২.
আঠেরো শতকে ব্রিটেনে শুরু হল শিল্প বিপ্লব। তার প্রভাব আমেরিকা হয়ে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। ক্রেতাদের মনমতো নানা প্রোডাক্ট বাজারে আসতে লাগল। তার আবার প্রতিযোগিতাও শুরু হল। এখান থেকে আধুনিক ব্র্যান্ডিং-এর উদ্ভাবন হল ট্রেডমার্কের হাত ধরে। কিছু কিছু উচ্চবর্ণের প্রোডাক্ট ও তার উৎপাদক সংস্থা নিজেদের প্রোডাক্ট ও কোম্পানির উচ্চমান জনমানসে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ট্রেডমার্কের মুখাপেক্ষী হল।
১৮৮১ সালে ‘ট্রেডমার্ক অ্যাক্ট’ পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানি ব্র্যান্ডিং আর প্রোডাক্ট ব্র্যান্ডিংয়ের যাত্রা শুরু।
সেই সময়ের সোনার বাংলা দিয়েই শুরু করা যাক। মাইকেল মধুসূদনের ভাষায়, ‘হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন।’ সেকালে বঙ্গদেশে
(পূর্ব-পশ্চিম মিলে) কীরকম ব্র্যান্ডিং-রতনের চর্চা হত, দেখা যাক।
উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বাংলার শিল্প-বাণিজ্যে চোখে পড়ার মতো ঘটনা ঘটাতে শুরু করল ‘এইচ ডি মান্নান এন্ড কোম্পানি’, ‘ডব্লিউ মেজর এন্ড কোম্পানি’, ‘পি এম বাকচি’, ‘হেমেন্দ্র মোহন বসু’, ‘সি কে সেন এন্ড কোম্পানি’ প্রমুখ। এদের মধ্যে লক্ষণীয় ডব্লিউ মেজর। বোধহয় বাংলা ব্র্যান্ডিং-এ তিনিই প্রথম নিজের ছবি দিয়ে তাঁর প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপন করতেন। তবে সে যুগে সব থেকে সার্থক, বুদ্ধিদীপ্ত, ও ক্রিয়েটিভ ব্র্যান্ডিং করলেন হেমেন্দ্রমোহন বসু তাঁর সৃষ্টি ‘কুন্তলীন কেশ তৈল’ নিয়ে।
ভাবুন, যখন সবাই খোদাই করা কাঠের ব্লকে দেবদেবীর ছবি বা লাস্যময়ী মেমসাহেবদের ছবি দিয়ে পঞ্জিকাতে বিজ্ঞাপন করতে ব্যস্ত, তখন কুন্তলীনের ব্র্যান্ড বিল্ডিং শুরু হল একদম ভিন্নমাত্রায়। ছড়া বা পদ্য দিয়ে, জনপ্রিয় থিয়েটারের গানের মধ্যে কুন্তলীনের নাম ঢুকিয়ে, থিয়েটারের পর্দায় বড় করে ‘কুন্তলীন’ লিখে বা সাহিত্য প্রতিযোগিতা ইত্যাদির মাধ্যমে কুন্তলীন এতটাই জনপ্রিয় হল যে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও শংসাপত্র দিতে দ্বিধা করেননি।
ওই সময় বা আবহে হেমেন্দ্র বসুর ব্র্যান্ড বিল্ডিংয়ের এই উদ্ভাবনী শক্তি দেখে সত্যিই অবাক হতে হয়! এই প্রসঙ্গে একটি প্রস্তাব রাখছি। যে সংস্থা ‘বছরের শ্রেষ্ঠ বাংলা বিজ্ঞাপন’-এর পুরস্কার সভার আয়োজন করেন, তাঁরা যেন বাংলা ভাষায় ব্র্যান্ডিং উৎকর্ষতার জন্য ‘কুন্তলীন পুরস্কার’-এর প্রবর্তন করে সে যুগের এই উদ্যোগপতিকে সম্মানিত করেন ও বিস্মৃত বাঙালির অসাধারণ উদ্ভাবনী শক্তির কথা জনমানসে তুলে ধরেন।
এবার ব্র্যান্ড রত্নের রঙ্গমঞ্চে আর এক উল্লেখযোগ্য বঙ্গসন্তানের আবির্ভাবের কথা বলি। উচ্চশিক্ষায় ‘রয়াল সোসাইটি অফ কেমিস্ট্রি’র ফেলো, ঢাকার যোগেশচন্দ্র ঘোষ তাঁর ভুবনবিখ্যাত আয়ুর্বেদিক ওষুধের ব্র্যান্ড ‘সাধনা ঔষধালয় (ঢাকা)’ নিয়ে নিজের দেশ তো বটেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিন পর্যন্ত বিদেশের বাজারে ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করলেন। ‘সাধনা ব্র্যান্ড’ তখন এত বিখ্যাত যে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, প্রখ্যাত চিকিৎসক নীলরতন সরকারের মতো ব্যক্তিত্ব তাঁর আয়ুর্বেদিক ওষুধের গুণমুগ্ধ ছিলেন। এমনকী, সাধনার ফ্যাক্টরি পর্যন্ত ঘুরে এসে ছিলেন। সাধনার ‘সারিবাদি সালসা’ বা ‘মৃতসঞ্জীবনী সুরা’– দু’টি এতই জনপ্রিয় নাম, এমনকী, যাঁরা ছয়ের দশকের জাতক তাঁরাও ভুলতে পারবেন না।
এর পরের কয়েক দশক ধরে বাঙালির ব্র্যান্ড বিল্ডিং আর ব্যবসায়িক সাফল্য সারা দেশ চমকে দিয়েছিল এবং সমম্ভ্রমও আদায় করেছিল। কিছু বিখ্যাত ব্র্যান্ডের নাম বলি। যেমন ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’, ‘বেঙ্গল পটারী’, ‘বেঙ্গল ল্যাম্প’, ‘বেঙ্গল ইমিউনিটি’, ‘বেঙ্গল গ্লাস’ ইত্যাদি। এ তো কিছু সফল ব্র্যান্ডেড কোম্পানির নাম বললাম। এবার কিছু জনপ্রিয় ব্র্যান্ডেড প্রডাক্টের নাম বলি: যেমন ‘ডাক ব্যাক’, ‘সেন রালে’, ‘সুলেখা কালি’, ‘কেশ রঞ্জন’, ‘বসন্ত মালতী’, ‘জবা কুসুম কান্তা সেন্ট’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ‘কান্তা সেন্ট’-এর কথায় একটা অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল। আমার এক অতি শিক্ষিত, অতি সুন্দরী, খুব অভিজাত বউদি তখন বিলেতে থাকতেন। ওদেশের একটি কলেজে ইংরেজি ভাষার শিক্ষিকা ছিলেন। তাঁর বাৎসরিক কলকাতা ভ্রমণের সময় আমাদের জন্য নানা ব্র্যান্ডেড বিলিতি পারফিউম আনতেন, আর যাওয়ার সময় একগাদা কান্তা সেন্ট আর বসন্ত মালতী বগলে করে নিয়ে যেতেন। অবাক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ওঁর কাছে কান্তা আর বসন্ত মালতী এমনই দু’টি শ্রেষ্ঠ ব্র্যান্ড, যার ধারে কাছে কোনও ইউরোপীয় ব্র্যান্ড ঘেঁষতে পারবে না। ভাবা যায়?
এই হল বিস্মৃত বাঙালি ব্র্যান্ডের মাহাত্ম্য।