‘সেদিন সন্ধের মুখে শ্মশানের পাশ দিয়ে আসছি, হঠাৎ শুনি…।’ ব্যস! জেঠামশাইও ইজিচেয়ারটা সামনে টেনে বলে ওঠেন, ‘তারপর? থামলি কেন? বউমা জানোয়ারটাকে আরও দুটো পেঁয়াজি দাও।’
২.
শরৎবাবু বাঙালি ছোকরার অসীম সাহসের বর্ণনা রাতের আঁধার ফেলে ছকেছিলেন– সে বেটার পরিবারের কোনও উদ্দিস পরিকল্পনাটিতে নেই। শঙ্কর একা রহস্যময় আফ্রিকার জোৎস্নালোকিত প্রান্তর দেখে বিষ্ময়ে হাঁ হয়ে গিয়েছিল। সাঁৎ করে সরে যাওয়া, সাদা কাপড়ের ঘোমটা টানা, নাকি সুরে কথা কওয়া একটা কালো টিকিরও সঙ্গে কখনও মোলাকাত হয়নি– এমনকী, গুহায় নরকঙ্কালের মতো হাতে-গরম মালমশলা পাওয়া সত্ত্বেও না। আফ্রিকানরা ম’লে ভূত হয় কি না, সে প্রশ্নের মীমাংসা অন্যত্র হবে। তবে, শঙ্করের মা-কে ছেড়ে যাওয়ার কোনও বর্ণনা উপন্যাসে নেই, বুক চাপড়ানোর জন্য মুখিয়ে থাকা বাঙালি বিদেশে পাড়ি জমানোর আগে যেমন স-ক্রন্দন আছাড়িপিছাড়িতে অভ্যস্ত, তার কথা বাদই দিলাম। মায়ের উল্লেখ উপন্যাসের একেবারে শেষে, এবং হাতে ‘হিরের টুকরো’ না থাকলে সে স্মৃতি ‘সোনা ছেলের’ মগজে খেলত কি না, কওয়া মুশকিল। ততদিনে ‘ভূত’ শব্দটার কোনও অস্তিত্ব সে জগতে আর নেই। অতএব পারিবারিক ইন্ধন এবং আঁটো বন্ধন ছাড়া বাঙালির মাথায় ভূতেদের পাকাপাকি বসবাস অসম্ভব।
বাঙালি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মূলত প্রাণ বাঁচাতেই কুসংস্কার ত্যাগ করেছে। ঠাকুর-দেবতা নিয়ে বাঙালির যে পরিমাণ ঠাট্টা বটকেরা, অন্য কোনও সাধারণ ভারতীয় তেমনটা কল্পনাতেও স্থান দেয় না। এতদ্সত্ত্বেও, ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস না করার জন্য তাকে মার্কসবাদী বা যুক্তবাদী সংগঠনের সদস্যও হতে হয়নি সবসময়। এমনিতেই ভগবানে বিশ্বাস নেই তেমন মানুষের সংখ্যাটি আসলে কত, সেটা চারপাশে একটু চোখ বুলালে বেজায় বিস্মিত হতে হবে। ঠিক সেই নাস্তিক বেপরোয়াদেরই জিজ্ঞেস করুন ভূত আছে না নেই– টুক করে অন্ধকার থেকে চায়ের দোকানের হ্যাজাকের আলোয় এসে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় বলে উঠবে, ‘এই ভর সন্ধেয় আবার ওইসব বিষয়ে আলোচনা কেন? এই জন্যই আপনাদের কোঅর্ডিনেশন কমিটির লোকদের ট্রাস্ট করতে নেই। যান মশাই, দেব না আপনাদের ভোট।’
সমস্যাটা জটিল। জীবনানন্দ কিন্তু অনায়াসেই লিখতে পারতেন, ‘তবু সে দেখিল কোন ডাইনোসর’। এঁচোড়ে পাকারা বলবে, ‘ছন্দ মিলত না।’ আরে বাবা, যে ভূতের ছন্দ মেলাতে পারে, সেসব পারে। গোলমাল অন্যত্র। চেষ্টা করেননি। জীবনানন্দ মহান। তাঁর কবিতা ততোধিক মহান, অথচ লোকটার অপঘাতে মৃত্যু, সেটা অস্বীকার করতে পারবেন? না, দাঁড়ান, লেট মি ফিনিশ। চাঁদ ডুবে গেলে, অদ্ভুত আঁধার, হেমন্তের ঘোলাটে আলোয় ধান কেটে নেওয়া প্রান্তর, পেঁচা, রক্ত, থেঁতলানো মুখ ইঁদুর, মৃত মুখ থেকে চোখ তুলে শুধাবে সে– এসব কীয়ের কবিতা মশাই? আমরা কিছু বুঝি না, তাই না? তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প তো এর তুলনায় ‘পাখি সব করে রব!’ সেই জন্যই নিশির ডাক নিয়ে ‘আয় খুকু আয়’ গান অমন হিট হয়। বাপ মরে গেছে, বন্ধুর ফোনে মেয়ের মন বসছে না, ব্যস, এই সুযোগ– অমনি বাইরে থেকে ‘আয়, আয়, চলে আয়’। হেমন্তর গলাটাও মশাই একেবারে মরণের পরে বই থেকে তুলে আনা!
