হাইনরিখ ব্যোল, বারবারার রবীন্দ্রনাথ, মিরোস্লাভ হলুব, গার্সিয়া মার্কেজ নিয়ে যেসব হিরে বসানো গদ্য লিখেছেন সুমন, তা বাংলা সাহিত্যের পরশপাথর। কেন যে তিনি আরও গদ্য লিখলেন না, দুঃখ হয়। ‘সোই লা রেভলুসিয়ন’– কে বলেছিল কথাটা? নিকারাগুয়ার রাস্তায় সেই চাকা চালানো গরিব কিশোর, সেই বলেছিল ‘আমিই বিপ্লব’। গদ্যে এরকম অ্যানেকডোট তুলে আনতে পারতেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় কিম্বা শঙ্খ ঘোষ কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। গানের পাশাপাশি কীভাবে গদ্য লিখতে হয় সেটা সুমন ছাড়া আর কোনও ‘গানওয়ালা’ পারেননি।
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী
আমি জীবনে যে ক’টা ঝড় দেখেছি তার একটা ঝড় হল কবির সুমনের গান।
এই ঝড়ের জন্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি অপেক্ষা করে গাছের নীচে দাঁড়িয়েছিল। আমরা মরা ডালে ঝড় নেমে আয় বলে দাঁড়িয়েছিলাম। এমন একটা ঝড় আসুক যে ঝড়ে আমাদের ঘর-বাড়ি উড়ে যাবে, সমস্ত স্নায়ু টানটান হয়ে প্রবাহিত হবে নতুন সর্বনাশ!
একটা সর্বনাশ না হলে নতুন গান হয় না। নতুন কবিতা হয় না। নতুন প্রেম আসে না। তাই হল। আমরা নতুন গান পেলাম। গানের নতুন ভাষা পেলাম। গান নতুন নাগরিকত্ব পেল। গান লিখে সমাজ পাল্টানো যায় না। কিন্তু গান লিখে কবির সুমন গানের সংবিধান পাল্টে দিলেন। যেমনি লেখা, তেমনি সুর, যুগপৎ গড়ে তুলল যৌথখামার। যিনি বলতে পারেন, ‘আমার শুধু অন্ধকারে গান বানানোর দায়’, ঝড়েরও একটা দায় আছে, সেই দায় ঝড়কেও নিতে হয়। সেটা গত তিন দশক ধরে দেখে এলাম। গান অনেকেই গান, ক’জন আর ইতিহাস হয়ে ওঠেন? সুমন কিংবদন্তি হয়ে কোমায় চলে যেতে পারতেন, অনেকেই তাই যান, কিন্তু তিনি এখন বহমান ইতিহাস।
তিনি সলিল চৌধুরীর মতো নন, তিনি বব ডিলান নন, তিনি হেমন্ত মান্না নন, তিনি লালন নন। তিনি ‘কারার ওই লৌহকপাট’ থেকে , ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে’, ‘কোনও এক গাঁয়ের বঁধু’ থেকে অনেকটা এগিয়ে এসে একটা দরজা খুলে দিলেন, তিনি গেয়ে উঠলেন, ‘প্রথমোত আমি তোমাকে চাই’, কী কাণ্ড গানে কেউ ‘প্রথমোত’ লেখে? হ্যাঁ, লেখে। লিখে দেখিয়ে দিলেন, যে শব্দ প্রবন্ধে থাকার কথা, সে শব্দকেও গানে রূপান্তরিত করা যায়। সেখানেই থেমে গেলেন না। দ্বিতীয়ত, লাগালেন। তৃতীয়ত, লাগালেন। একটা প্রেমের গান ডিনামাইটের মতো ফাটিয়ে উঠে দাঁড়াল। একটা সময় উঠে এল। একটা প্রজন্ম-গান উঠে এল। একটা জেনারেশন উঠে এল। গান শোনার একটা জেনারেশন। গান গাওয়ার একটা জেনারেশন উঠে এল। সুমন কেন নাম পাল্টালেন তারপর? কারণ হিসেবে বলেছিলেন , ওরা কেন গ্রাহাম স্টেইন্সকে পুড়িয়ে মারল? অসামান্য সেই গান শুনতে শুনতে মনে হয়েছিল যে গান পারে সময়কে কামড়ে ধরতে, সময় নিজেও সেই গানের হাড়ে ও মজ্জায় ঢুকে পড়ে। মনে পড়ে যায় সেই অমোঘ দুটো লাইন: ‘সময়টাকে কামড়ে ধরো/ বাঘ যেমন শিকার ধরে’।
সুমনের গানের নায়ক হল সুমন। তাঁর দু’হাতে গিটার নয়, যেন সময়ের শিঁরদাড়া। যে আঙুল দিয়ে তিনি লেখেন সেই আঙুল দিয়ে তিনি সুর নামিয়ে আনেন। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, তিনি যেমন গান লেখেন তেমনি তিনি সুরও লেখেন। আমার মনে হয় তিনি গিটারে সুর লিখে চলেছেন।
২.
‘সোই লা রেভলুসিয়ন’– কে বলেছিল কথাটা? নিকারাগুয়ার রাস্তায় সেই চাকা চালানো গরিব কিশোর, সেই বলেছিল ‘আমিই বিপ্লব’। গদ্যে এরকম অ্যানেকডোট তুলে আনতে পারতেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় কিম্বা শঙ্খ ঘোষ কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। গানের পাশাপাশি কীভাবে গদ্য লিখতে হয় সেটা সুমন ছাড়া আর কোনও ‘গানওয়ালা’ পারেননি। অথবা নন্দীগ্রামের সেই কৃষক সেই উত্তাল সময়ে নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে বলেছিলেন, ‘আমি বেঁচে থাকলে আপনি ভাত পাবেন’। এই সব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে যেভাবে কবি মহমুদ দারউইশ-কে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে প্যালেস্টাইন, যেভাবে কবি আর্নেস্টো কার্ডিনাল লিখেছেন নিকারাগুয়া নিয়ে।
হাইনরিখ ব্যোল, বারবারার রবীন্দ্রনাথ, মিরোস্লাভ হলুব, গার্সিয়া মার্কেজ নিয়ে যেসব হিরে বসানো গদ্য লিখেছেন সুমন, তা বাংলা সাহিত্যের পরশপাথর। কেন যে তিনি আরও গদ্য লিখলেন না, দুঃখ হয়। ‘দেশ’ পত্রিকার জহুরি সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন ধারাবাহিক ‘দূরের জানলা’। আমাদের দেশে গানের লোকেরা কেউ মিরোশ্লাভ হলুবের কবিতা পড়েন বলে কখনও শুনিনি। সুমন পড়েন । যখন হলুব পড়েন তখন ভাস্কো পপাও পড়েন, তাদেউস রুজেভিজও পড়েন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যাঁরা ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে আধুনিক কবিতাকে নির্মাণ করছিলেন তাঁদেরকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে, তাঁদেরকে নিয়ে লিখতে লিখতে,নিজের গানের ভেতর নিমজ্জিত হয়েছেন সুমন। ঐতিহ্য ও আধুনিকতা– এই দুই স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে এক ঝটকায় আকাশ ধরে ফেলে তাঁর গান, সেই আকাশটার নাম উত্তর-আধুনিক আকাশ। সুমনের গদ্য পড়লে বোঝা যায় তাঁর মন কোথায় কোথায় ছুটে গেছে। আমি সুমনের গদ্যের ভক্ত ছিলাম। আছি। থাকব।
একটি ছোট্ট ব্যক্তিগত কথা বলে শেষ করি। আমার ছেলে রোরোর বয়েস যখন তিন, তখন মল্লিকা তাকে খাওয়াতে পারত না। সুমনের গলা শুনলে সে খেত। আমি সুমনের গান বন্ধ করে অন্য গায়কের গান চালালে সে খাওয়া বন্ধ করে হাত-পা ছুড়ত। রোরো এখন আমার মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেছে, বাবাকে ছেড়ে অনেক দূরে পড়াশুনা করতে চলে গেছে। আমার পরিবারের আর কেউ থাকল না। কিন্তু সে সুমনের গান নিয়ে গেছে। তার সঙ্গে পরিবারের গান থেকে গেল।এইভাবেই সুমনের গান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে , মাটি থেকে মাটিতে, বসবাস থেকে বসবাসে, হাহাকার থেকে উল্লাসে, আন্দোলন থেকে নির্জনতায় ছড়িয়ে পড়বে। সুমনের গান বন্ধ হলেই আমরা হাত-পা ছুড়ে খাওয়া বন্ধ করে দেব।
৩.
আমি, আমার মতো অনেকেই সুমনের গানের জন্য বেঁচে গেলাম।