোনও কৃষক। যেভাবে ঘামের ছাপ বোনা থাকে কলকারখানার দেওয়ালে দেওয়ালে।
যে উন্মত্ত জনতার ঢেউ রবীন্দ্রনাথকে প্রয়াণের পর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সেই ঢেউ হয়ে ওঠা জনতার অন্তর্গত মানুষগুলি কি জানতেন, তাঁদের এই মানুষটির প্রতি বিশ্বের মানুষের গভীর শ্রদ্ধার কথা! কয়েক মাস পড়ে, এই সংখ্যাটি কি হাতে নিয়ে দেখেছিলেন ভিড়ের মানুষেরা?