যে শূন্য কাঙ্ক্ষিত নয়, তা-ও এসে পড়ে। বিভেদ-বিদ্বেষের খাতায় কখনও শূন্য পড়ে না, পড়ে খাবারের পাতে। আগাগোড়া শূন্য নিয়ে দ্বিধায় আমরা ভুগতে থাকি। ভাবি, তার কতটা গ্রহণীয়। কতটাই বা বর্জনীয়। সেই দ্বিধার ভিতরই এসে দাঁড়ায় একটি জিরো-ফুড শিশু। তাকে স্বীকার-অস্বীকারের দ্বন্দ্বে হয়তো আমরা ভুলে যেতে থাকি, যে, দেশে একটিও শিশু ২৪ ঘণ্টা খাদ্যশূন্য থাকলে আমাদের লজ্জিত হওয়ারই কথা।
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী
পরীক্ষার খাতায় দেখলেই অভিভাবক গোষ্ঠী যুগে যুগে খাপ্পা হয়ে উঠেছে। অথচ শূন্য আবিষ্কারে আশ্চর্য ভারতীয় শ্লাঘা অনুভবই স্বাভাবিক ছিল। শূন্য মূলত ডানপন্থী, অন্যের মূল্য বাড়াতে। বামের শূন্য মানে নেহাতই বিধি বাম। একা শূন্য তো অকিঞ্চিৎ, অকীর্তিত; ছাপোষা ভোটারের মতো। তার আর আম্বানির ভোটের মূল্য এক। তাই বলে কি দু’জনেরই প্রিওয়েডিং জগঝম্প এক হবে! গোল্লা! সেই শূন্য এসে গেল! একা, অতএব মূল্যহীন। অথচ শূন্য কিন্তু কারও মুখাপেক্ষী নয়। শূন্যের যমজ বৃত্তের বরং দায় আছে কেন্দ্রের মন রেখে ক্রমে ক্রমে হয়ে-ওঠার। বৃত্ত সহজসাধ্য নয়। কম্পাসের কাঁটা আঙুলের চাপে নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারলে পরিধি পথ হারিয়ে ফেলে। বৃত্ত আয়ত্ত করা সময়সাপেক্ষ। জীবনে কোনও কিছুর বৃত্ত সম্পূর্ণ হতে তাই সময় লাগে। বহুদিনের অপেক্ষা না থাকলে হিসেব মেলে না।
শূন্য এত নাক-উঁচু নয়, বরং ভূতের রাজার বর। টপাটপ চলে আসে। এমনকী, না চাহিলেও যারে পাওয়া যায়। ছোটবেলায় অঙ্কের খাতায়, বড় হলে মাসের শেষে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সে। শূন্য সহজলভ্য, ফলত উপেক্ষিত। তবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সংখ্যাতত্ত্বের প্রায় সকলেই শূন্যের ওপর নির্ভরশীল। পাশ থেকে আস্থাভাজন শূন্যকে সরিয়ে নিলে তাদের গুণপনার সংসার টলোমলো। তবে শূন্য হতে শূন্য নিলে শূন্যই থাকে– কমেও না, বাড়েও না। অতএব, ‘শূন্যমিদং, শূন্যমদং’। তবু পূর্ণের যে ভরভরন্ত জমিদারি, শূন্যের তা নেই। এমন নিরীহ অথচ গোলমেলে বলেই শূন্যকে নিয়ে মানুষের মুশকিল। নেতি না ইতি– কোন খাপে যে তাকে ফেলা যায়, বুঝে উঠতে পারা যায় না। শূন্য বোধহয় সেই নীরব অন্তর্ঘাত যা থেকে এবং না-থেকে, দুই অবস্থাতেই আমূল পরিবর্তন সম্ভব করে তুলতে পারে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
শূন্য সহজলভ্য, ফলত উপেক্ষিত। তবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সংখ্যাতত্ত্বের প্রায় সকলেই শূন্যের ওপর নির্ভরশীল। পাশ থেকে আস্থাভাজন শূন্যকে সরিয়ে নিলে তাদের গুণপনার সংসার টলোমলো। তবে শূন্য হতে শূন্য নিলে শূন্যই থাকে– কমেও না, বাড়েও না। অতএব, ‘শূন্যমিদং, শূন্যমদং’। তবু পূর্ণের যে ভরভরন্ত জমিদারি, শূন্যের তা নেই। এমন নিরীহ অথচ গোলমেলে বলেই শূন্যকে নিয়ে মানুষের মুশকিল। নেতি না ইতি– কোন খাপে যে তাকে ফেলা যায়, বুঝে উঠতে পারা যায় না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
