ইন্টারনেটের বহু যুগ আগেকার কথা। ওই যে বললাম, দোকানের গায়ে সাঁটা একটা পোস্টার, সেটাই প্রধান, এবং বহু ক্ষেত্রে একমাত্র রেফারেন্স। ওই দেখেই বাঙালি বাকিটা ছকে নিয়েছে– এবং খুব যে ভুল ছকেছে, তাও নয়। অতএব শুরু হয়ে গেল শ্মশান থেকে ভাসান ‘চিটঠি আয়ি হ্যায়’। আসছে বছর আবার হবের যে তাল, খাটিয়া কাঁধে পায়েও সেই দুলকি চাল, কারণ পিছনে ‘চিটঠি’ বাজছে। খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে শুনছি নদী, সিনেমা হল পেরিয়ে বিহারিদের সন্তোষি মা মন্দিরে ‘চিটঠি’ বাজছে।
ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি, স্কুলে ঢোকামাত্র সমীর বললে ‘গ্রামে থাকিস, কোনও খোঁজই পাস না, এদিকে ভয়ানক কাণ্ড ঘটে গেছে!’ সে সময় আমাদের বাগডোগরা নামক ‘গ্রাম’ আর ‘শহর’ শিলিগুড়ির মধ্যে খুব বেশি গুণগত তফাত ছিল বলে এখন মনে না হলেও, দোকানপাট, লোকজন আর গাড়িঘোড়ার সংখ্যা উত্তরবঙ্গের বাণিজ্যিক কেন্দ্রটিতে অন্যান্য মফস্সলের তুলনায় সবসময়ই বহুগুণ বললে অতিশয়োক্তির আশঙ্কা নেই। হয়তো সেই কারণেই ওদের বাড়ির গায়ে বেশ ছোটখাটো ক্যাসেটের দোকানেও পঙ্কজ উদাস নামক এক গায়কের পোস্টার এবং ‘চিটঠি আয়ি হ্যায়’ গানে এলাকার মানুষ মুগ্ধ– এবং প্রথম দিনেই বিক্রির সংখ্যাটি চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মতো। আমার শৈশব-কৈশোরে সিনেমা, বাংলা-হিন্দি গান, মিঠুনের চাইতে বচ্চন কেন বেটার এবং কোন কোন নায়িকাকে বিয়ে করতে না পারলে জীবন বৃথা– ইত্যাদি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত সমীরের ওপর ছেড়ে রেখেছিলাম। অতএব ঠোঁটের বিড়ি অনায়াসে এদিক থেকে ওদিক শিফ্ট করানো, মদের বোতল হাতে বাবাকে জীবন সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া, বা জিপগাড়ি চালাতে চালাতে টয় ট্রেনের সুন্দরীদের উদ্দেশে গান গাওয়ার একটা প্যাটার্ন মাথায় তৈরি হয়েই ছিল। সমীর ঝপাঝপ তিন-চারটে মাল্টিকালার্ড পাঞ্জাবি বানিয়ে ফেলায় ধাঁচাটা পোক্ত হল এই যা।
উপরোক্ত তথ্যগুলি এমনি খামখেয়ালবশত দেওয়া ভাববেন না। খুব অল্প দিনের মধ্যে দেখলাম পরিচিত অপরিচিতরা দুর্গাপুজোর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে পাড়ার ছোট জলসা বা এমনকী, বাড়িতে ‘মেয়ে’ দেখার সময়ও হারমোনিয়াম সোজাসুজি সামনে ধরে বসে গাইছে না। হারমোনিয়ামটা ডানদিকে অথবা বাঁদিকে– অর্থাৎ কিনা সোজা বাংলায় যেখানে বসেছে তার কোনও এক পাশে রাখা, এবং গায়ক বা গায়িকা হাত-পা বেঁকিয়ে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে। যারা যত এক্সপার্ট, তাদের হারমোনিয়াম তত পিছন দিকে। হারমোনিয়ামের দিকে পিছন ফিরে যারা গাইছে, তাদের প্রতি জলসায় এক্সট্রা কদর, বেশি পারিশ্রমিক, পাজামা-পাঞ্জাবির জেল্লাও ততোধিক। ব্যাপারটা কনটরশনিস্ট বা গাটাপার্চার কেরামতির পর্যায়ে পৌঁছল এবং প্রাচীন মাস্টারমশাইরাও তালিম দেওয়ার সময় ওই বিষয়টির প্রতি নজর না দিলে বাপ-মায়েরা ভুরু কোঁচকাতে লাগলেন। এ বিষয়টি নিশ্চয়ই বিস্তারিত বলতে হবে না যে, তদ্দিনে গায়ক সমাজের মধ্যে ‘উদাস কাট’ চুলের স্টাইল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। একটু ঢেউ খেলানো, একটু ফাঁপানো, একটু লক্কর ছক্কর জামাইবাবু টাইপ, যাদের দেখলেই মনে হয় টিউশনি পড়াতে গিয়ে লেড়ো বিস্কুট আর পানসে চা ছাড়া কিছু জোটে না।