এখানকার আবহাওয়াটাও ভূতের গল্পগুলোর সঙ্গে খাপ খেয়ে গিয়েছে। ঝমঝম করে বৃষ্টি, কাঁথা মুড়ি দিয়ে জটলু পটলু হয়ে বসো সকলে, ঝপ করে আলো চলে যাবে, গ্রামতুতো সম্পর্কের মামা আলুর চপে কামড় বসিয়ে আলগোছে বলে উঠবে– ‘সেদিন সন্ধের মুখে শ্মশানের পাশ দিয়ে আসছি, হঠাৎ শুনি…।’ ব্যস, কেল্লা ফতে! এমনকী, জেঠামশাইও, যিনি কিনা কথায় কথায় ‘‘রাসকেলটার কান মুলে দু’-বেলা জুতো পেটাই একমাত্র ওষুধ’’ বলে থ্রেটনিং দেন, তিনিও ইজিচেয়ারটা সামনে টেনে বলে ওঠেন, ‘তারপর? থামলি কেন? বউমা জানোয়ারটাকে আরও দুটো পেঁয়াজি দাও।’
আসলে আমাদের এরকম মামার সাপ্লাই লাইনটা যাকে বলে আনইনটারাপ্টেড চালু আছে ওলাওঠা, কালাজ্বর, দেশ-গাঁ উজার হওয়ার, বা তারও অনেক আগে থেকেই। রাস্তায় বেরলে চার-পাঁচটা পেত্নি টাইপ চেহারা প্রতি দশ মিনিটে চোখে পড়ে। রোগা ডিগডিগে, কোটোরে বসা চোখ, কারণে-অকারণে দাঁত দেখিয়ে হি-হি করে এর-তার গায়ে ঢলে পচ্ছেন হরবখত। রাতের বেলা ফস্ করে গলি থেকে বেড়িয়ে এলে আনসাসপেক্টিং লোকজনের দাঁত কপাটি লেগে যাবে। প্রেতাত্মা হোক বা না হোক, হাত লম্বা করে লেবু পেড়ে আনা তাদের পক্ষে কোনও ব্যাপারই না। এভাবেও ভূত-পেতনির ভয় সমাজের বুকে জাগিয়ে রাখা হচ্ছে। তবে সে যেহেতু অন্য প্রসঙ্গ, আসল কথায় ফিরি।
উপরোক্ত গুড ফর নাথিং মামাটি পাঞ্জাবি হলে দিবারাত্র জামাইবাবুর গ্যারেজে পাংচার সারাবে। শ্মশানের পাশ দিয়ে সে হাঁটে না, তা নয়। তবে সেখানে ‘জস্সি দা ঢাবে’ নামক কাবাব-পরোটার দোকান দেওয়ার, এবং ক্রমে ক্রমে দু’-আড়াইশো ট্রাক কেনার সুখস্বপ্নে সে এতটাই বিভোর যে, খাটিয়ার মরা তাকে জাপ্টে ধরে ‘আছে, আছে, সব আছে’ হেঁকে গেলেও কিচ্ছু যায় আসে না। ভূত থাক বা না-থাক, সর্দারজির টার্গেট অন্য। বাঙালির বাচ্চার জীবন থেকে গোঁসাইবাগান এবং লীলা মজুমদারের কিছু বাছাই ভূত হাপিস হয়ে গেলে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা করতে হবে। গল্পের সিচুয়েশন, গল্পকার, পুরনো গল্পের উপমা টেনে নতুন আখ্যানকে ক্রেডিবল করে তোলা, ভূতেদের পিরিয়ডিক টেবিল ইত্যাদি আতঙ্কের ঐতিহ্যটিকে জায়মান রেখেছে। আমাদের ইতিহাস আসলে ভৌতিক আখ্যান দিয়ে পড়া যায়– কনিষ্ক আদতে কবন্ধ। পলাশির আমবাগানে ক্লাইভ হামেশাই ঘোড়া ছোটান। নকশাল নেতারা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থেকে বারান্দায় বিড়ি খেতে বেরিয়ে কতবার যে চেয়ারম্যান মাও-কে তেতলার জানালা দিয়ে হাত নাড়তে দেখেছে, সে গুনে শেষ করা যাবে না। তাছাড়া এ শহরে প্রায়ই পুরনো বাড়ির ছাদ, ঝুল-বারান্দা, দেওয়াল, কার্নিশ ধ্বসে পড়ে। ইট চাপা মরাও বেরয়। অতএব খণ্ডহর থেকে অপঘাতে মৃত অবধি সবটাই হাতের মুঠোয়। ভূতে বিশ্বাস না করার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণই নেই।
তার ওপর মহাপুরুষরা বলে গিয়েছেন, ‘তুমি বিলেতে যাওনি মানেই কি বিলেত নেই?’ একই যুক্তিতে, তুমি বিলেটেডদের দেখোনি মানেই তারা নেই নাকি? আলবাত আছে, ইয়ে, মানে আছেন! শিব টাকুরের বিয়ে হলেই বা কী– টাপুরটুপুর বৃষ্টির দেশে দেওয়াল-জোড়া ‘ছায়া কালো কালো’ ইসেরা তো সত্যিই ইসে, তাই না?