শূন্য অতএব যৌথ পরিবারের জ্যাঠামশাই। সম্ভ্রম, সমীহ– সবই আছে; তবে তাঁর সব কথা কি আর অক্ষরে অক্ষরে মানা হয়! শূন্যকেও কি আর তাই সেভাবে সর্বত্র পাওয়া যায়! এই যেমন, শাহরুখ খান ডাক দিলে শুক্রবার সকালে সিনেমাহলের কাউন্টার টিকিট-শূন্য হতে পারে; তাই বলে দুর্নীতিতে শূন্য পাওয়া প্রশাসন আপনি দুনিয়ায় চেয়েও পাবেন না। ভোটের লাইন শুরু হতে না হতেই জনতাশূন্য হতে পারে, তাই বলে ব্যালটবাক্স কখনও শূন্য হয় না। পুজোর ডালা ভক্তিশূন্য হলেও হতে পারে, তবে প্রণামীর থালা কখনও শূন্য হয় না। শূন্যের ভিতর এত ঢেউ। কেউ কেউ তাই খেয়ালই করি না যে, শূন্য খানিক মনোযোগও দাবি করে। যেমন, গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ হওয়ার সময় সংসদ যদি বিরোধীশূন্য থাকে, তবে গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য উদ্ধারের সম্ভাবনা দিনে দিনে ক্ষীণ হয়ে পড়ে। সভ্যতা চালাতে গিয়ে প্রচল শক্তির ভাঁড়ার ক্রমশ শূন্যের দিকে এগোচ্ছে, অথচ আমাদের ভয় হয় না। কার্বন নিঃসরণ শূন্য করার জন্য বিশ্বজুড়ে বক্তিমে, আমাদের অবশ্য কানে কানে ইয়ারবাড। শূন্যকে গুরুত্ব না দেওয়ার যে অভ্যাস আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতর খেলা করে, তা একদিন আমাদের অস্তিত্বের সামনেই প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে, আমরা কি মানুষ, এখনও? যদি শূন্যের হিসেব বলে, ২৪ ঘণ্টায় একফোঁটা দুধ বা খাবার পায় না এরকম ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সি বাচ্চার সংখ্যা এই ভারতে ৬৭ লক্ষ, আমরা কি বিস্মিত হব! হওয়াই উচিত, কেননা এই শিশুদের পোশাকি নাম দেওয়া হচ্ছে– ‘জিরো ফুড’ শিশু। অর্থাৎ যে সমস্ত দুধের শিশুর পাকস্থলী শূন্য। ‘JAMA নেটওয়ার্ক ওপেন’ নামে একটি জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই দাবি তুলেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। তাঁদের মতে, ৯২টি দেশে মোট যে সংখ্যক এমন শিশু আছে, তার প্রায় অর্ধেক আছে ভারতেই। শতাংশের হিসেবে তা প্রায় ১৯.৩, অন্য কোনও কোনও দেশে অবশ্য সেই হার গিয়ে ঠেকেছে ২১ শতাংশে। অন্য দেশের কথা আপাতত থাক। যদিও পৃথিবীর কোথাও শিশু খাদ্যহীন হয়ে থাকুক, এমনটা বাঞ্ছনীয় নয়। তবু সাময়িক মুখ ফেরানো যাক স্বদেশে।
তথ্য যে শিউরে ওঠার মতোই, তা দেশের প্রতিবাদেই মালুম হয়। প্রতিবেদনের দাবিকে নস্যাৎ করে ‘ফেক নিউজ’ তকমা দিয়েছে ভারত। নারী ও শিশুকল্যাণমন্ত্রকের দাবি, এই প্রতিবেদনে যে বয়সি বাচ্চাদের হিসেবে ধরা হয়েছে, তাদের একটা বড় অংশ মাতৃস্তন্য পান করে। তবে এখানে স্তন্যকে খাবার হিসাবে গণ্য করা হয়নি। তাই এই সংখ্যাটা এমন ভীতিপ্রদ। দেশের নিজের হিসেব অনুযায়ী, ১৯ শতাংশের মধ্যে ১৭.৮ শতাংশই স্তন্যপান করে। আর বাকি ১.৫ শতাংশ? সরকারের উত্তর, তারা স্তন্যপান করে না। এ ছাড়া সরকারের নালিশ এই যে, স্তন্যপানের উপযোগিতার কথা এই সমীক্ষায় একেবারেই মানা হয়নি। তা ছাড়া এই ‘জিরো-ফুড শিশু’ যে কাকে বলা হচ্ছে, তা নিয়েও ধোঁয়াশা আছে। উপরন্তু সমীক্ষার পদ্ধতিতেও নাকি গোলমাল আছে, তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রেও সেভাবে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়নি। ধরা যাক, সে সবই সত্যি। তাহলেও তো মস্ত প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়ায় ওই ১.৫ শতাংশ শিশু। দেশ জানে, তারা স্তন্যপান করে না, তাহলে? যদি ‘জিরো-ফুড শিশু’র ধারণাতে গোলমালও থাকে, তাহলেও এ কথা স্পষ্ট যে, এই দেশেই এমন বহু শিশু আছে যারা বহু বহুক্ষণ অভুক্ত থাকে। সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখার স্বপ্ন থাকলেও তাদের অভিভাবকরা নিরুপায়। এর নানা কারণ থাকতে পারে। তবে, সাধ করে কেউ যে নিজের শিশুকে খিদের আগুনে বসিয়ে রাখে, তা তো নয়; অর্থাৎ মোদ্দা কারণ হল, সঙ্গতি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সন্তানকে খাওয়ানোর মতো সঙ্গতি আজও বহু অভিভাবকের নেই। এই ধারণাটুকুর ভিতর আশা করি কোনও ফেক নিউজ নেই; কেননা খিদের নিউজ কখনও ফেক হয় না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ইশকুলের পরিসরেই জন্মায় ছোট ছোট দীর্ঘজীবী ঘৃণা
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এই শূন্যের পিঠোপিঠি দাঁড়িয়ে থাকে আতঙ্ক। তার অনেক রকম পরত। সংখ্যা বা শতাংশের হিসেব বাদ দিলেও শিশুর এই অভুক্ত থাকার বাস্তব অনস্বীকার্য। ভুক্তভোগী মূলত বর্গনিম্নের মানুষরাই। যেখানে সংসার চালাতে মায়েদের কাজ করতে না গিয়ে উপায় নেই, সেখানেই শিশুদের দিকে নজর কম পড়ছে। নগরায়ন আর শিল্পায়নের দরুন পরিবারের ধারণাতেও বদল এসেছে। মায়ের অনুপস্থিতিতে বাচ্চাকে যে অন্য কেউ খাইয়ে দেবেন বা দেখভাল করবেন, এমনটাও হয়ে উঠছে না। এই বাস্তব তিক্ত এবং নিষ্ঠুর। উপরন্তু মাস ছয়েকের পর থেকে কেবলমাত্র মাতৃস্তন্য বাচ্চার জন্য পর্যাপ্ত নয়। তার পুষ্টির জন্য আরও কিছু খাবারের দরকার হয়। ‘ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন’ তার কিছু হিসেবনিকাশও বরাদ্দ করে রেখেছে। সুতরাং, মাতৃস্তন্যের যুক্তি দিয়ে এই বাস্তবকে এড়িয়ে যাওয়ার অর্থ ধারাবাহিক অভুক্তি তথা দুর্ভিক্ষকেই প্রশ্রয় দিয়ে দেওয়া যায়। তাই-ই যদি দেশের ভবিতব্য হয়, তাহলে তার ভবিষ্যতের সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই শূন্য নিয়ে আমরা কি আদৌ ভাবিত! একজন ক্রিকেটার জীবনে কটা শূন্য পেয়েছেন, তার হিসেব থাকে। তবে, নেতারা কখনও শূন্য পান না। সরকারও তাই নিজের মার্কশিটে কখনও শূন্য দেখতে চায় না। যদি বা কেউ ফেল করে, তবে, তার পরে যে আসে লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। এসবের মধ্যেই প্রাচীন তীর্থস্থানে প্রতিদিন প্রণামী উপচে পড়ে, নবীন তীর্থ গড়ে ওঠে। আর ভারততীর্থ মরে যায়।
যে শূন্য কাঙ্ক্ষিত নয়, তা-ও এসে পড়ে, এভাবেই। বিভেদ-বিদ্বেষের খাতায় কখনও শূন্য পড়ে না, পড়ে খাবারের পাতে। আগাগোড়া শূন্য নিয়ে দ্বিধায় আমরা ভুগতে থাকি। ভাবি, তার কতটা গ্রহণীয়। কতটাই বা বর্জনীয়। সেই দ্বিধার ভিতরই এসে দাঁড়ায় একটি ‘জিরো-ফুড শিশু’। তাকে স্বীকার-অস্বীকারের দ্বন্দ্বে হয়তো আমরা ভুলে যেতে থাকি, যে, দেশে একটিও শিশু ২৪ ঘণ্টা খাদ্যশূন্য থাকলে আমাদের লজ্জিত হওয়ারই কথা।
মনে পড়ল, এককালে শূন্য বানানে একটানা ‘ণ’ লিখে চলেছিলেন রানী চন্দ। সেই বানানের দিকে নজর পড়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের। একদিন রবীন্দ্রনাথ বুড়ো আঙুল দিয়ে রানী-লিখিত ‘ণ’-এর মাথা চেপে ধরে বলেন– একে তো শূন্য, তার আবার অত মাথা উঁচু করা কেন!
শূন্য মূলত আমাদের লজ্জাচিহ্ন, সে পরীক্ষার খাতায় হোক কিংবা মানবিকতায়।