মনে রাখতে হবে, সেটা ইন্টারনেটের বহু যুগ আগেকার কথা। ওই যে বললাম, দোকানের গায়ে সাঁটা একটা পোস্টার, সেটাই প্রধান, এবং বহু ক্ষেত্রে একমাত্র রেফারেন্স। ওই দেখেই বাঙালি বাকিটা ছকে নিয়েছে– এবং খুব যে ভুল ছকেছে, তাও নয়। অতএব শুরু হয়ে গেল শ্মশান থেকে ভাসান ‘চিটঠি আয়ি হ্যায়’। আসছে বছর আবার হবের যে তাল, খাটিয়া কাঁধে পায়েও সেই দুলকি চাল, কারণ পিছনে ‘চিটঠি’ বাজছে। খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে শুনছি নদী, সিনেমা হল পেরিয়ে বিহারিদের সন্তোষী মা মন্দিরে ‘চিটঠি’ বাজছে। গভীর রাতে খাওয়াদাওয়ার পর বাড়ির সামনে রাস্তায় দল বেঁধে হাঁটার সময় বোস জেঠুর বিএ পাস ভাগনেকে কেউ না কেউ একবার গানটা গাইতে বলবেই– বেচারা সুমিদির প্রেমে তদ্দিনে হাবুডুবু, তাই ঘুমোতে যাওয়ার সময়ও মাথার ভিতর দমাদ্দম ‘চিটঠি’র ওপর স্ট্যাম্প পড়ছে। স্কুলে হিন্দি নাটকের ছেলেরা সেবার ওই নামে একটা নাটক করল।
এরই মাঝে অদ্ভুত কাণ্ড! এয়ারফোর্সের কোনও একটা বিশেষ কমেমোরেশনের দিনে প্রতি বছরই প্যারেড, বাচ্চাদের স্পোর্টস, ঘোড়দৌড় এবং পেগিং ইত্যাদি হত। গোড়ায় সকাল থেকে আর্মি ব্যান্ড মাঠের পাশে বাস্কেটবল কোর্টে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাগপাইপে নানা সুর বাজাত। ব্যাপারটা যে একেবারেই ইংরেজদের ফেলে যাওয়া জামা কেচে পরার অভ্যাস, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ-ই নেই এবং তাদের ঐতিহ্য সম্পর্কিত গোঁড়ামি ছিল সাহেবদেরও এক কাঠি ওপরে– নইলে হাড্ডি চেবানো প্রভুভক্তি দেখাবেই বা কী করে! সেই থেকে আমার ওই বাদ্যযন্ত্রটির প্রতি অপরিসীম ঘৃণার শুরুয়াত, তবে এখানে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। মনে আছে, ওই বছর তারা সমস্ত বিদেশি সুরের সঙ্গে ‘চিটঠি আয়ি হ্যায়’ বাজিয়ে তাক লাগিয়ে দেয়! এত বড় দুর্ঘটনা ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাসে আর ঘটেছে কি?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
বাংলায় তাপস পাল জমানা চলছে, অর্থাৎ যে যা পারে করে খাচ্ছে– তাপস বাঙালির আন্ডারবেলি ভাবতেই যারা শিউরে উঠছে, তাদের জন্য এ লেখা নয়, তবে বুকে বল এনে আলগোছে গায়ক এবং নায়কের চুলের ছাঁটের দিকে নজর ফেরান, দেখবেন অত্যাশ্চর্য মিল! যাই হোক। সব গান একরকম হওয়ায় শ্রোতাকে কখনওই কোনও গানের সুর বা কথা নিয়ে আলাদা করে ভাবতে হয়নি। উদাস নিজে কি কখনও গানের কথা বেছে নেওয়ার কথা ভেবেছিল? মনে হয় না। মহেশ ভাট কি উদাসকে বেছে নেওয়ার সময় বাড়তি ভেবেছিলেন? নাকি ’৮৬-তে সেসব ভাবনার অবকাশ বা দরকারই ছিল না! জনগণ তদ্দিনে ‘যা খাওয়াবে তাই খাব’ গেছের নিশ্চেতন জড় পদার্থে পরিণত হয়েছে, তা নিশ্চয়ই বোম্বাইয়েই ধুরন্ধর পরিচালকটির অজানা নয়!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
পাশাপাশি আরও একটি কথা বলা দরকার। ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে তাসা পার্টি এবং চড়বড়ি ব্যান্ড অন্য কোনও ‘গজোলের’ সঙ্গে এত সাকসেসফুলি বাজিয়ে উঠতে পেরেছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। তার একটা প্রধান কারণ উদাস সব গান একভাবে গেয়েছেন। ফলে, প্রথমে তাসা পার্টি ঢিংকাচিকা শুরু করে তারপর উদাসের যে কোনও গান চালিয়ে দিলেই হল, খাপে খাপ মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা একশোয় নব্বই।
