সুমনদার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে প্রায় দু’যুগ হয়ে গেল। ২০০৪ থেকে ২০২৪– কুড়ি বছর। এই দু’দশকে নানান আড্ডার যত মণিমুক্তো পেয়েছি তার অনেক কিছুই আমার ব্যক্তিগত সঞ্চয়। তার সবটা বলব না, বলতে নেই। যেটা বলতে পারি যে, সুমনদা আদ্যপান্ত রসিক মানুষ বলেই সিস্টেমকে প্রশ্ন করার পাশাপাশি নিজের প্রতিটি অবস্থানকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন। পরখ করতে চেয়েছেন।
একটা আস্ত মানুষ, বিশেষ করে যিনি একজন কিংবদন্তি শিল্পী, যিনি একটি যুগের গোড়াপত্তন করেন তাঁর শিল্পসৃষ্টি দিয়ে। তাঁর ব্যক্তিত্বের নানা দিক আছে। আসলে তা নানা রঙের আলো। আপনি সেই মানুষটির কাছে গেলেই সে আলোর সন্ধান পাবেন, এমন নয়। বিশেষ করে আপনি যদি কোনও অমুকবাদ তমুকবাদের ঠুলি পরে থাকেন কিংবা নীতিবাগীশ গাম্বাট জ্যাঠামশাই হন তাহলে কোনও কোনও আলো আপনার কাছে অন্ধকারের মতোই ধোঁয়াটে কিংবা আবছায়া মনে হতে পারে। সে সমস্যা একান্তই আমার কিংবা আপনার। পরিপ্রেক্ষিতের সমস্যা, পৃথিবীর অন্যান্য সমস্যার মতোই। একটা গান, একটা গানের বিষয় অভিব্যক্তি– সবই যে মুহূর্তে গানটি পরিবেশিত হচ্ছে, সেই মুহূর্তের জন্য সত্যি।
দর্শক সেই গানটিকে মনে মনে বয়ে বাড়ি ফিরতে পারে, মনে মনে গুনগুন করতে পারে, কিন্তু গানটির সঙ্গে সংগীতকার কিংবা গায়কের (এক্ষেত্রে একজনই) কোনও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত গোছের কোনও সম্পর্ক নেই। এই বন্দোবস্ত নেই বলেই একজন স্রষ্টা নিজের সৃষ্টিকেই প্রশ্ন করে ফেলেন। প্রশ্ন করতে পারেন মহৎ শিল্পী বলেই!
ব্যক্তিগত আলাপচারিতার কখনও কখনও এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। একদিন বিভিন্ন বিষয়ে হাসির উদ্রেক হওয়া নিয়ে কথা হচ্ছে। কেউ বলছি যে, যাঁকে চিনি না সেভাবে, তাঁর আত্মার শান্তি কামনায় নীরবতা পালনের সময় হাসি আসত গেরিলার মতো। সুমনদা বললেন, ‘আমার তো সবকিছু দেখেই হাসি পায়। তুমি একটা বড় টাইম–স্প্যানের নিরিখে যদি সমস্ত কিছুকে ভাবো তোমার হাসি পাবে।’ আমি বললাম, ‘সমস্ত কিছুকে বলতে কীরকম?’ সুমনদা বললেন, “সবই কিছুই! এই শহর, এই জীবন। বেঁচে থাকা। ভাবো, এত কিছু ঘটছে তার মধ্যে একটা লোক স্টেজে উঠে– ‘তোমাকে চাই, তোমাকে চাই’ বলে গান করছে, কিছু লোক সিরিয়াস মুখ করে টিকিট কেটে সেগুলো শুনছে– এই সমস্ত কিছু। আমার তো এক এক সময় ভয়ানক হাসি পায়।”
বাংলা সংস্কৃতির আগাপাশতলা উল্টেপাল্টে দেওয়া ‘তোমাকে চাই’ যেমন সত্যি, তেমন এই হাসিটাও সত্যি। এই তথাকথিত স্ববিরোধ কিংবা বিপরীতমুখী স্রোতকে মুহুর্মুহু পরখ করার খিদে থেকেই তাঁর সমস্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক যাপন। কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি, উনি গানের মানুষ রাজনীতিতে না নামলেই পারতেন। কাউকে বলতে শুনেছি, ক্ষমতা, প্রচার– এসবের জন্য রাজনীতিতে নেমেছেন। শুনে হাসব না কাঁদব, বুঝতে পারি না! কারণ, এমপি হিসেবে ভোটে দাঁড় করানোর জন্য তৃণমূল নেতৃত্ব এক থেকে দু’-মাস ঝুলোঝুলি করার পর সুমনদা রাজি হয়েছিলেন লোকসভা ভোটে দাঁড়াতে। রাজনীতির ময়দানেও দেখেছি, কী অপরিসীম নিষ্ঠায় হাজার ফুটের কল বসানো হবে, তা নিয়ে মেতে আছেন। পাশে বসে লক্ষ করতাম, আর ভাবতাম, এই লোকটা ‘অরুণ মিত্র’, ‘তোমাকে অভিবাদন’ কিংবা ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’ গেয়েছে! একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘রাজনীতিতে আপনার এত সময় নষ্ট হয়ে যায়।’ শুনে বললেন, ‘হ্যাঁ, সময় তো নষ্ট হয়ই আমার। কিন্তু প্রত্যক্ষ ময়দানে না নামলে আমাদের দেশের অনেক কিছু জানতে পারতাম না।’ সুমনদা ভাঙড়ে কল বসানো পর্যবেক্ষণ করছেন কিংবা নিকারাগুয়ায় বিপ্লবীদের সঙ্গে হাঁটছেন– আসলে সুমনদা গানের জমি তৈরি করছেন ভেতরে ভেতরে। কারণ ‘সংগীত, একমাত্র সংগীতেই আমি কনসিসটেন্ট।’
সুমনদার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে প্রায় দু’যুগ হয়ে গেল। ২০০৪ থেকে ২০২৪– কুড়ি বছর। এই দু’দশকে নানান আড্ডার যত মণিমুক্তো পেয়েছি, তার অনেক কিছুই আমার ব্যক্তিগত সঞ্চয়। তার সবটা বলব না, বলতে নেই। যেটা বলতে পারি, সুমনদা আদ্যোপান্ত রসিক মানুষ বলেই সিস্টেমকে প্রশ্ন করার পাশাপাশি নিজের প্রতিটি অবস্থানকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন। পরখ করতে চেয়েছেন। বেচারা আমবাঙালি বুঝতে পারেনি, কমেন্ট সেকশনে গালাগাল দিয়েছে। মুখ ফিরিয়ে থেকেছে। প্রতিটা আবেগকে প্রতিটা আবেগ থেকে আলাদা করতে পেরেছেন বলেই, অদ্ভুত খোলা মনে জীবনকে দেখতে পেরেছেন। আর পেরেছেন বলেই দেখেছি ওঁর এক প্রাক্তনের জন্যে বিরাট অঙ্কের টাকার ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে সেই টাকা অবলীলায় চিকিৎসার জন্য দিয়ে দিয়েছেন নিজের থেকে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অনেক রাত পর্যন্ত ছিলাম সুমনদার বাড়ি। তারপর পরের দিন শ্মশানে বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সুমনদা বসে রইলেন। নানা রকম গল্প করতে লাগলেন। মৃত্যুর গল্প, মৃত্যুর পরেও স্মৃতিতে কীভাবে মানুষ থেকে যায় এবং আরও নানা গল্প। কান্না ভুলিয়ে দেওয়া গল্প শোনালেন সেই লোকটা, যাঁর ‘সারারাত জ্বলেছে নিবিড়’ শুনে দর্শকের আসনে বসে কতবার হাউহাউ করে কেঁদেছি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
২০১৩ সালে ১৪ জুন। আমার মা মারা গিয়েছেন। আমি নার্সিংহোমের রিসেপশনে দাঁড়িয়ে। আমার অনেক কালের বন্ধু সৈকত আর মৃন্ময়ী এল। সৈকত বলল, ‘চল, সুমনদা ডাকছেন’। সেদিন রাত হয়ে গিয়েছে। আমরা পরেরদিন মাকে দাহ করব। তাই গেলাম সুমনদার বাড়ি। সুমনদা বললেন, ‘আজ থেকে যাও। আমরা গল্প করব। তোমার বাড়ির গল্প। মায়ের গল্প। মায়ের সঙ্গে কত দুষ্টমি করে মার খেয়েছ, সেই সব গল্প।’
অনেক রাত পর্যন্ত ছিলাম সুমনদার বাড়ি। তারপর পরের দিন শ্মশানে বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সুমনদা বসে রইলেন। নানা রকম গল্প করতে লাগলেন। মৃত্যুর গল্প, মৃত্যুর পরেও স্মৃতিতে কীভাবে মানুষ থেকে যায় এবং আরও নানা গল্প। কান্না ভুলিয়ে দেওয়া গল্প শোনালেন সেই লোকটা যাঁর ‘সারারাত জ্বলেছে নিবিড়’ শুনে দর্শকের আসনে বসে কতবার হাউহাউ করে কেঁদেছি।
একদিন সকালে সুমনদার বাড়ি গিয়ে দেখি, সুমনদা দু’খানা ডিম সেদ্ধ আর গোটা দুই বেশ কষিয়ে মাখন মাখানো পাউরুটি নিয়ে খেতে বসেছেন। বললাম, ‘এইসব খাওয়া তো আপনার পক্ষে চাপ, খাচ্ছেন কেন?’
সুমনদা মজা করে মুখটা একটু ভেঙচি কেটে বললেন, “থুত্থুড়ে জবুথবু হয়ে ৯০ বছর বেঁচে কী হবে, বাঘের বাচ্চার মতো যে ক’দিন বাঁচতে পারি বাঁচব।”
সত্যিই আপনি বাঘই বটে! খ্যাঁকশিয়াল অধ্যুষিত জনপদে একটু অসুবিধে তো আপনার হবেই!
…পড়ুন সুমন ৭৫-এর আরও লেখা…
ঊর্মিমালা বসুর লেখা: বললেই হল, কবীর সুমন ৭৫!
অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের লেখা: নদীমাতৃক অভিযাত্রিক
রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা: এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া
সুবোধ সরকারের লেখা: তাঁর দু’হাতে গিটার নয়, যেন সময়ের শিঁরদাড়া