রাধা যখন রেগে উঠে জানান যে যৌনতা এবং ঝগড়ার সময়ে তিনি কৃষ্ণের সমান থাকতে চান সবসময়, আমরা বুঝতে পারি রাধার রাগ আসলে অবদমিত নারীর মৌলিক আকাঙ্ক্ষা। দ্বিতীয় পর্বের রাধার রাগ তৃতীয় পর্বে সুতীব্র হতাশা ও উন্মাদনার প্রান্তে এসে পৌঁছায়। ইলার কৃষ্ণের কাছে রাধাকে ত্যাগ করার অনুরোধ এবং কৃষ্ণের আপাতভাবে তাতে সায় দেওয়া রাধাকে শুধুমাত্র ‘নারী’ হিসেবে বিধ্বস্ত করে না, আঘাত করে তার ‘শিক্ষক’ সত্তায়। রাধা হয়ে ওঠেন সেই ব্যক্তি যিনি নিজের অর্জিত গুণাবলি ব্যবহার করে নিজের অধিকার ছিনিয়ে আনতে চান।
বিশেষণ যদি হয় ‘রাগী’ তাহলে বিশেষ্য অবশ্যই পুরুষ। অ্যাংরি উওম্যানকে আমাদের অবচেতন অত চেনে না, যতটা চেনে অ্যাংরি ম্যানকে । রাগী বা ভোগী– দুইয়ের একটাও হওয়ার যেন অধিকার নেই নারীর।মহাকাব্যেও নারীর রাগকে সার্বিক ধ্বংসের কারণ হিসেবে জেনেছি আমরা। দ্রৌপদীর ক্রোধের আগুনে জ্বলে পুড়ে গিয়েছে গোটা কুরু বংশ। কিন্তু সেখানেও দ্রৌপদীর রাগের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম হয়েছেন ভীম। পুরুষের রাগ যতটা উদযাপিত হয়েছে ভারতীয় ধ্রুপদী সাহিত্যে, নারীর রাগ সেই তুলনায় প্রায় কোনও জায়গা পায়নি। প্রেমের প্রতিরূপ কৃষ্ণকেও আমরা রাগ উদযাপন করতে দেখি বিবিধভাবে। অথচ রাধাকে সবসময়ই প্রেমে নতজানু, কিংবা নির্মোহী এক নারী হিসেবে লিখে গেছেন কৃষ্ণ সাধক-সাধিকারা। এই প্রেক্ষিত থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর এক তেলুগুভাষী ‘অবর্ণ’ কবি নারীর রাগ এবং সেই রাগজাত যৌনতাকে কেন্দ্রে রেখে একটি মহাকাব্য লেখেন। মহাকাব্যটির নাম ‘রাধিকা সান্ত্বনম’ এবং কবি একজন অতীব রাগী মহিলা, নাম মুদ্দুপলানি।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………মানুষ হিসেবে মুদ্দুপলানি পিতৃতান্ত্রিক সংজ্ঞা মেনে ‘নম্র’, ‘ভদ্র’, ‘সুশীলা’ ছিলেন না; বরং ঠোঁটকাটা এবং বদমেজাজি হিসাবে কুখ্যাতি ছিল তাঁর। অন্যান্য গণিকাদের মতো শুধু কাব্যরস শিখে, সেটাকে কলা হিসেবে ব্যবহার করেননি; বরং মুখে মুখে তর্কে জড়িয়েছেন মারাঠি সংস্কৃতজ্ঞদের সঙ্গে। সংস্কৃত কবিদের সঙ্গে একাসনে তেলেগু কবিদের বসিয়ে বিরাগভাজন হয়েছেন সমালোচকদের কাছে। মুদ্দুপলানীর সংস্কৃত কাব্যশাস্ত্রের প্রতি এই রাগকে আমরা আজকের প্রেক্ষিতে দেখলে অবশ্যই দলিত নন্দনতত্ত্বের ঐতিহাসিক যোগসূত্র হিসেবে দেখতে পারি।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মুদ্দুপলানি (১৭৩৯– ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ ) তাঞ্জোরের সম্রাট প্রতাপসিংহের রাজসভার একজন খ্যাতনামা গণিকা। তাঞ্জোরের নাগবর্ষমে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মুদ্দুপলানি। তার দিদিমা তঞ্জানয়কী ছিলেন খ্যাতনামা গণিকা যার সংগীত ও কাব্যের নবরসের দক্ষতার সুখ্যাতি ব্যাপ্ত ছিল সমগ্র দাক্ষিণাত্যে। মুদ্দুপলানির সময়ের তাঞ্জোরের রাজনৈতিক অবস্থা খেয়াল করলে মুদ্দুপলানির ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও প্রকাশভঙ্গীর প্রেক্ষিত বুঝতে সুবিধা হয়। ১৭৩০ থেকে ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ অবধি প্রতাপসিংহের শাসনকালের তাঞ্জোর এক বহুজাতিক, বহুসাংস্কৃতিক এবং প্রাক-ঔপনিবেশিক ও সদ্য-ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের এক মোহনা বিশেষ। শাসক মারাঠি, প্রশাসনের ভাষা তেলুগু, বিশাল সংখ্যক তামিল ভাষা ও সংস্কৃতির সাধারণ মানুষের বাস, ফরাসি ও ইংরেজরা নিজের বাণিজ্যের বিস্তারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে তাঞ্জোরে নিজ-নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি বিস্তার করতে চাইছে। সম্রাট প্রতাপসিংহ নিজে রাজা তুকোজী ভোঁসলে ও অন্নপূর্ণা নামের এক গণিকার ‘অবৈধ’ সন্তান । এর ফলে ‘বংশ আভিজাত্য’ থেকেও ‘ব্যক্তির নিজস্বতা’ মুদ্দুপলানির সময়ের তাঞ্জোরে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এর সুফল অবশ্যই পেয়েছিলেন মুদ্দুপলানী। সাবর্ণ নারী না হয়েও ভারতীয় নৃত্য, সংগীত এবং কাব্যকলার পাশাপাশি ইউরোপীয় সংগীত ঘরানার ভায়োলিন মুদ্দুপলানি শিখেছিলেন নিজেকে ‘ব্যক্তি’ হিসেবে বাকি গণিকাদের চেয়ে পৃথক দেখানোর জন্যই। নিজের অর্জিত এই দক্ষতার জোরে দাক্ষিণাত্যের পুরোটা জুড়ে তার কদর অনেক বেড়ে যায়। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য সামন্ততান্ত্রিকতা থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠায় তাঞ্জোরে ব্যক্তি ভিত্তিক আয়করের প্রচলন করেন প্রতাপসিংহ । মুদ্দুপলানির ভায়োলিন কনসার্ট তার ব্যক্তিগত আয় অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়। এবং তিনি তাঞ্জোরের প্রথম ব্যক্তি যাঁর বংশানুক্রমিক কোনও জমি না থাকা সত্ত্বেও আয়কর দেন। নথিভুক্তভাবে তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি কোনও স্টেটকে আয়কর দিয়েছিলেন।
দু’টি বিষয় লক্ষ্য করার মতো। মানুষ হিসেবে মুদ্দুপলানি পিতৃতান্ত্রিক সংজ্ঞা মেনে ‘নম্র’, ‘ভদ্র’, ‘সুশীলা’ ছিলেন না; বরং ঠোঁটকাটা এবং বদমেজাজি হিসাবে কুখ্যাতি ছিল তাঁর। অন্যান্য গণিকাদের মতো শুধু কাব্যরস শিখে, সেটাকে কলা হিসেবে ব্যবহার করেননি; বরং মুখে মুখে তর্কে জড়িয়েছেন মারাঠি সংস্কৃতজ্ঞদের সঙ্গে। সংস্কৃত কবিদের সঙ্গে একাসনে তেলেগু কবিদের বসিয়ে বিরাগভাজন হয়েছেন সমালোচকদের কাছে। মুদ্দুপলানীর সংস্কৃত কাব্যশাস্ত্রের প্রতি এই রাগকে আমরা আজকের প্রেক্ষিতে দেখলে অবশ্যই দলিত নন্দনতত্ত্বের ঐতিহাসিক যোগসূত্র হিসেবে দেখতে পারি। মারাঠি দলিত তাত্ত্বিক যদুনাথ থাট্টে দলিত নন্দনতত্ত্বকে সংস্কৃতের ‘নবম রস’ পরিসরের বাইরে গিয়ে ‘দশম ও একাদশ’ রসের পরিসরে প্রবেশ করতে বলেছেন। যে পরিসরের অন্যতম রস হল রাগ। এই রাগ কিন্তু ‘বীররস’ জাত নয়। এই রাগ ব্যক্তিগত পরিসরের রাগ, যা ব্যক্তির বঞ্চনা থেকে জন্ম নেয়। অবর্ণ নারী মুদ্দুপলানী সংস্কৃত পণ্ডিতদের কড়কানিতে চুপ করে যাননি। তিনি রেগেছেন এবং নিজের মনন ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করার জন্য বেছে নিয়েছেন কৃষ্ণ ও রাধার চিরায়ত আখ্যানকে। নিজের মতো করে এই আখ্যানকে বিনির্মাণ করে নতুন কাব্য রচনা করেছেন তেলুগু ভাষায়। এই কাব্যে আখ্যানের কেন্দ্র থেকে কৃষ্ণকে সরিয়ে রাধা হয়ে উঠলেন কেন্দ্র। এই রাধা বিদ্যাপতির সাবর্ণ রাধার মতো লতানো স্বভাবের নন। এই রাধা বড়ু চণ্ডীদাসের সাবর্ণ রাধার মতো প্রেমে নতজানু নন। এই রাধার জন্ম অবর্ণ মুদ্দুপলানীর রাগ থেকে। কৃষ্ণ সেই রাগকে ভয়ও পান এবং মেনেও নেন। জন্ম নেয় ‘রাধিকা সান্ত্বনম’।
মহাকাব্য শুরু হচ্ছে রাধার কৃষ্ণের প্রতি অনুরাগ দেখিয়ে। তারপর আস্তে আস্তে দেখানো হচ্ছে রাধার ইলাকে বড় করে তোলা, ইলার ঋতুমতী হওয়া, কৃষ্ণের সঙ্গে ইলার বিয়ে, কৃষ্ণের সঙ্গে ইলার রতিক্রিয়া, সেই রতিক্রিয়া চলাকালীন রাধার মানসিক অবস্থা, ইলার সামনেই রাধার অবদমিত যৌনতার প্রকাশ এবং ইলার অনুপস্থিতিতে রাধার কৃষ্ণের সঙ্গে দ্বন্দ্বময় রতিক্রিয়া ও সংলাপে মেতে ওঠা। রাধিকা সান্ত্বনম’-এর দ্বিতীয় পর্বের পুরোটা জুড়েই ইলার সঙ্গে কৃষ্ণের সুখী দাম্পত্য নিয়ে রাধার অস্তিত্ব সংকট আঁকা হয়েছে। সবকিছুকে মেনে না নিয়ে রাধা এখানে সেই নারী হয়ে উঠছেন যিনি নিজের যৌনতাকে অবদমিত করতে চান না, যন্ত্রণাকে বুকে চেপে না রেখে ব্যক্ত করতে চান। চূড়ান্তভাবে রেগে উঠে রাধা নিজের টিয়াকে যিনি সৌরি (কৃষ্ণ) ও ইলাকে দেখতে পাঠিয়ে তার মুখ থেকে শোনেন কৃষ্ণের যৌনতার বর্ণনা। ভয়্যার, স্যাডো-ম্যাসোকিসম এবং রেগে কৃষ্ণকে গালিগালাজ করার সমস্ত অস্তিত্ব নিয়ে রাধা প্রবল রাগী নারী এই অধ্যায়ে। রাধা যখন রেগে উঠে জানান যে যৌনতা এবং ঝগড়ার সময়ে তিনি কৃষ্ণের সমান থাকতে চান সবসময়, আমরা বুঝতে পারি রাধার রাগ আসলে অবদমিত নারীর মৌলিক আকাঙ্ক্ষা। দ্বিতীয় পর্বের রাধার রাগ তৃতীয় পর্বে সুতীব্র হতাশা ও উন্মাদনার প্রান্তে এসে পৌঁছায়। ইলার কৃষ্ণের কাছে রাধাকে ত্যাগ করার অনুরোধ এবং কৃষ্ণের আপাতভাবে তাতে সায় দেওয়া রাধাকে শুধুমাত্র ‘নারী’ হিসেবে বিধ্বস্ত করে না, আঘাত করে তার ‘শিক্ষক’ সত্তায়। রাধা হয়ে ওঠেন সেই ব্যক্তি যিনি নিজের অর্জিত গুণাবলি ব্যবহার করে নিজের অধিকার ছিনিয়ে আনতে চান। পিতৃতন্ত্রের নির্দিষ্ট করা ‘ত্যাগী’র ভূমিকায় না থেকে রাধা এখানে নিজ অধিকার বুঝে নেওয়ার সওয়াল করতে শুরু করেন। অপর দিকে কৃষ্ণ রাধাকে চিরতরে হারানোর সম্ভাবনা আঁচ করে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন রাধার সঙ্গে দেখা করার জন্য।
শেষ পর্বের প্রায় পুরোটা জুড়ে রয়েছে কৃষ্ণের রাধার কাছে আকুতি। নিজের স্ত্রী, সংসার, আত্মীয় সবাইকে ছেড়ে এসে কৃষ্ণ হয়ে উঠেছেন রাধার কাছে সমর্পিত হতে চাওয়া এক অস্তিত্ব। এই অধ্যায়ের প্রায় পুরোটা জুড়ে একইসঙ্গে রয়েছে রাধার রাগজাত অভিমান। এই হেতু তিনি কৃষ্ণকে সরিয়ে রাখতেও পিছপা হন না। এমনকী, দ্বিধা বোধ করেন না ঈশ্বর-কেন্দ্রিক পুরুষতন্ত্রের প্রতিভূ কৃষ্ণের মাথায় লাথি কষাতে। এই লাথিটি রাধা- কৃষ্ণের কাহিনির শেষ অংশটিকে মুদ্দুপলানির ইচ্ছা অনুযায়ী বিনির্মিত হতে সাহায্য করে। কৃষ্ণ এখানে রাধাকে ত্যাগ করে নিজ সংসারে ফিরে যান না, সংসার ত্যাগ করে রাধার সঙ্গে থেকে যাওয়ার সিধান্ত নেন। মূল কাহিনিকে পালটে দেওয়ার এই মানসপট অবশ্যই মুদ্দুপলানির রাধিকাকে অনান্য আখ্যানের রাধিকার চেয়ে স্বতন্ত্র করে তুলে। এই স্বাতন্ত্র্য অবশ্যই রাগ ও ভোগের অধিকার থেকেই জাত হয়। এই রাগের জন্যই ‘কৃষ্ণের রাধা’ থেকে যখন বিনির্মিত হয়ে জন্ম নেয় ‘রাধার কৃষ্ণ’, ‘রাধিকা সান্ত্বনম’ হয়ে ওঠে নারীত্বের হরেক রঙের উদযাপন। নারীর মেয়েবেলার উদযাপন, উদযাপন নারীর ঋতুমতী হয়ে ওঠার, উদযাপন সমস্ত সামাজিকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নারীর প্রেমে মেতে ওঠার।
কাগজ বেরনোর পর দেখা গেল উপন্যাসের নাম হয়ে গেছে ‘শালিকার ঠোঁট’! পূর্ণেন্দুদা রেগে আগুন। পিঠে হাত দিয়ে সন্দীপন তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, ‘কী করবে ভাই বল! ছাপাখানার ভূত কাউকেই রেহাই দেয় না রে।’ পরে জানা গিয়েছিল এটা সন্দীপনদারই সূক্ষ্ম হাতের কাজ।
২০২৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পেলেন কোরিয়ান সাহিত্যিক হান কাং। অস্তিত্বের অতীন্দ্রিয় অস্বস্তি ধরা পড়ে তাঁর লেখায়। উত্তরাধুনিক সমাজে আমাদের প্রত্যেকেরই বুকের ভিতর রক্তক্ষরণ চলছে অবিরত। আমরা চেপে যাচ্ছি রোজ। লোকলজ্জার ভয়ে, মানহানির ভয়, গড্ডলিকা প্রবাহের বিপরীতে একা হওয়ার ভয়ে। কাং সেসব টেনে খুলে ফেলেন।