প্রশ্নটা ‘স্লো’ অথবা ‘ফাস্ট’ গান নিয়ে নয়। সদ্য মাধ্যমিক দেওয়ার পর সমীর একদিন ঢুলুঢুলু চোখে হাজির। তখন বাংলায় তাপস পাল জমানা চলছে, অর্থাৎ যে যা পারে করে খাচ্ছে– তাপস বাঙালির আন্ডারবেলি ভাবতেই যারা শিউরে উঠছে, তাদের জন্য এ লেখা নয়, তবে বুকে বল এনে আলগোছে গায়ক এবং নায়কের চুলের ছাঁটের দিকে নজর ফেরান, দেখবেন অত্যাশ্চর্য মিল! যাই হোক। সব গান একরকম হওয়ায় শ্রোতাকে কখনওই কোনও গানের সুর বা কথা নিয়ে আলাদা করে ভাবতে হয়নি। উদাস নিজে কি কখনও গানের কথা বেছে নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন? মনে হয় না। মহেশ ভাট কি উদাসকে বেছে নেওয়ার সময় বাড়তি ভেবেছিলেন? নাকি ’৮৬-তে সেসব ভাবনার অবকাশ বা দরকারই ছিল না! জনগণ তদ্দিনে ‘যা খাওয়াবে তাই খাব’ গোছের নিশ্চেতন জড় পদার্থে পরিণত হয়েছে, তা নিশ্চয়ই বোম্বাইয়েই ধুরন্ধর পরিচালকটির অজানা নয়!
উদাসের ট্র্যাক রেকর্ড বাঙালির হাতে এল আরও কিছুদিন পর। অর্থাৎ, অ্যালবার্ট হল, হাজার হাজার গান ইত্যাদির খোঁজ বাজারে রিলিজ হওয়া মাত্র বাঙালি রাখতে চায়নি বলেই আমার ধারণা। পুজোর গান এবং প্রায় সব বড় মাপের আধুনিক গায়ক-সুরকারদের স্বর্ণযুগ সবে শেষ হওয়ার পর বাঙালি সবে ধুঁকতে শুরু করেছে, হিন্দি গানের বাড়তি ধাক্কা তার পক্ষে সামলানো হয়তো বেশ কঠিন হত বাছাই প্রক্রিয়ার প্রতি নজর না দিলে। ওই যে বললাম, সেটা ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রিত জমানার বহু আগেকার কোনও একটা সময়– অতএব যারা বিদেশে ইকবাল বানো বা ফরিদা খানমের গলায় ফয়েজ শুনেছে, তাদের পক্ষে এই ঘরানাটিকে একেবারে নস্যাৎ করা সহজ ছিল। তাদের নাগালে এমন প্রচুর রেকর্ডিং ছিল, যা আমরা হাতে পেয়েছি আরও বছর দশেক পরে। যারা সকাল-বিকেল মালিকা-এ-তরন্নুমের রসে হাবুডুবু খাচ্ছে– তখনও এরকম কিছু পাবলিক চারপাশে ঘোরাফেরা করত, এবং যাকে বলে ‘থ্যাঙ্ক গড ফর স্মল মার্সিজ’– তাদের সামলানোই ছিল বেশি মুশকিল। তারা উদাসের গান শোনে আর কোমাচ্ছন্ন হয়ে পরে। ‘চিটঠি আয়ি হ্যায়’ ব্যাপারটিকে রেটরিকালি নিতে হবে কি না বুঝতে পারিনি বেশ কিছুকাল।
সে যন্ত্রণা বাঙালি শেষ পর্যন্ত কাটিয়ে উঠেছে। গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের দেশ। হাত তুলে দিয়েছে চিল্লামিল্লি শুনে। মাঝে আরও একজন এসেছিলেন– নাকি ইনিই, খেয়াল নেই, গোটা জাতি সজারুর কামড় খেয়ে তদ্দিনে বাহ্যজ্ঞানশূন্য– গান গাইছে না দম আটকে ডুবুরির পরীক্ষা দিচ্ছে– বোঝা মুশকিল। তবে তার মধ্যেও পঙ্কজ উদাস মারা গেলেন, সেটাই আসল।
১৯৩৭ সালে পিল কমিশন প্যালেস্তাইনে ধর্মের ভিত্তিতে ভূখণ্ড ভাগের প্রস্তাব দেয়। এটাও ভারতের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে গান্ধীজির পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল। কারণ এদেশেও তখন ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ অর্থাৎ ‘টু নেশন’ তত্ত্ব ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে।